আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশে মি-টু আন্দোলন: কী হতে পারে পরিণতি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:৫৮

বাংলাদেশে যৌন হেনস্তার অভিযোগ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়েছেন যে কজন নারী, তাদের একজন আসমা উল হুসনা। ঢাকার একটি নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কথিত যে যৌন হয়রানির ঘটনা তিনি তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, তা পাঁচ বছর পুরনো।

কেন এতদিন পর মুখ খুললেন তিনি?

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, যৌন হেনস্থা সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা তৈরির তাড়না থেকেই তিনি সামনে আসতে চেয়েছেন, এবং মি-টু প্লাটফর্ম তাকে সেই সাহস এবং সুযোগ জুগিয়েছে।

সেই সাথে ছিল একেবারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক একটি তাড়না। আসমা বলেন, তার দুই ভাগ্নি পরোক্ষভাবে তাকে সাহস দিয়েছে।

"পাঁচ বছর ধরে আমি একটা মানসিক যন্ত্রণার ভেতর ছিলাম, সেটা ফেটে বেরিয়েছে। সেইসাথে ব্যক্তিগত পারিবারিক একটা বিষয় আমার বিবেককে ঘা দিয়েছে। আমার দুই ভাগ্নি বড় হচ্ছে। আমি ভেবেছি আমি মুখ খুলে যদি তাদের জন্য যদি একটি নিরাপদ সমাজে বসবাসের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারি, তাহলে কেন বলবো না।"

কিন্তু এতদিন পর এই কথা মানুষ বিশ্বাস করবে কেন? আসমা উল হুসনার উত্তর ছিল - মানুষ বিশ্বাস করুক না করুক সেটা তার বিবেচনা নয়। তিনি বলেন, তার ভেতরের যন্ত্রণা উগরে দেওয়ার তাড়নাই তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। "আমি ভাবলাম কথা তো বলতে হবে, না হলে আবারো আমার সাথে এটা হতে পারে, অন্যের সাথে হতে পারে।"

মি-টু কতটা সাড়া ফেলেছে

প্রথম এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসেন মাকসুদা আখতার প্রিয়তি নামে একজন প্রবাসী বাংলাদেশী মডেল। ২৯শে অক্টোবর একটি ফেসবুক পোস্ট সরাসরি একজন ব্যবসায়ীর নাম করে তিনি লেখেন, ২০১৫ সালে ঐ ব্যবসায়ী তার শরীরে হাত দিয়েছিলেন, ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন।

সেটাই শুরু। তারপর, তিন সপ্তাহের মধ্যে একে একে আরো অন্তত আটজন নারী ফেসবুকে যৌন হয়রানির অভিযোগ করে পোস্ট দিয়েছেন। এরা সবাই বলছেন, হ্যাশট্যাগ মি-টু নামে যে আন্দোলন আমেরিকাতে শুরু হয়েছিল, তাতে অনুপ্রাণিত হয়েই বহুদিন ধরে চেপে রাখা ক্ষোভ তারা প্রকাশ করেছেন তারা।

'শুধু আন্দোলন করলে বা অভিযোগ করলেই হবেনা, কাউকে না কাউকে ব্যবস্থা নিতে হবে,' আফসান চৌধুরী, লেখক ও শিক্ষক
বাংলাদেশে কতটা সাড়া ফেলেছে এই মি-টু আন্দোলন? যে পরিবর্তনের আশা আসমা উল হুসনা করছেন, তা নিয়ে কতটা আশাবাদী হতে পারেন তিনি?

খুব বেশি উৎসাহ দেখাতে রাজি নন লেখক-শিক্ষক আফসান চৌধুরী । শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন নিয়ে তার গবেষণা এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন তিনি।

"এদেশে সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতন হয় শিশুদের ওপর। প্রায় ২৫ বছর ধরে এ নিয়ে আমি কাজ করছি, কিন্তু জনগণের কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাইনি। এমনকী গণমাধ্যমের কাছ থেকেও পাইনি।"

মি. চৌধুরী মনে করেন, সমাজের কিছু 'নামীদামী লোকে'র কথা উঠেছে বলেই এখন এ নিয়ে এত কথা হচ্ছে। "কিন্তু যৌন নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে সমাজে তেমন আগ্রহ আছে বলে মনে হয়না।"

ফলে, তার ধারণা, পশ্চিমা বিশ্বে মি-টু আন্দোলন যেভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, বাংলাদেশেও তাই হবে।।

অতটা হতাশ হতে রাজি নন সাংবাদিক এবং নারী অধিকার কর্মী সাজেদা হক। যে সব নারীরা যৌন হেনস্তার অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলছেন তাদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জোগানোর জন্য তৎপর হয়েছেন তিনি। তার উদ্যোগে মি-টু নিয়ে ঢাকায় সম্প্রতি একটি পথ-সভা এবং একটি গোল টেবিল আলোচনা হয়েছে।

মিজ হক বলেন, "আমার কাছে তো মনে হয়, সমাজের চোখ খুলতে শুরু করেছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই সেই লোক, এটা একটা আমূল পরিবর্তন।। আমরা দেখতে পাচ্ছি, গণমাধ্যমের বড় বড় পদ-ধারী লোকজন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজনও আতঙ্কিত, তারা মনে করছেন এটা থামাতে হবে... ক্ষমতাবানদের মধ্যে ভীতি ঢুকেছে, এটা একটি বড় অর্জন।"

মৌলিক কোনো পরিবর্তন কি আসবে?

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অনলাইনে মধ্যবিত্ত সমাজের অল্প কজন কিছু নারীর একটি সামাজিক আন্দোলন তৈরির প্রয়াস কতটা কাজে দেবে? আফসান চৌধুরী মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না বদল করা গেলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটানো কঠিন।

"বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন যথেষ্ট, কোথাও কোথাও এর প্রতিকারে শক্ত ব্যবস্থা আছে, অধিকাংশ জায়গাতে নেই। আমি যখন ব্র্যাকে (এনজিও) কাজ করতাম, তখন যৌন হেনস্তার অভিযোগে একজন পরিচালকের চাকরি গিয়েছিল। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনও এটাকে গুরুত্বই দেওয়া হয়না।"

তিনি বলেন, যৌন হেনস্তা বন্ধ করতে হলে, কমাতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা না হলে এগুলো শুধু অভিযোগের মধ্যেই থেকে যাবে।

যেসব যৌন হেনস্তার ঘটনা এই আট-নয়জন নারী করেছেন তার অনেকগুলোই বেশ পুরনো। এমনকী অভিযুক্ত একজন বেশ কবছর আগে মারাও গেছেন। কথিত এসব অপরাধ প্রমাণ করা কতটা সহজ হবে তাদের জন্য? বাংলাদেশের আইন কতটা সহায়তা করবে?

আইন কী বলে?

আইনজীবী এবং নারী অধিকার কর্মী নীনা গোস্বামী বলেন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তা নিয়ে কোনো আইন এখনও বাংলাদেশে নেই।

তবে ২০০৯ এবং ২০১১ সালে হাইকোর্ট থেকে এ ব্যাপারে দুটো নির্দেশনা ছিল । সেই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল - নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি ধারা যোগ করে যৌন হেনস্তাকে একটি অপরাধ হিসাবে দেখাতে হবে। কিন্তু সেটা এখনও করা হয়নি।

তবে এ ব্যাপারে হাইকোর্টের দেওয়া একটি গাইডলাইন রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্তার ঘটনা তদন্তে এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে কমিটি করতে হবে।

নীনা গোস্বামী বলেন, "অনেক প্রতিষ্ঠানে আছে, অনেক প্রতিষ্ঠানেই নেই। আছে কি নেই তা মনিটরিং করারও কেউ নেই।"

সুতরাং এসব অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে, বিশেষ করে কথিত অপরাধের ঘটনা যদি যদি পাঁচ-দশ-বিশ বছর আগের হয়।

এখন পর্যন্ত অভিযুক্তরা সবাই বলছেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা, কল্পনাপ্রসূত, উদ্দেশ্য-প্রণোদিত।

প্রমাণ কীভাবে দেবেন অভিযোগকারীরা?

তার অভিযোগের প্রমাণ দেওয়ার প্রশ্ন উঠলে কিভাবে তা দেবেন? আসমা উল হুসনা বললেন, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত নন।

"আমার প্রতি অন্যায় হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। সেই প্রমাণ আমি এখন কীভাবে দেব। তখন আমি যে মানুষ ছিলাম, তা থেকে এখন আমি অনেক আলাদা। আমি অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু পাঁচ বছর আগে আমিও অনেক মানসিক এবং সামাজিক বিধি-নিষেধের মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম...আমার মানসিক যন্ত্রণাই আমার প্রমাণ। আমি আদালতে তা দেখাতে পারবো না, প্রমাণ করতে পারবো না।"

অধিকার কর্মী সাজেদা হক মনে করেন, আদালতে অভিযোগ প্রমাণের কোনো দায় এসব নারীর নেই।

"মি-টু আন্দোলনের মূল ইস্যুটাই হচ্ছে, নির্যাতিতা নারীরা তাদের কথা বলবে, সে বিচার চাইবে।... আপনি কি দেখাতে পারবেন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো উঠেছে তারা কেউ বলছেন যে আমি এই মেয়েকে চিনিনা, তার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি, কেউ তা বলছেন না।"

সাজেদা হকের বিশ্বাস, মি-টু আন্দোলন কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য নিরাপদ করবে ।

"আমরা যদি এই অন্দোলনকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পারি, বিবেচনা-বোধের জায়গায় যদি শক্ত ঘা দিতে পারি, তাহলে নারীদের জন্য কাজের পরিবেশ ভালো হবে।...কেউ বন্ধু হতে চাইলে তো কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সবাই তো বন্ধু হতে চায়না। যে চায়না তাকে সেই নিরাপত্তা দিতে হবে। আমরা এটুকুই চাই।"

"আমরা চাই মেয়েরা যেন যে কোনো প্রতিষ্ঠানে, দিনে বা রাতে, সন্ধ্যা বা সকালে নিরাপদে কাজ করতে পারে, সে যেন তার পুরুষ সহকর্মীদের হাতে যৌন হেনস্তার শিকার না হয়।"

কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে অল্প কিছু নারীর আন্দোলন দিয়েই কি তা নিশ্চিত করা সম্ভব? সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে কি চাকুরিদাতারা, নিয়োগকারীরা নারীদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ করতে তৎপর হবেন? সাজেদা হক ভরসা করলেও, আফসান চৌধুরী সন্দিহান।

"প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এসব ঝামেলা হয়, আমার পরিচিত অনেক মেয়েই এর শিকার হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ করতে অনেকে ভয় পায়, যদি চাকরিটা চলে যায়...মামলা করতে গেলে মেয়েদের বিয়ের সমস্যা হয়। মামলা করলে যে হয়রানি, তাতে পরিবারগুলো এই পথে যেতে রাজি হয়না। এই বাস্তবতা আমাদের দেশে রয়েছে।"

তারপরও অভিযোগ যদি অত্যন্ত ক্ষমতাধর কারো বিরুদ্ধে হয়, প্রতিষ্ঠান হয়তো ব্যবস্থা নিতে পিছু হটবে।

"আমাদের দেশে সকল আন্দোলনই শেষ হয়ে যায়। ফলে শুধু আন্দোলন করলে বা অভিযোগ করলেই হবেনা, কাউকে না কাউকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা দরকার। সেই চাপ কোথা থেকে আসবে। সরকারের করা উচিৎ, সরকার করবে কিনা জানিনা।"


মি-টু আন্দোলন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে, গণমাধ্যমে তর্ক-বিতর্ক চললেও, সরকারের কাছ থেকে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছু শোনা যায়নি। তারা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। সূত্র: বিবিসি বাংলা। 

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ