নারী সমকামীরা কীভাবে গোপন ভাষায় কথা বলে?
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২১:১৩
গত কয়েকমাস ধরে আফ্রিকার দেশ বুরুন্ডির অনেক লেসবিয়ান বা সমকামী তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।
তারা বর্ণনা করেছেন, এমন একটি দেশে বাস করছেন তারা যেখানে সমকামিতা নিষিদ্ধ - আর তাই সেখানে একে অপরের সাথে যোগাযোগে তারা ব্যবহার করেন এমন কিছু সাংকেতিক চিহ্ন, যা সামাজিক মাধ্যম বা বিভিন্ন চ্যাটিং অ্যাপে তাদের পরিচয়কে তুলে ধরে।
এই প্রতিবেদনে আসল সংকেতগুলোর বদলে একটি নীল অপরাজিতা ফুল ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ উনিশ শতকের শুরুর দিকে সমকামী নারীরা তাদের বান্ধবীকে নীল অপরাজিতা উপহার দিতেন।
তবে এই প্রতিবেদনের নীল অপরাজিতা একটি উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছে, যার সঙ্গে ওই গ্রুপ বা আফ্রিকার কোন সমকামীদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা নেই।
নেলা
একটি বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে বিবিসির কাছে একটি ছবি পাঠিয়েছেন নেলা। সেখানে তিনি একদল শিশুর মাঝে একটি চেয়ারে বসে আছেন দেখা যাচ্ছে।
আমার সন্তানরা, তিনি লিখেছেন, তাদের বয়স ১০ বছরের নীচে। শিশুরা নানা অঙ্গভঙ্গি করে খেলা করছে।
নেলার হিজাব পরে রয়েছেন। তারপরেই আরেকটি ছবি ভেসে এলো। এই ছবিতে তিনি ঢিলেঢালা জিন্স আর টাইট টি-শার্ট পরে রয়েছেন। তার প্যাঁচানো কালো চুল দেখা যাচ্ছে, যা তার কাঁধ বেয়ে নীচে নেমে এসেছে।
তিনি খোলা একটি রেস্তোরাঁর টেবিলে বসে রয়েছেন, তার হাত জড়িয়ে রেখেছে একজন তরুণীকে। দুই নারীর মুখেই রয়েছে দন্ত বিকশিত হাসি। ''আমার মেয়ে বন্ধু,'' তিনি লিখেছেন, ''আমরা কি দেখতে সুন্দর নই?''
তিনি বলছেন, এই প্রথম তিনি কারো সামনে নিজের এই বন্ধুকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলেন। সেটা তাকে ভালো লাগার একটি অনুভূতি দিচ্ছে।
তার পরিবার অবশ্যই তার এই সম্পর্কের বিষয়ে কিছু জানে না। কিন্তু যখন তিনি এই বান্ধবীর সঙ্গে বাইরে যান, তখন তাদের একত্রে দেখলেও তাদের সম্প্রদায়ের কেউ কিছু বুঝতে পারবে না বলে তিনি নিশ্চিত। হয়তো তাকে দেখলেও চিনতে পারবে না।
কারণ যখন তিনি বাইরে যান, তখন তিনি হিজাব পরেন না, যা সবসময়েই তিনি বাড়িতে পরে থাকেন।
নিয়া
একজন মেয়ে হিসাবে যখন বড় হয়ে উঠেছেন, কখনোই ছেলের প্রতি কোন আকর্ষণ বোধ হয়নি নিয়ার।
যখন তার বয়স ২২ বছর, কাছাকাছি বয়সের একজন মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
গানের প্রতি ভালোলাগা থেকে তারা দুজনে দ্রুতই ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন।
''আমরা গল্প করতে পছন্দ করতাম'', বলছেন নিয়া। '' তারপর একদিন, এক গভীর আলোচনার মধ্যে সে আমার দিকে ঘুরে তাকালো - আর বললো, আমি নারীদের পছন্দ করি। আমি ভাবলাম, বাহ।''
বাড়িতে ফিরে এসে নিয়া বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বন্ধুর জন্য তারও অনুভূতি কাজ করছে।
এরপর থেকে তারা গোপনে দেখাসাক্ষাৎ করতে শুরু করলেন। তারা একসঙ্গে বাইরে খেতে যেতেন, কেনাকাটা করতেন বা বারে যেতেন।
বাইরের পৃথিবীর কাছে হয়তো মনে হতো যে, তারা দু'জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা একসঙ্গে ঘোরাফেরা করছে। সম্পর্কটি বেশিদিন টেকেনি, তবে একটি বিষয় তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
নিয়া এখন জানেন, কেন তিনি কোন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন না।
নিয়া ভাবলেন, তার পরিবারের অন্তত একজন সদস্যের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত। তিনি তার একজন ভাইকে সবকিছু খুলে বললেন।
''তিনি আমাকে শুধু দুটি প্রশ্ন করলেন। কতদিন ধরে আমি এটা জানি, আর আমি পুরো নিশ্চিত কিনা?''
''আমি জবাব দিলাম, দুই বছর এবং হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।''
তিনি বলছেন, নিজের ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, কারণ নেলার মতো নিয়াও অনেক সময় অনলাইনে কাটিয়েছেন।
তার ভাই বললেন, ''ঠিক আছে, যেটা ভালো মনে করো। তুমি জানো, আমি সমসময়েই তোমাকে সমর্থন করে যাবো।''
এটাই ছিল সর্বশেষ যখন ভাইয়ের সঙ্গে তার কথা হয়।
ইউটিউব আর ইন্টারনেটে সমকামী যুগলদের সম্পর্কে, তাদের প্রতিদিনকার জীবন সম্পর্কে দেখতে লাগলেন নিয়া। সমকাম নিয়ে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রগুলো দেখতে লাগলেন। সমকামী, উভকামী, এলজিবিটি কম্যুনিটি নিয়ে নানা লেখা পড়তে লাগলেন।
তখন তিনি ইন্টারনেটের সমকামীদের নানা ভাষা ও সংকেত বুঝতে শুরু করলেন।
''আমি অনেক মিমস (অর্থবোধক চিহ্ন) ব্যবহার করতে শুরু করলাম, বিশেষ করে অন্য নারীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কিছু মিম।''
লেইলা
লেইলার বয়স যখন ২১, তখন থেকে তিনি একজন যুবকের সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করেন। কিন্তু কিছু একটা ভুলভাল হচ্ছিল।
''আমি যেন ঠিক সম্পর্কটার মধ্যে ছিলাম না।'' তিনি বলছেন। ''আমি ভাবলাম, হয়তো এর কারণ যে, ওই ব্যক্তি যথেষ্ট সুন্দর ছিলেন না।
তাই আমি তাকে বাদ দিয়ে সুন্দর আরেকজন ব্যক্তির সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করলাম।'' কিন্তু সেটিও কাজ করছিল না।
তখন আমার একজন পুরুষ বন্ধু আমাকে বললেন, ''তুমি ঠিক জানো যে, তুমি নারীদের পছন্দ করছো না?''
তখন তিনি বিষয়টি উপলব্ধি করতে শুরু করলেন। নিজেকে মিথ্যা বলার আর কোন কারণ ছিল না।
আমি একজন সমকামী, লেইলা নিজেকে বলতে লাগলেন। কিন্তু তিনি বলছেন, তখনো তার মধ্যে আশা কাজ করেছিল যে এ থেকে হয়তো তিনি বেরিয়ে আসতে পারবেন।
তারপরে আস্তে আস্তে তার প্রতিরোধ কমে আসতে থাকে।
নিয়া এবং নেইলার মতো তিনিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাইরের দুনিয়ার দিকে নজর দিতে শুরু করলেন।
''আমি ভাবতে লাগলাম, হয়তো বুরুন্ডির বুজুমবুরা শহরে আমি একা, কিন্তু এই পৃথিবীতে আমি একা নই।''
ভাগ্য এবং ইন্টারনেট
বুজুমবুরা শহরে সমকামী ও উভকামী নারীদের জন্য দুইটি পথ অনুসরণ করে একে অপরকে খুঁজে বের করেন। একটি হচ্ছে ভাগ্য, অপরটি ইন্টারনেট।
''আমার কর্মক্ষেত্রে লেইলার সঙ্গে পরিচয় হয়'', বলছেন নিয়া। ''দুপুরের খাবারের সময় প্রথম আমাদের কথাবার্তা শুরু হয়। আলাপের একপর্যায়ে আমরা বুঝতে পারি যে, আমরা দুজনে একই রকম।''
''এখানে লেসবিয়ানদের জন্য এমন কোন জায়গা নেই যে আপনি গুগলে খোঁজ করে সেখানে চলে গেলেন,'' তিনি বলছেন।
লেইলা বলছেন, ''এটা সত্যিই ব্যাখ্যা করা কঠিন যে, আফ্রিকায় সমকামী লোকজন কিভাবে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। এটা এমন কিছু যা প্রকাশ্যে বলা হয় না। হয়তো তার আচরণ, শরীরের ভাষা, চোখের দৃষ্টি দেখে একে অপরকে চিনে নিতে হয়।''
লেইলা, নিয়া এবং নেলা পরবর্তীতে একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ে পরিণত হন।
তারা বলছেন, বুরুন্ডিতে তাদের মতো অসংখ্য লোকজন আছে, যারা গোপনে একে অপরের সঙ্গে দেখা করেন।
কালো দিক
২০০৯ সালে বুরুন্ডির সরকার একটি আইন জারি করে, যেখানে সমকামিতাকে অপরাধ হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
এ অপরাধে দণ্ডিত হলে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ ফ্রাঁ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
ফলে বুরুন্ডিতে সমকামীদের মধ্যেও লেসবিয়ানদের বিষয়ে আরো কম জানা যায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০০৯ সালে এলজিবিটি কম্যুনিটির ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেখানে মাত্র একজন লেসবিয়ানের সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব হয়। তবে বিবিসি বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে।
''আমাদের দলটি অনেক শক্তিশালী এবং সক্রিয়,'' বলছেন নিয়া। তারা আশা করছেন, এটি তাদের আলাপ আলোচনার একটি সূচনা মাত্র।-বিবিসি
এবিএন/মমিন/জসিম