কীভাবে ১৯৯৬-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছিল যুদ্ধ বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০১৯, ২১:৪৫
১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জিতে ক্রিকেট দুনিয়ায় বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল শ্রীলঙ্কা। বিবিসির কাছে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন দলের তৎকালীন কোচ ডেভ হোয়াটমোর এবং ধারাভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেল।
১৯৯৬ সালের ১৭ই মার্চ লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ক্রিকেটের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল শ্রীলঙ্কা।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে শ্রীলঙ্কাকে কেউই ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। কিন্তু সেই বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট চিরতরে বদলে যায়।
জেতার পর উল্লাসে ফেটে পড়েছিল পুরো শ্রীলঙ্কা। রাতে রাজধানী কলম্বো এবং অন্যান্য শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয় উল্লাস করেছিল।
শ্রীলঙ্কায় তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল। বিদ্রোহী তামিল টাইগারদের হামলার ভয়ে রাত নয়টার মধ্যে মানুষ ঘরের বাইরে তেমন থাকতো না। কিন্তু সেই রাতে শ্রীলঙ্কানরা সেই ভয়-শঙ্কা অতিক্রম করেছিল।
ম্যাচর পর সেই রাতেই লাহোরে তার হোটেল রুমে কোচ ডেভ হোয়াটমোর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে একটি ব্যক্তিগত অভিনন্দন বার্তা পেলেন।। প্রেসিডেন্ট লেখেন - দলের এ সাফল্যে দেশ যারপরনাই গর্বিত।
দলকে দেশে ফিরে আসতে বলেন প্রেসিডেন্ট।
"রাত দুটোর দিকে সবে আমি দ্বিতীয় হুইস্কির গ্লাসটি নিয়ে বসেছি, হঠাৎ বলা হলো হলো, ব্যাগ গোছাও, ফিরতে হবে," স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিবিসিকে বলেন ডেভ হোয়াটমোর বলেন।
কলম্বোতে যখন দল নামলো, সবাই ক্লান্ত। কিন্তু বিমান থেকে নেমে তারা যা দেখলো - তাতে ক্লান্তি ঘুচে গিয়েছিল।
"এয়ারপোর্টের বাইরে হাজার হাজার মানুষ। বিমানবন্দর থেকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি। কিন্তু আমাদের গাড়ি এগুতে পারছিল না। লাখ লাখ মানুষ আমাদের অভিনন্দন জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এমন দৃশ্য আর আবেগ আমি আগে দেখিনি। "
১৯৯৬ বিশ্বকাপ নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে শ্রীলঙ্কাও ঐ টুর্নামেন্টের যৌথ আয়োজক ছিল। কিন্তু কলকাতায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরপরই অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ জানিয়ে দেয়, নিরাপত্তার ভয়ে তারা শ্রীলঙ্কায় দল পাঠাবে না।
"দারুণ ঝকমকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো।, আমরা দেশে ফিরে গেলাম। গিয়েই খবর শুনে মাথায় বাজ পড়লো। অন্যান্য দল তাদের খেলা শুরু করলো, আর হোটেলে বসে টিভিতে আমরা তা দেখছিলাম।"
শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অজুর্না রানাতুঙ্গার প্রতিক্রিয়া ছিল ক্রদ্ধ। তা নিয়ে বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার এবং ধারাভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেল : "অজুর্না সংবাদ মাধ্যমের কাছে বললো, আমরা ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে চাই।"
" অস্ট্রেলিয়া তখন খুবই শক্তিধর দল। কোনো দল এসে বলবে 'ঠিক আছে খেলতে আসো, দেখা যাবে কী হয়' - অস্ট্রেলিয়াকে এ ধরণের কথা বলার মতো দল তখন কমই ছিল। কিন্তু অর্জুনা সেই সাহস সেদিন দেখিয়েছিল।"
বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ায় সফরে গিয়ে বেশ চাপে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। তাদের বিরুদ্ধে বল ট্যাম্পারিংয়ের অভিযোগ ওঠে। একজন আম্পায়ার নো-বল ডাকার পর মুরলীধরনের বোলিং অ্যাকশন বৈধ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
ফলে এমনিতেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপারে বিরক্ত ছিলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা। তারপর শ্রীলঙ্কায় না যাওয়ার কথা বলায়, আরো খেপে গিয়েছিলেন তিনি।
তবে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া যে শুধুই ফাঁকা আওয়াজ ছিল, তা নয়। শ্রীলঙ্কা দলে তখন বেশ কজন প্রতিভাধর ক্রিকেটার ছিলেন। অভিজ্ঞতারও কমতি ছিলনা। তারপর ডেভ হোয়াটমোর এসে দলে শৃঙ্খলা, পেশাদারিত্ব, ফিটনেসের দিকে জোর দেন। প্রতিটি ম্যাচের আগে এবং পরে তা নিয়ে বিস্তর বিশ্লেষণ শুরু হয়।
ডেভ হোয়াটমোর বলেন, "ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ দল নিয়ে চুল-চেরা বিশ্লেষণ করা হতো। পুরনো ভিএইচএস টেপে রেকর্ড করা ভিডিও ফুটেজ চালিয়ে ৪
প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের শক্তি এবং দুর্বলতা নিয়ে কথা হতো। প্রতিটি প্রতিপক্ষ দল নিয়েই আমরা এটা করতাম।"
জয়াসুরিয়া এবং কালুহিতরানার ওপেনিং জুটির মারকুটে ব্যাটিং চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল তখন।
ইয়ান চ্যাপেল বলেছিলেন, "এই দুজন যা করছিল তা বিস্ময়কর। আমার মনে আছে দিল্লিতে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচে চার ওভারের মধ্যে তারা ৫০ রান করে ফেলেছিল। তখন প্রথমে ব্যাট করে ২৪০ বা ২৫০ রানের টার্গেটও অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু শুরুতে দ্রুত রানের কারণে শ্রীলঙ্কা হঠাৎ করে ৩০০ রানের টার্গেট দেওয়া শুরু করলো।"
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে নাস্তানাবুদ করেছিল শ্রীলঙ্কা। তারপর ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ হলো অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচের আগে শেন ওয়ার্নের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ইয়ান চ্যাপেল। অন্যদিকে রবি শাস্ত্রী সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অজুর্না রানাতুঙ্গার।
ইয়ান চ্যাপেল বলছিলেন, "দল প্রাকটিসে যাওয়ার আগেই রবি অর্জুনার সাথে কথা বলতে গেলেন। আমাকে সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দলের ট্রেনিংয়ের পর। শেন ওয়ার্ন এসে বললো, 'মোটা লোকটি আমার সম্পর্কে কী বলছে'। আমি বুঝতে পারলাম, শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া। পরে আমি শুনলাম অর্জুনা তার সাক্ষাৎকারে বলেছিল, 'শেন ওয়ার্নকে নিয়ে মিডিয়ায় একটা মিথ তৈরি হয়েছে, সে আমাদের জন্য কোনো সমস্যাই নয়।' আমি বুঝতে পারছিলাম ফাইনাল ম্যাচে মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে শ্রীলঙ্কা এগিয়ে।"
ডেভ হোয়াটমোর তার দলকে বলেছিলেন - 'মনোযোগ ধরে রাখো, নিয়ন্ত্রণ হারিও না।'
"যত বড় ম্যাচ, যত বেশি চাপের ম্যাচ, মাঠে তত বেশি চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হয়। ফলে আমার পক্ষ থেকে কোনো রকম চাপ ছিলনা। আমি তাদের একবারও বলিনি যে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। আমি শুধু বলেছিলাম মাঠে গিয়ে সাধ্যমত ভালো খেলার চেষ্টা করো।"
টসে জিতে শ্রীলঙ্কা ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। অরবিন্দ ডি সিলভা অস্ট্রেলিয়ার রানের চাকা আটকে রাখেন। ৪২ রান দিয়ে তিনটি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। তারপর ব্যাট হাতে যে সেঞ্চুরি তিনি করেন, তা ছিল দেখার মতো।
অরবিন্দ ডি সিলভাকে নিয়ে বলছিলেন ডেভ হোয়াটমোর, "চার নম্বরে নামতেন অরবিন্দ। মাঝের ওভারে রানের জন্য তার ওপর ভরসা করা হতো। ফাইনালে যখন দুই ওপেনার তেমন সুবিধা করতে পারলো না তখন তার ওপর ভরসা আরো বেড়ে যায়। অসামান্য একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন অরবিন্দ। ছোটোখাটো হলেও, ভয়ডর ছিলনা। যারা তাকে চিনতেন তারা জানেন, তার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত কত শক্ত মনের ক্রিকেটার ছিলেন তিনি।"
"রান তাড়া করতে করতে একসময়ে পরিষ্কার হয়ে যায় আমরাই জিতবো। একটা সময় পর আমার ভেতর আর কোনো চাপই কাজ করছিলো না। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমরাই জিতবো। শ্রীলঙ্কা দলকে নিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা আমরা কয়েকবার হয়েছে।"
যে রানটি করে শ্রীলঙ্কা অস্ট্রেলিয়ার ২৪১ রানের টার্গেট পেরিয়েছিল, সেটি করেছিলেন অধিনায়ক রানাতুঙ্গা। তবে ঐতিহাসিক সেই জয়ের নায়ক ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার জন্য বিশ্বকাপ ক্রিকেট জেতা ছিল বিশাল এক আনন্দ, স্বস্তি আর গর্বের অধ্যায়। বিবিসি
এবিএন/মমিন/জসিম