বিশ্বকাপ ২০১৮ : কীভাবে তিতে ব্রাজিলকে বদলেছেন
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০১৮, ১১:২৩ | আপডেট : ১৩ জুন ২০১৮, ১১:৪১
ঢাকা, ১৩ জুন, এবিনিউজ : ৯ জুলাই, ২০১৪। নেদারল্যান্ডসকে পেনাল্টি শুটআউটে হারিয়ে আর্জেন্টিনা ফাইনালে গেছে। কিন্তু আগের দিনের সেমিফাইনালের ফলাফল নিয়ে বিস্ময় তখনো কাটেনি।
আয়োজক দেশ ব্রাজিল ৭-১ গোলে হেরেছে জার্মানির কাছে। কী হবে এখন?
‘ব্রাজিল কি এবার তাদের ফুটবলের আগা-পাছ-তলা পরিবর্তন করবে?’ মার্ক চ্যাপম্যান জিজ্ঞেস করেছিলেন।
আমার জবাব ছিল, ‘আমি তাই মনে করি।’ কিন্তু সেই সঙ্গে আমার আশঙ্কা ছিল ১০ দিন পর শোকের ধাক্কা কাটলে, যা ছিল তাই-ই থেকে যাবে। এবং বাস্তবে আমার সেই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছিল।
বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরপরই সাবেক মিডফিল্ডার ডুঙ্গাকে নতুন করে কোচ হিসেবে নিয়োগ করা হলো। ২০০৬ সালে থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রাজিল দলের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে তার আর একটি মাত্র অভিজ্ঞতা ছিল ব্রাজিলের ক্লাব ইন্টারন্যাসিওনালের কয়েকমাসের কোচের দায়িত্ব। কিন্তু সেখানে তার সাফল্য কিছু ছিল না।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপের কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে ডুঙ্গার প্রধান বুলি ছিল ‘কীভাবে শিখতে হয়, আমি তা শিখেছি।’
খোল-নলচে পাল্টে ফেলার মতো সংস্কারক ছিলেন না ডুঙ্গা। তার নিয়োগ ছিল অনেকটা বাস্তবতাকে অস্বীকার করার শামিল।
ব্রাজিলিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ভাবটা ছিল এমন - আমাদের যদি ক্রমাগত আক্রমণ করা হয়, তা হলে আমরা ডুঙ্গার পেছনেই থাকব। ডুঙ্গারও ভাবটা ছিল যে, পুরো বিশ্ব তার পেছনে লেগেছে এবং সেও ছেড়ে কথা বলবে না, আগুনের জবাব আগুন দিয়েই দেবে।
দুই বছর পর যখন ২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের এক-তৃতীয়াংশ শেষ, ব্রাজিল তখন ৬ নম্বরে অর্থাৎ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে তাদের যাওয়া হবে না। ভয় ঢুকল যে প্রতিটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার রেকর্ড থেকে ছিটকে পড়তে পারে ব্রাজিল। চাপে পড়ে গেলেন ডুঙ্গা। তার ভরসা ছিল রিও অলিম্পিকস। যদি তিনি সেখানে দলকে সোনা জেতাতে পারেন, তা হলে হয়ত তার অবস্থান কিছুটা শক্ত হবে, কিছুটা সময় তিনি পাবেন।
হয়তো বা সেটা হতো। কিন্তু অলিম্পিকের ঠিক আগে কোপা আমেরিকার শততম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ টুর্নামেন্টের একটি বাড়তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
ডুঙ্গার ব্রাজিল সেখানে একুয়েডরের সঙ্গে ড্র করে এবং পেরুর কাছে হারে গ্রুপ পর্যায় থেকে ছিটকে যায়। সেই সঙ্গে কোপ পড়ে ডুঙ্গার ওপর। তার জায়গায় কোচ হিসেবে আসেন করিন্থিয়ানস্ ক্লাবের কোচ তিতে। ২০১৪ সালেও তিনিই ছিলেন ফেভারিট। দেরিতে হলেও তিনি চাকরিটা পেলেন। তার পর সবকিছুই ইতিহাস।
দলে কিছু অদল-বদল করা হলো। চীনা লীগ থেকে পলিনিওকে ডেকে আনা হলো। সমালোচনা হলেও পরে সিদ্ধান্ত সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে দুর্বলতা কাটাতে তরুণ গ্যাব্রিয়েল জেজুজকে নিয়ে ঝুঁকি নিলেন তিতে। সঙ্গে সঙ্গেই ফল পেলেন। মাত্র দু-তিনটি পরিবর্তন এনেই তিতে ভালো ফল পেতে শুরু করলেন।
বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই না করার যে হুমকি তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেল। তিতের ব্রাজিল ১০টি ম্যাচ জিতল, দুটো ড্র করল, ৩০টি গোল দিল, গোল খেল মাত্র তিনটি। তার পর ইউরোপিয়ান বিভিন্ন দলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচগুলোতেও সেই সাফল্যের ধারা অব্যাহত রইল।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠলো- কীভাবে একজন ব্যক্তি এই পার্থক্য তৈরি করতে পারলেন?
দুটো উত্তর - তিতের সন্দেহাতীত যোগ্যতা ছাড়াও তার পূর্বসূরি কয়েকজনের দুর্বলতা এবং সেই সঙ্গে ব্রাজিলের ফুটবলের দুর্দশার শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকা।
ব্রাজিলের ফুটবল অকস্মাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ তকমা নিয়ে জন্ম নেয়নি। একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই সুনাম এবং খ্যাতি অর্জিত হয়েছিল। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে তাদের যে প্রস্তুতি এবং কৌশল ছিল, তা অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর ছিল।
১৯৫৮ সালেই ব্রাজিল দলে বিরাট সংখ্যায় সাপোর্ট-স্টাফ ছিল - ডাক্তার, ডেন্টিস্ট, ফিজিও, এমনকি ক্রীড়া বিষয়ক একজন মনোবিজ্ঞানী।
ব্রাজিলের অন্যতম কিংবদন্তি মারিও জাগালোকে - যিনি ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ সালের দলে খেলোয়াড় ছিলেন এবং পরে ১৯৭০ এ ব্রাজিলের কোচ ছিলেন - যখন আমি বলেছিলাম যে ১৯৬২ সালে চিলির বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড একজন ডাক্তার ছাড়াই গিয়েছিল, শুনে চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল তার।
এ ছাড়া, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও হাঙ্গেরি থেকে আসা কোচদের ধ্যানধারণা নিজেদের কৌশলের সঙ্গে যোগ করে নতুন এক ফুটবল স্টাইল তৈরি করেছিল ব্রাজিল। চারজনের রক্ষণভাগের সূচনা করেছিল তারা। ১৯৫৮ সালে ব্রাজিল যখন রক্ষণভাগের নতুন সেই স্টাইল প্রবর্তন করলো, সেমিফাইনালের আগে তারা কোনো গোলই খায়নি। ১৯৭০ সালে এসে আরেক ধাপ এগিয়ে ব্রাজিল ফুটবলে প্রথমবারের মতো ৪-২-৩-১ পদ্ধতি চালু করেছিল। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে অসামান্য সাফল্যে ব্রাজিলের ফুটবলে আলস্য এবং অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস জেঁকে বসে। ব্রাজিলিয়ানরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ফুটবলে মেধা তাদের মজ্জাগত, চেষ্টার তেমন প্রয়োজন নেই। ফলে ফুটবলের যখন দ্রুত প্রসার হয়েছে , ব্রাজিল ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ স্তরে কোচ হিসেবে খুব কম ব্রাজিলিয়ানই এসেছে। যারা এসেছেন, তেমন সাফল্য তারা পাননি। পেপ গার্দিওলা যখন এক দশক আগে ফুটবলের স্টাইলে বিপ্লব ঘটান, ব্রাজিল সেই ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়ে। ব্রাজিলের ফুটবলে অনেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে শারীরিক শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রয়োগের কারণে পজেশন-ফুটবল সম্ভব নয়, একমাত্র উপায় হচ্ছে উইং দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে কাউন্টার-অ্যাটাক। কিন্তু ধ্যান-ধারণায় ব্রাজিল যে কতটা পেছনে পড়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ হয়ে যায় যখন ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে গার্দিওলার পাসিং সূত্র প্রয়োগ করে জার্মানি তাদের ৭ গোল দেয়। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের যে ব্যর্থতা, তিতে তার ব্যতিক্রম। তার সিভি বা বায়োডাটা দেখলে অবশ্য প্রথমে ব্যতিক্রমী তেমন কিছু চোখে পড়বে না। একটা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে কোচিং করিয়েছেন তিনি, অনেক জায়গা থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কখনই ইউরোপে কাজ করেননি। তার যুক্তি ছিল এই বয়সে দ্বিতীয় একটি ভাষা শেখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু যোগাযোগ এবং বোঝাপড়ার অসামান্য দক্ষতা রয়েছে তিতের। সেই সঙ্গে রয়েছে একটি তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু মন। তার মন্ত্র, ‘কীভাবে শিখতে হয়, আমি তা শিখেছি।’ এই শতকের গোঁড়ায় তিনি যখন নজর কাড়তে শুরু করেন, তিতের পছন্দ ছিল ৩-৫-২ ঘরানার ফুটবল। পরে ইন্টারন্যাসিওনাল ক্লাবে আর্জেন্টাইন মিড-ফিল্ডার অন্দ্রেস আলেহান্দ্রোর সঙ্গে কাজ করে ইউরোপীয় ফুটবল সম্পর্কে বিস্তর ধারণা পান তিনি। ইংলিশ ক্লাব পোর্টসমথে খেলার সুবাদে আলেহান্দ্রোই প্রথম তিতেকে ইউরোপিয়ান ৪-৪-২ ফুটবল বোঝানোর চেষ্টা করেন। তার পর ইউরোপে এসে দীর্ঘদিন ধরে দিনের পর দিন তিনি প্রথম সারির ক্লাবে কিছু ক্লাবের খেলা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। ইউরোপ থেকে পাওয়া জ্ঞান তিনি প্রয়োগ করেন করিন্থিয়ানস্ ক্লাবে। সঙ্গে সাথেই ফল পান। ইউরোপীয় কায়দার আঁটসাঁট রক্ষণভাগের কল্যাণে ২০১১-১২ সালে ব্রাজিলিয়ান লিগ এবং দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব শিরোপা জেতে করিন্থিয়ানস্। এর পর ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনালে তারা হারায় ইংলিশ ক্লাব চেলসিকে।
এর পর ইউরোপীয় শীর্ষ ক্লাবগুলোকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন তিতে। করিন্থিয়ানস্ ২০১৫ সালে আবারও ব্রাজিল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়। করিন্থিয়ানসের পর ইউরোপের শিক্ষা তিতে এখন প্রয়োগ করছেন ব্রাজিল জাতীয় দলে। ২০১৬ সালে নভেম্বরে আর্জেন্টিনাকে ৩-০ তে হারানোর পর আর্জেন্টাইন কোচ সেজার লুইজ মেনোট্টি ভূয়সী প্রশংসা করেন তিতের। ‘তিনি (তিতে) রক্ষণভাগকে ২০ মিটার সামনে নিয়ে গেছেন, ফলে পুরো টিম একসাথে খেলতে পারছে...এ যেন ১৯৭০-এর ব্রাজিল।’ ব্রাজিলে টিভি বিজ্ঞাপনে এখন হরদম তিতেকে দেখা যায়। যেখানে ডুঙ্গার ভাবমূর্তি ছিল একজন যোদ্ধার, তিতেকে দেখানো হয় একজন ধীর-স্থির জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হিসেবে যিনি চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। একজন সমালোচক তাকে সাপুড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সত্যিই তিতে এখন পর্যন্ত ব্রাজিলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচগুলোর টিভি রেটিং খুবই উঁচুতে ছিল। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত ব্রাজিলে এখন জাতীয় ফুটবল দল আশার একমাত্র আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই তিতে যদি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতেন, চোখ বুজে পার হয়ে যেতেন। অবশ্য এ নিয়ে রসিকতা করতেও রাজি নন তিনি। না চাইতেই, ব্রাজিলে তিতের এখন নেইমারের মতই তারকা-খ্যাতি। তবে আগামী সপ্তাহগুলোতে এই দুজনের সম্পর্ক কেমন থাকবে, অনেক কিছুই নির্ভর করছে তার ওপর। অবশ্য ২০১৪ সালের মতো বর্তমানের ব্রাজিল দলটি নেইমার নির্ভর নয়। এই দলে এখন বোঝাপড়া চোখে পড়ার মতো। নেইমার যখন জখমের চিকিৎসা করছিলেন, সে সময় তাকে ছাড়াই দল প্রীতি ম্যাচে জার্মানি এবং রাশিয়াকে তাদের মাঠেই হারিয়েছে। সন্দেহ নেই নেইমারের প্রতিভা দলের জন্য বিরাট শক্তি। কিন্তু এর দুটো সম্ভাব্য সমস্যাও রয়েছে। এক. নিজের ব্যক্তিগত খ্যাতির জন্য নেইমার সচেষ্ট হতে পারে যেটা দলের স্বার্থের পক্ষে নাও যেতে পারে, যেটা চোখে পড়েছে নভেম্বরে লন্ডনের ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডের সাথে একটি প্রীতি ম্যাচে। অন্য সমস্যাটি হলো- চাপের মুখে নেইমার মাঠে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিনা। নেইমারকে নিয়ে এই দুটো সম্ভাব্য সমস্যার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে তিতেকে। এ ছাড়া, নেইমারের মধ্যে ফাউলে জড়ানোর প্রবণতা রয়েছে। কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ১৪টি ম্যাচে ছয়টি হলুদ কার্ড পেয়েছে সে। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে একইরকম ঘটলে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো ম্যাচ মিস করার ঝুঁকি থাকবে। ব্রাজিল চায় নেইমার টুর্নামেন্টের শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচ যেন খেলতে পারে। তাহলেই ষষ্ঠবারের মতো এবং ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবার ইউরোপে তাদের বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
খবর বিবিসি বাংলা এবিএন/সাদিক/জসিম
এ ছাড়া, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও হাঙ্গেরি থেকে আসা কোচদের ধ্যানধারণা নিজেদের কৌশলের সঙ্গে যোগ করে নতুন এক ফুটবল স্টাইল তৈরি করেছিল ব্রাজিল। চারজনের রক্ষণভাগের সূচনা করেছিল তারা। ১৯৫৮ সালে ব্রাজিল যখন রক্ষণভাগের নতুন সেই স্টাইল প্রবর্তন করলো, সেমিফাইনালের আগে তারা কোনো গোলই খায়নি। ১৯৭০ সালে এসে আরেক ধাপ এগিয়ে ব্রাজিল ফুটবলে প্রথমবারের মতো ৪-২-৩-১ পদ্ধতি চালু করেছিল। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে অসামান্য সাফল্যে ব্রাজিলের ফুটবলে আলস্য এবং অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস জেঁকে বসে। ব্রাজিলিয়ানরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ফুটবলে মেধা তাদের মজ্জাগত, চেষ্টার তেমন প্রয়োজন নেই। ফলে ফুটবলের যখন দ্রুত প্রসার হয়েছে , ব্রাজিল ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ স্তরে কোচ হিসেবে খুব কম ব্রাজিলিয়ানই এসেছে। যারা এসেছেন, তেমন সাফল্য তারা পাননি। পেপ গার্দিওলা যখন এক দশক আগে ফুটবলের স্টাইলে বিপ্লব ঘটান, ব্রাজিল সেই ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়ে। ব্রাজিলের ফুটবলে অনেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে শারীরিক শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রয়োগের কারণে পজেশন-ফুটবল সম্ভব নয়, একমাত্র উপায় হচ্ছে উইং দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে কাউন্টার-অ্যাটাক। কিন্তু ধ্যান-ধারণায় ব্রাজিল যে কতটা পেছনে পড়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ হয়ে যায় যখন ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে গার্দিওলার পাসিং সূত্র প্রয়োগ করে জার্মানি তাদের ৭ গোল দেয়। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের যে ব্যর্থতা, তিতে তার ব্যতিক্রম। তার সিভি বা বায়োডাটা দেখলে অবশ্য প্রথমে ব্যতিক্রমী তেমন কিছু চোখে পড়বে না। একটা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে কোচিং করিয়েছেন তিনি, অনেক জায়গা থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কখনই ইউরোপে কাজ করেননি। তার যুক্তি ছিল এই বয়সে দ্বিতীয় একটি ভাষা শেখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু যোগাযোগ এবং বোঝাপড়ার অসামান্য দক্ষতা রয়েছে তিতের। সেই সঙ্গে রয়েছে একটি তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু মন। তার মন্ত্র, ‘কীভাবে শিখতে হয়, আমি তা শিখেছি।’ এই শতকের গোঁড়ায় তিনি যখন নজর কাড়তে শুরু করেন, তিতের পছন্দ ছিল ৩-৫-২ ঘরানার ফুটবল। পরে ইন্টারন্যাসিওনাল ক্লাবে আর্জেন্টাইন মিড-ফিল্ডার অন্দ্রেস আলেহান্দ্রোর সঙ্গে কাজ করে ইউরোপীয় ফুটবল সম্পর্কে বিস্তর ধারণা পান তিনি। ইংলিশ ক্লাব পোর্টসমথে খেলার সুবাদে আলেহান্দ্রোই প্রথম তিতেকে ইউরোপিয়ান ৪-৪-২ ফুটবল বোঝানোর চেষ্টা করেন। তার পর ইউরোপে এসে দীর্ঘদিন ধরে দিনের পর দিন তিনি প্রথম সারির ক্লাবে কিছু ক্লাবের খেলা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। ইউরোপ থেকে পাওয়া জ্ঞান তিনি প্রয়োগ করেন করিন্থিয়ানস্ ক্লাবে। সঙ্গে সাথেই ফল পান। ইউরোপীয় কায়দার আঁটসাঁট রক্ষণভাগের কল্যাণে ২০১১-১২ সালে ব্রাজিলিয়ান লিগ এবং দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব শিরোপা জেতে করিন্থিয়ানস্। এর পর ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের ফাইনালে তারা হারায় ইংলিশ ক্লাব চেলসিকে।
এর পর ইউরোপীয় শীর্ষ ক্লাবগুলোকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন তিতে। করিন্থিয়ানস্ ২০১৫ সালে আবারও ব্রাজিল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়। করিন্থিয়ানসের পর ইউরোপের শিক্ষা তিতে এখন প্রয়োগ করছেন ব্রাজিল জাতীয় দলে। ২০১৬ সালে নভেম্বরে আর্জেন্টিনাকে ৩-০ তে হারানোর পর আর্জেন্টাইন কোচ সেজার লুইজ মেনোট্টি ভূয়সী প্রশংসা করেন তিতের। ‘তিনি (তিতে) রক্ষণভাগকে ২০ মিটার সামনে নিয়ে গেছেন, ফলে পুরো টিম একসাথে খেলতে পারছে...এ যেন ১৯৭০-এর ব্রাজিল।’ ব্রাজিলে টিভি বিজ্ঞাপনে এখন হরদম তিতেকে দেখা যায়। যেখানে ডুঙ্গার ভাবমূর্তি ছিল একজন যোদ্ধার, তিতেকে দেখানো হয় একজন ধীর-স্থির জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হিসেবে যিনি চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। একজন সমালোচক তাকে সাপুড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সত্যিই তিতে এখন পর্যন্ত ব্রাজিলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন। বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচগুলোর টিভি রেটিং খুবই উঁচুতে ছিল। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত ব্রাজিলে এখন জাতীয় ফুটবল দল আশার একমাত্র আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই তিতে যদি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতেন, চোখ বুজে পার হয়ে যেতেন। অবশ্য এ নিয়ে রসিকতা করতেও রাজি নন তিনি। না চাইতেই, ব্রাজিলে তিতের এখন নেইমারের মতই তারকা-খ্যাতি। তবে আগামী সপ্তাহগুলোতে এই দুজনের সম্পর্ক কেমন থাকবে, অনেক কিছুই নির্ভর করছে তার ওপর। অবশ্য ২০১৪ সালের মতো বর্তমানের ব্রাজিল দলটি নেইমার নির্ভর নয়। এই দলে এখন বোঝাপড়া চোখে পড়ার মতো। নেইমার যখন জখমের চিকিৎসা করছিলেন, সে সময় তাকে ছাড়াই দল প্রীতি ম্যাচে জার্মানি এবং রাশিয়াকে তাদের মাঠেই হারিয়েছে। সন্দেহ নেই নেইমারের প্রতিভা দলের জন্য বিরাট শক্তি। কিন্তু এর দুটো সম্ভাব্য সমস্যাও রয়েছে। এক. নিজের ব্যক্তিগত খ্যাতির জন্য নেইমার সচেষ্ট হতে পারে যেটা দলের স্বার্থের পক্ষে নাও যেতে পারে, যেটা চোখে পড়েছে নভেম্বরে লন্ডনের ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডের সাথে একটি প্রীতি ম্যাচে। অন্য সমস্যাটি হলো- চাপের মুখে নেইমার মাঠে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিনা। নেইমারকে নিয়ে এই দুটো সম্ভাব্য সমস্যার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে তিতেকে। এ ছাড়া, নেইমারের মধ্যে ফাউলে জড়ানোর প্রবণতা রয়েছে। কোয়ালিফাইং রাউন্ডের ১৪টি ম্যাচে ছয়টি হলুদ কার্ড পেয়েছে সে। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে একইরকম ঘটলে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো ম্যাচ মিস করার ঝুঁকি থাকবে। ব্রাজিল চায় নেইমার টুর্নামেন্টের শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচ যেন খেলতে পারে। তাহলেই ষষ্ঠবারের মতো এবং ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবার ইউরোপে তাদের বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
খবর বিবিসি বাংলা এবিএন/সাদিক/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ