আজকের শিরোনাম :

রোগে-শোকে নয়, শিশুরা বেশি মরছে পানিতে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:২৮

এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গড়ে দিনে ৪০টি শিশু মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে। জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। এমনকি রোগে ভুগে মৃত্যুর চেয়ে দেশটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারই বেশি বলে মনে করেন গবেষকরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটে এশিয়াতেই, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়।

সেখানে আবার পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি বলে জানাচ্ছে এক জরিপ। বলা হচ্ছে, দেশটিতে গড়ে দিনে ৪০টি শিশু মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে।

ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস, জন হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, দি সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বা সিআইপিআরবি এবং আইসিডিডিআরবি'র এক গবেষণায় এই তথ্য বের হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, প্রতিবেশী ভারতে পানিতে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় বেশি হলেও জনসংখ্যার অনুপাতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু হার বাংলাদেশেই বেশি।

"সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি মারা যায়; কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। কিন্তু এটা রিপোর্ট হয়না। পুলিশের খাতাও এদের সংখ্যা থাকেনা," বলছিলেন তিনি।

কিভাবে জরিপটি হয়েছিলো

২০১৬ বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে একটি ন্যাশনাল সার্ভে পরিচালনা করা হয়েছিলো। দেশের ষোলটি জেলায় শহর ও গ্রামে এ জরিপ পরিচালনা করা হয় তখন।

এসব জেলা থেকে তারা প্রায় এক লাখ শিশুসহ মোট তিন লাখের বেশি মানুষের ওপর চালানো এই জরিপের ফল উঠে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইডিআরসি প্রণীত বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে ২০১৬তে।

ড. আমিনুর রহমান বলছেন, ২০০৩ ও ২০০৪ সালেও প্রায় একই ধরণের সার্ভে হয়েছিলো এবং তখনো একই ধরণের ফল এসেছিলো।

মৃত্যুর নানা ধরণ ও ডুবে মৃত্যুর হার

হেলথ ও ইনজুরি সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, ইনজুরি বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় মানুষ আত্মহত্যা (১৪.৭ শতাংশ) করে।

এরপরেই রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা (১৪.৪ শতাংশ) , এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু (১১.৭ শতাংশ)।

তবে এটি সব বয়সী মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের তথ্য।

প্রতি বছর এ ধরণের বারটি ইনজুরি থেকে মৃত্যুর সংখ্যা দেশে বছরে এক লাখেরও বেশি। অর্থাৎ যত মানুষ দেশে মারা যায় তার ১২ শতাংশই ইনজুরি জনিত কারণে।

মারা যাচ্ছে দিনে ৪০ শিশু!

ড: আমিনুর রহমান বলছেন, যত মানুষ মারা যায় তার মধ্যে ১৭ বছরের কম বয়সীদের বেশির ভাগই পানিতে ডুবে মারা যায়।

"শিশুদের ক্ষেত্রে ০-১৭ বছর বয়সীরা ডুবেই মারা যায় বেশি। প্রতি বছর ১৪ হাজারের মতো শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ গড়ে প্রতি দিন ৪০ জন শিশু প্রাণ হারাচ্ছে পানিতে ডুবে।"

তিনি বলেন, "ধরুন একটি ক্লাসে ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকে। আর প্রতিদিনই এদেশে এমন একটি ক্লাসরুম খালি হয়ে যাচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কারণে।"

"কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মতো একটি চোখে পড়েনা। সে কারণে আলোচনাতেও আসেনা।"

মিস্টার রহমান বলেন, "প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন প্রাণ হারাচ্ছে যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম। অর্থাৎ ১৪ হাজারের মধ্যে দশ হাজারই হলো পাঁচ বছরের কম বয়সী।"

পানিতে ডুবে এতো শিশু মৃত্যুর কারণ কী?

নানা গবেষণা ও জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে মিস্টার রহমান পানিতে ডুবে রেকর্ড পরিমাণ শিশু মৃত্যুর জন্য কয়েকটি রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো:

১. চারদিকে বিভিন্ন ধরণের প্রচুর জলাশয় -পুকুর, নদী, ডোবা, খাল, বিল;

২. সবচেয়ে বিপজ্জনক পুকুর (৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা পুকুরেই হয় যেটি বাড়ির সীমানা বা ঘরের ২০ মিটারের মধ্যে);

৩. দেখ-ভাল করার অভাব: ৬০শতাংশ ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে। কারণ এ সময় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন। বাবারা কাজে ঘরের বাইরে এবং বড় ভাই-বোন থাকলে তারা হয়তো স্কুলে থাকেন;

৪. দরিদ্র গরীব পরিবারে শিশু মৃত্যু বেশি;

৫. বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাঁতার না জানা;

৬. তাৎক্ষনিক প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান না থাকা। ফলে পানিতে ডুবলে সেখান থেকে উঠিয়ে কী করা হবে সেটাই অনেকে জানেনা - বিশেষ করে হার্ট ও শ্বাস-প্রশ্বাস চালুর প্রাথমিক চেষ্টা থাকেনা;

৭. নানা কুসংস্কার- যেমন মাকে ধরতে না দেওয়া বা অনেক সময় শিশুকে মাথায় তুলে চারদিকে ঘোরানো; এবং

৮. হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা: অনেক ক্ষেত্রে ডুবে যাওয়া শিশুকে কী করা হবে বা ফার্স্ট রেসপন্স সম্পর্কে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির অভাব থাকে।

সমাধান কী?

ড: আমিনুর রহমান বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে ডুবে যাওয়া শিশুদের নিয়ে যে কাজ করছেন তারা তাদের কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিলে এ ধরণের দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করছেন তারা। এগুলো হলো:

১. ৫ বছরের নীচের শিশুদের সঠিক তত্ত্বাবধান;

২. ৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাঁতার শেখানো;

৩. কমিউনিটি সচেতনতা তৈরি করা;

৪. কর্মব্যস্ত অভিভাবকদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার যেখানে কেয়ার গিভারের তত্ত্বাবধানে শিশুরা থাকবে; এবং

৫. বুদ্ধি-ভিত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা থাকা।

মিস্টার রহমান বলেন, সরকারিভাবে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ডে-কেয়ার কিছু চালু করেছে এবং বেসরকারি উদ্যোগে তারা নিজেরাও কিছু প্রকল্প নিয়েছেন ইউনিসেফের সহায়তায়।

তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কেউ ডুবলেও তাকে উদ্ধারের পরপর তার শ্বাস ও হার্ট চালু করার যেসব প্রাথমিক উদ্যোগ আছে সেগুলো মানুষকে শেখানো।

"হাসপাতালে আনতে আনতে অনেকেই বাঁচেনা। তাই যারা উদ্ধার করেন তাদের যদি প্রাথমিক ওই জ্ঞান থাকে তাহলে অনেক শিশুই বেঁচে যাবে।" বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ