আজকের শিরোনাম :

কোন আচরণ ও কাজকে যৌন হয়রানি বলা যাবে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০১৮, ২২:১৫

বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে যৌন হয়রানি সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করা হলেও এ সম্পর্কে আলাদা করে সুনির্দিষ্ট কোন আইন নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা।

এবিষয়ে সুস্পষ্ট একটি আইন তৈরি করার জন্যে আদালতের পক্ষ থেকে আদেশ থাকা সত্ত্বেও গত আট বছরে এই আইনটি তৈরি হয়নি।

এর ফলে কী ধরনের আচরণ যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন আইনি ধারণা পাওয়া যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশে শুরু হওয়া মি-টু আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তারা এসংক্রান্ত একটি আইন তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন।

সম্প্রতি বেশ কয়েকজন নারী সোশাল মিডিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কিছু অভিযোগ তুলে ধরেছেন।

তবে আইনজীবীরা বলছেন, ঠিক কোন কোন ঘটনাকে যৌন হয়রানি বলে ধরা হবে সেবিষয়ে আদালতের একটি গাইডলাইন বা দিক নির্দেশনা রয়েছে।

আদালতের ওই আদেশে বলা হয়েছে, যতদিন পর্যন্ত এবিষয়ে আলাদা করে কোন আইন তৈরি না হবে, ততদিন পর্যন্ত এই দিক নির্দেশনাই আইন বলে গণ্য হবে। তবে এই দিক নির্দেশনাটি দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ব্যাপারে।

এক দশক আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর দায়ের করা এক রিট পিটিশনের জবাবে এই নির্দেশনাটি দেয় হাই কোর্ট।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী সালমা আলী ২০০৮ সালে এই পিটিশনটি দায়ের করেছিলেন।

তিনি বলেন, "আদালত তখন দিক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরকারি বেসরকারি প্রত্যেকটি অফিসে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন নারীকে প্রধান করে একটি করে কমিটি গঠন করারও আদেশ দিয়েছিল।"

বাংলাদেশে যেসব মেয়েরা তাদের যৌন হয়রানির শিকার হবার অতীত অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছেন - তাদের সাথে সংহতি জানিয়েছেন অনেকেই।

যৌন হয়রানির মধ্যে কী কী পড়ে

আইনজীবীরা বলছেন, বর্তমানে যেসব আইন আছে তাতে এক কথায় যৌন হয়রানির কোন সংজ্ঞা নেই। তবে আদালতের নির্দেশনা অনুসারে যেসব বিষয় যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হতে পারে সেগুলোর একটি লম্বা তালিকা রয়েছে।

বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর এক যৌথ বেঞ্চের দেওয়া ওই গাইডলাইনে কোন কোন বিষয় যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচিত হবে তার বিস্তৃত সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই সংজ্ঞা প্রযোজ্য হবে শুধু কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের একজন আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলছেন, এর আগে বাংলাদেশে যৌন হয়রানির ব্যাপারে আলাদা করে কোন সংজ্ঞা ছিল না।

"এর পরেও আদালতের কাছ থেকে আরো একটি রায় পেয়েছি যেখানে আগের দিক নির্দেশনাটির সাথে আরো কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে। সেখানেও সরকারকে এবিষয়ে খুব দ্রুত একটি আইন তৈরি করতে বলা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে সেখানে যৌন হয়রানিকে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলেছিল আদালত । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও পর্যন্ত সেটা হয়নি।"

আদালতের দিক নির্দেশনা অনুসারে যেসব বিষয় যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হবে সেই তালিকার মধ্যে রয়েছে:

অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ। যেমন শারীরিক স্পর্শ, এধরনের প্রচেষ্টা। প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা। যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি, যৌন সুযোগ লাভের জন্যে অবৈধ আবেদন।
পর্নোগ্রাফি দেখানো, ব্ল্যাক মেইল কিম্বা চরিত্রহননের জন্যে স্থির ও ভিডিও-চিত্র ধারণ।

যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা অশালীন ভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্যক্ত করা, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা উপহাস করা। অশালীন উদ্দেশ্য পূরণে কোন ব্যক্তির অলক্ষ্যে তার নিকটবর্তী হওয়া বা অনুসরণ করা।

চিঠি, মোবাইল, টেলিফোন, এসএমএস, ছবি, নোটিস, কার্টুন বেঞ্চ, চেয়ার টেবিল নোটিস বোর্ড, অফিস ফ্যাক্টরি, শ্রেণি কক্ষ, বাথরুমের দেওয়ালে যৌন অপমানজনক কিছু লেখা।

যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে খেলা ধুলা, সংস্কৃতি এবং শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করা।
প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা।

ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টা করা। আইনজীবীরা বলছেন, উপরে উল্লেখিত এসব বিষয় কারো কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত বা অগ্রহণযোগ্য হলে সেটা যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হবে। তারা বলছেন, প্রেম, বিবাহ, ভালোবাসা- যে কোন সম্পর্কের মধ্যেও এসব যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটতে পারে।

মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি নামের এই নারী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ধরেছেন।
কোথায় বিচার চাওয়া যায়?

আইনজীবীরা বলছেন, আদালতের দিক নির্দেশনা অনুসারে শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে সেটা এর আওতায় বিচার করা সম্ভব।

নীনা গোস্বামী বলছেন, ওই গাইডলাইনে বলা আছে, সরকারি বেসরকারি প্রতিটি সংস্থায়, প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্যে কমপক্ষে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করতে হবে। তার মধ্যে তিনজন হবেন ওই প্রতিষ্ঠানের এবং আরো দু'জনকে ওই প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নেওয়া হবে। এবং এই কমিটিতে নারী সদস্যদের সংখ্যা বেশি রাখার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।"

আইনজীবীরা বলছেন, তাদের জানা মতে এখনও পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠানেই এধরনের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তবে সালমা আলী বলছেন, এরকম কমিটির মাধ্যমেও বিচার পাওয়ার খুব ভাল অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তিনি বলছেন, দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠেছে তাতে ছুটি দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এরকম নজিরও আছে।

তিনি বলছেন, কর্মক্ষেত্রে কিম্বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির শিকার হলে অভিযোগকারী ব্যক্তি প্রথমে ওই কমিটির কাছে যেতে পারেন। তবে সেটা নির্ভর করছে অভিযোগের মাত্রার ওপরে।

"শাস্তি হিসেবে তাকে যে জেলে পাঠাতে হবে তা নয়। অপরাধ অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। চাকরি থেকে তাকে সাময়িকভাবে কিম্বা চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হতে পারে। অভিযোগ গুরুতর হলে বিষয়টি থানা পুলিশের কাছে গিয়েও গড়াতে পারে," বলেন সালমা আলী।

সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টারের একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তার একজন সহকর্মী তাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলার পর ওই কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে যে বিষয়টি তদন্ত করে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

কিন্তু অফিস কিম্বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাইরে, পরিবারের ভেতরে, অন্য একটি পরিবারে, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে, রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলে ভিকটিম কার কাছে যাবেন?

আইনজীবীরা বলছেন, সেসব ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার বিষয়ে কিছুটা সমস্যা রয়ে গেছে। আর সেকারণেই এধরনের ঘটনা প্রতিরোধের জন্যে যৌন হয়রানিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মধ্যে সেটাকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল।

নীনা গোস্বামী বলেন, "ওই কমিটি যদি দেখে যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ধর্ষণের পর্যায়ে চলে গেছে, তখন তারা সাথে সাথে সেটাকে পাঠিয়ে দেবে পুলিশের কাছে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ বা মৌখিক নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে সেখান থেকে প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই থাকে।"

এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, বিভিন্ন আইনের দু'একটা ধারায় যেভাবে যৌন হয়রানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটা খুবই অস্পষ্ট। তারপরেও যেসব আইনে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে তার মধ্যে রয়েছে:

তবে পুলিশের কাছে গেলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। যেমন মোবাইল কোর্ট ডেকে তাৎক্ষণিকভাবেই এর বিচার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

অভিযোগ যখন বহু বছর পুরনো

মি-টু আন্দোলনের অংশ হিসেবে নারীরা ফেসবুকে যেসব অভিযোগ তুলে ধরছেন সেগুলো কয়েক বছর আগের ঘটনা। কখনও কখনও সেটা ২০/৩০ বছরেরও বেশি পুরনো। সেসব অভিযোগের বিচারের ভবিষ্যৎ কতোখানি এব্যাপারেও আইনজীবীরা সংশয় প্রকাশ করেছেন।

"সেটা নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর। তারা যদি মনে করে ব্যবস্থা নেবেন তাহলে সেটা তারা এখনও নিতে পারেন। কিন্তু এমন কোন সাধারণ আইন নেই যার আশ্রয় নিয়ে কর্মস্থান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির বিচার পাওয়া সম্ভব," বলেন নীনা গোস্বামী।

তারা বলছেন, থানায় গেলে বেশিরভাগ সময় সেখান থেকে যেসব জিনিস চাওয়া হয় সেগুলো না থাকার কারণে ঠিক মতো মামলাও করা যায় না। যৌন হয়রানি সম্পর্কে থানার পুলিশও খুব একটা সচেতন নয়।

সালমা আলী বলছেন, "এতো বছর আগের একটি ঘটনা প্রমাণ করা খুব কঠিন। তবে সেসময় তিনি যদি কোন ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন, কোথাও লিখিতভাবে অভিযোগ করে থাকেন, তখন যদি কোন প্রতিবাদ হয়ে থাকে, হয়তো অভিযুক্ত ব্যক্তির চাকরি চলে গিয়েছিল কিম্বা তিনি নিজে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেগুলোকেও কিন্তু তারা আজকে প্রমাণ হিসেবে হাজির করতে পারেন।"

তবে তারাও এও স্বীকার করেছেন যে এতো আগের এরকম একটি অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ, কিম্বা সাক্ষী হাজির করা খুব কঠিন একটি কাজ।

সালমা আলী বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যারা পুলিশের কাছে গেছেন তারা এক পর্যায়ে মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সামাজিক চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত তারা একটা আপোষে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তারা বলছেন, এই বিচারের সময় ভিকটিম যাতে আবারও দ্বিতীয়বারের মতো সমাজের কাছে ভিকটিম হয়ে যান সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

আইনজীবীরা বলছেন, এজন্যে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে খসড়া করে সেটা আইন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় থেকে এধরনের আইন প্রণয়নের ব্যাপারে এখনও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সালমা আলী বলছেন, সুনির্দিষ্ট কোন আইন না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে নারীরা যৌন হয়রানির বিচার চাইতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নারীরা সেটা করতে চায় না। কারণ এই প্রক্রিয়ায় যে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা থাকে না।" সূত্র: বিবিসি বাংলা।
 
এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ