আজকের শিরোনাম :

নারী ও মেয়েদের অটিজম নির্ণয়ে বাধা যেসব কারণে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৪০

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস আজ ২ এপ্রিল। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ নারী ও মেয়ে অটিজম বহন করে চলেছে কোনো ধরনের রোগ নির্ণয় ছাড়াই।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অটিজম আক্রান্ত প্রতি ১৭ জনে ১৬ জনই পুরুষ। তা হলে সেসব নারীরা কোথায়?

‘প্রচুর সংখ্যায় অটিস্টিক নারী ও মেয়ে-শিশুকে দেখা যায় শান্ত, লাজুক এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের হয়ে থাকে’ বলছিলেন ব্রিটিশ একজন লেখক এবং উদ্যোক্তা অ্যালিস রোয়ে।

তিনি বলেন, প্রায়ই এই শান্ত মেয়েদের সমস্যাগুলো অন্য মানুষদের কাছে ‘অদৃশ্যমান’ থেকে যেতে পারে।

অ্যালিসকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বলা হয়েছিল যে, সে অটিস্টিক ছিল। কিন্তু সে অন্তত পুরুষদের তুলনায় অল্পসংখ্যক নারীদের মধ্যে একজন যার অটিজম নির্ণয় হয়েছে।

অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বা এএসডি একটি সারাজীবনের প্রতিবন্ধকতা যার দ্বারা বাকি বিশ্বের সাথে কোনো ব্যক্তির যোগাযোগ স্থাপন এবং সম্পর্ক তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়।

কীভাবে অটিজম শনাক্ত করবেন?
এএসডি আক্রান্ত মানুষদের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকারিতা স্তর-ভেদে ভিন্ন হয়, এবং তা গভীর মাত্রা থেকে উচ্চতর মাত্রায় প্রসার লাভ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে ধারণা করা হয়, বিশ্বজুড়ে প্রতি ১৬০ শিশুর মধ্যে একজন এএসডি আক্রান্ত। কিন্তু এই সমস্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত বিশাল বৈষম্য রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের সরকারি তথ্য বলছে, প্রায় সাত লক্ষ মানুষ অটিজম স্পেকট্রামে ভুগছে। যেখানে প্রতি ১০ জন পুরুষের অনুপাতে নারীর সংখ্যা একজন।

আর অন্য এক গবেষণা বলছে, পুরো বিশ্বজুড়ে এ সংখ্যার অনুপাত ১৬ : ১।

ব্রিটিশ ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটির সেন্টার ফর অটিজম এর পরিচালক ক্যারল পোভে বলেন, এই সমস্যাটি প্রকট হয়ে উঠছে। ব্রিটেনে নতুন গবেষণা বলছে প্রকৃত চিত্র অনুসারে এই অনুপাত হবে ৩:১-এর কাছাকাছি।

আর এটা যদি সঠিক হয়, বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মেয়ে এই প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জীবন যাপন করছে, এমনকি তারা তা জানেও না পর্যন্ত।

শুরুতে যে লেখক অ্যাটিস-এর কথা বলা হয়েছিল তিনি জানান, তার বয়স ২২ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত তার রোগ নির্ণয় হয়নি।

‘আমার পুরোটা জীবন (রোগ নির্ণয়ের আগ পর্যন্ত)বিস্ময়ের সাথে কাটালাম যে কেন আমি ছিলাম ভিন্ন? এ অনুভূতিটা সম্পূর্ণ ভয়াবহ কারণ আমি ছিলাম সবার থেকে আলাদা এবং চেষ্টা করতাম খাপ খাওয়াতে এবং খুব বেশি যেন আলাদা হয়ে না যাই সে জন্য।’

কিন্তু রোগ নির্ণয়ের পর অ্যালিসের জীবন পাল্টে গেল।

‘কেন আমি আলাদা সে জন্য এখন আমার কাছে একটি নাম আছে এবং কারণ আছে। সবার থেকে ভিন্ন হওয়া এবং তার কোনো কারণ না জানা- এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার, নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ মনে হতো।’

‘রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে মনের শান্তি এবং আত্ম-বিশ্বাস পাওয়ার অর্থ হচ্ছে আমি আমার বিশেষ চাহিদা অনুসারে আমার জীবনধারাকে বদলাতে পেরেছি।’

তিনি জানান, কীভাবে তার জীবন ধারা বদলে গেছে- ‘বন্ধুবান্ধব কিংবা সহকর্মীদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে আমার মধ্যে কিছু সমস্যা রয়েছে এবং যার ফলে আমার চিন্তাভাবনা বা আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক হতে পারে।’

ফলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে এবং সম্পর্কগুলো আরও অর্থপূর্ণ, উপভোগ্য হয়েছে।

অ্যালিসের মতো আরও অনেক মানুষ মনে করেন রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে তাদের বন্ধুবান্ধব, পরিবার সবার কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা এবং তাদের বোঝার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক প্রভাব রেখেছে।

অটিজম নির্ণয় আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ অনেকের ক্ষেত্রে এর প্রভাবে মানসিক অসুস্থতা, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা দেখা যায়।

ব্রিটেনে ছোট পরিসরে চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, ক্ষুধামন্দার সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নারীদের মধ্যে ২৩ শতাংশের অটিজম সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে।

কেন বহু নারী ও মেয়েদের অটিজম থেকে যায় অলক্ষ্যে? ছেলে কিংবা পুরুষদের ক্ষেত্রে অটিজম এর লক্ষণ যেমন হয়ে থাকে নারীদের বা মেয়েদের ক্ষেত্রে ঠিক একইরকম থাকেনা।

তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সম্ভবত, উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন অটিজমের কারণে তারা থেকে যায় অলক্ষ্যে।

গবেষকরা যে সমস্যাটি পেয়েছেন সেটা হলো অটিজম আক্রান্ত মেয়েরা যেভাবে আচরণ করে তা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়-যদি তা আদর্শ নাও হয়- যেটা পুরুষদের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তাদের হয়তো নিষ্ক্রিয়, অন্যের ওপর নির্ভরশীল, কোন কিছুতে সম্পৃক্ত হতে না চাওয়া এবং বিষণ্ণতা ইত্যাদি থাকে।

অটিস্টিক ছেলেদের মতোই- তারা মনেপ্রাণে এবং উন্মাদের মতো আগ্রহী হতে পারে কোন বিশেষ কিছুর প্রতি, কিন্তু তারা হয়তো প্রযুক্তি বা গণিতের মত বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে না।

‘দুঃখজনকভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে যেসব মেয়েরা এইধরনের আচরণের প্রকাশ করে তাদের হয়তো রোগ পরীক্ষা বা চিকিৎসার বদলে বুলিং এর শিকার হতে হয় বা তাদের এড়িয়ে যাওয়া হয়’- বলছিলেন এএসডি অটিজমের শিকার এক শিশুর মা।

রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সংকট কী?
অ্যালিস লাজুক প্রকৃতির কিন্তু জেদি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী। সে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিল কিছু বিষয়কে বুলেট পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করে যেখানে সে জানতে চেয়েছিল কেন সে নিজেকে অটিস্টিক আক্রান্ত বলে মনে করছে।

এর পর তাকে পরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু একটি শিশুর ক্ষেত্রে কী হবে? যদি সে না জানে যে কীভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে?

‘যখন চিকিৎসকরা আমার মেয়েকে এএসডি অটিজমে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করে তখন আমি মানসিকভাবে হালকা অনুভব করতে শুরু করলাম।’ মারিলু নামে একজন নারী যখন প্রথম জানতে পারলেন তার ১০ বছরের মেয়ে সন্তান অটিজম আক্রান্ত তখন তার অনুভূতি কি হয়েছিল- সেটাই বলছিলেন।

কিন্তু যে সমস্যার কোনো চিকিৎসা নেই এবং যার প্রভাব জীবনভর বহন করতে হয় সেই সমস্যায় আক্রান্তের খবর কিভাবে তাকে এমন নির্ভার করল?

তিনি বিষয়টিকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করে তার অনুভূতির বর্ণনা করে ‘আমার ছোট্ট মেয়েটির চরম দুঃখের পেছনে কী কারণ ছিল তা বুঝতে পারা এই যুদ্ধের চরম সীমানায় পৌঁছানো।’

এএসডি শৈশবে শুরু হয় এবং বয়ঃসন্ধিকালে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে চলতে থাকে এবং এএসডি সহ কিছু লোক স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারে, অন্য অনেকের গুরুতর-ভাবে অক্ষমতা থাকে এবং আজীবন যত্ন এবং সহায়তা প্রয়োজন হয়।

বাবা-মা কিংবা তত্ত্বাবধানকারী সচেতন হলে তারা দক্ষতা বাড়ানোর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন, উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তা যোগাযোগ স্থাপনে এবং সামাজিক আচার-আচরণের সমস্যাগুলো মোকাবেলায় ভূমিকা রাখতে পারে।

‘আমার মেয়ে সোফিয়া ভীষণ আজব রকমের লাজুক। সে সিরিয়াস এবং দারুণ সৃজনশীল। এভাবেই তার শিক্ষক তার সম্পর্কে বলত’ ১০ বছরের অটিজম আক্রান্ত মেয়ের কথা বলছিলেন মারিলু।

‘আমি প্রথম থেকেই জানতাম নিজে নিজে বন্ধু তৈরির বিষয়টি তার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল । তার সমবয়সীদের তুলনায় সে ছোটখাটো ছিল।আমি ভাবতাম এটা হয়তো তার নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মানো সংক্রান্ত কারণে হয়ে থাকবে। এটা আমাকে খুব একটা চিন্তিত করেনি যতক্ষণ না স্কুলে তাকে সমস্যায় পড়তে হল। রাতের বেলা ঘুমানোর সময় সে বলতো মা, আমার কোন বন্ধু নেই, কেউ আমাকে পছন্দ করে না।’

আমি তাকে বলতে থাকতাম, আমাদের সবারই ভালো এবং খারাপ দিন আছে। কিন্তু আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম এবং প্রায়ই শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করতাম তারা স্কুলে কোনকিছু ঘটেছে কি-না।

তাদের উত্তর একই থাকতো ‘কিছুই ঘটেনি।’

কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলো এবং মারিলু শিক্ষকদের সাথে দেখা করলেন।
‘‘আমি ভীষণ দিশেহারা হয়ে গেলাম। সোফিয়া বুলিং এর শিকার হচ্ছে কি-না আমি শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু আমাকে বলা হলো, আমি ‘অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ’ এবং ‘অতি-সংবেদনশীল’। এমনকি আমাকে অভিযুক্ত করা হলো তাকে ‘নষ্ট করার’ জন্য।”

এর পর একটা সময় বিষয়টা এমন দাঁড়ালো সোফিয়ার জন্য স্কুল হয়ে উঠলো আতঙ্কের জায়গা। একজন বন্ধুকে তার মা বলেছিল, ‘তাকে স্কুলে নেয়া যেন কসাইখানায় নেয়ার মতো। কয়েক মাসের মধ্যে আমার মেয়ে রাগী এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো- বাড়ির বাইরে সে ভালো থাকার ভান করতে লাগলো, কেবল মাত্র যখন অঅমার সাথ ঘরে থাকতো তখনই সে শান্ত থাকতো।”

‘আমি জানতাম সোফিয়া কষ্ট পাচ্ছিল এবং আমি তাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারছিলাম না। চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছিলাম।’

মারিলু বুঝতে পারছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার আবেগ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল। তা না করে যা ঘটছে তাকে যদি ব্যাখ্যা করতে পারতেন তাহলে হয়তো আরও আগেই রোগটি নির্ণয় করা যেত-আক্ষেপ তার।

লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান
লেখক অ্যালিস বলছেন, কেউ যদি অটিজম আক্রান্ত কাউকে সাহায্য করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই আগে এ সম্পর্কে জানতে হবে, পড়তে হবে।

তিনি বলেন, ‘আপনি যদি একজন অটিস্টিক আক্রান্ত ব্যক্তি হয়ে থাকেন যিনি তার আজীবন এর সাথে মানিয়ে নেয়া চেষ্টা করে যাচ্ছেন তবে বিশ্বাস করতে শুরু করুন যে এর সাথে মানিয়ে না নিলেও চলবে।’

অ্যালিস দ্য কার্লি হেয়ার প্রজেক্ট পরিচালনা করছেন এবং এই সামাজিক উদ্যোগ অটিস্টিক মানুষের সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, আপনার অনন্য দক্ষতা ও শক্তি রয়েছে, যদি সম্ভব হয় আপনি আমার মত এমনকিছু করতে পারেন এবং নিজের ভিন্নতাকে আপনার জীবিকা অর্জনের অংশ করতে পারেন।’

কিন্তু বাবা-মা বা তত্ত্বাবধানকারীর কী করতে হবে?
শিশু সন্তানদের ‘ভিন্ন’ আগ্রহকে খুঁজে বের করুন এবং সে যে চোখে বিশ্বকে দেখছে তাকেই সাধুবাদ জানান।

মনে রাখতে হবে যেটি আপনার জন্য খুবই সহজ সেটি তার জন্য অত্যন্ত কঠিন হতে পারে।

সোফিয়া এখন খুশি কারণ শেষ পর্যন্ত তার রোগ নির্ণয় করা গেছে। সে বলছে, ‘আমি এখন অনেকটা নির্ভার বোধ করছি কিন্তু কিছুটা হলেও চিন্তিত। আমি চাইনা আমার ক্লাসের বন্ধুরা জানুক কারণ আমি সবার থেকে আলাদা হতে চাইনা এবং আমাকে নিয়ে কেউ হাসি-তামাশা করুক সেটা চাই না। কিন্তু তার রোগটি শনাক্ত না হলেই কি সে খুশি থাকতো?

‘ওহ না, আমি জানতে চাই। এটা আমার মনের ভার কমিয়ে দিয়েছে।’
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ