আজকের শিরোনাম :

রোজারিওর ‘ছোট্ট জাদুকর’ মারাকানায় যত প্রশ্নের উত্তর দিলেন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২১, ১৪:৫১

মারাকানায় যখন শেষ বাঁশি বাজে, মাটিতে বসে পড়েন লিওনেল মেসি, আনন্দের আতিশয্যে। বেশি সময় বসতে পারেননি, সতীর্থরা তাকে তুলে নিয়ে যান।

মেসিকে হাওয়ায় ভাসিয়ে উল্লাসে মাতেন, রবার্তো ডি পল, ল সেলসোরা।

লিওনেল মেসি, সার্জিও অ্যাগুয়েরো, অ্যানহেল ডি মারিয়া- সবাই তাদের আরাধ্য ট্রফি নিয়ে করলেন উদযাপন।

কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল মেসি তার মুঠোফোনে কাকে যেন দেখাচ্ছেন, তার গলায় ঝোলানো সদ্য জেতা সোনালি পদকটি।

এই সোনালি মেডেলের মূল্য তিনি জানেন, এর আগে দ্বিতীয় সেরা হয়ে দুবার কোপা আমেরিকার মঞ্চ থেকে রুপালি মেডেল পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন কান্নায়।

আর্জেন্টিনার উদযাপন, লিওনেল মেসির উদযাপন এবং চেহারার অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিল কতটা জরুরি ছিল একটা শিরোপা।

বাংলাদেশের ঢাকার রাস্তায় ‘মেসি’ নামের রিকশাচালক থেকে শুরু করে ‘শিরোপা না জিতলে বিয়ে করবো না’ বলা সমর্থক, ’৮৬-তে ম্যারাডোনার হাতে বিশ্বকাপ শিরোপা দেখা টিএসসির চা বিক্রেতা- সবার আনন্দ এক হয়ে গেছে মারাকানায় মেসির হাতে ওঠা শিরোপায়।

তাও আবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে, ব্রাজিলেরই মাঠে।

ব্রাজিলের বিখ্যাত ফুটবল ভেন্যু মারাকানায় আরও একবার ফাইনাল খেলেছেন আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, সেবার ট্রফির দিকে ফিরে তাকাননি, দ্বিতীয় সেরা দলের মেডেল গলায় ঝুলিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন। সেই ছবি এখনো আর্জেন্টিনার ফুটবল ভক্তদের জন্য কষ্টের। এবারে আর মারাকানা মেসি খালি হাতে ফেরেননি।

আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকার ট্রফি, সাথে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার এবং সেরা গোলদাতার পুরস্কার- পুরো কোপা আমেরিকাই নিজের করে নিয়েছেন লিওনেল মেসি।

এই প্রাপ্তি এত সহজে আসেনি, এর আগে দুবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে খেলেছেন লিও। দুবারই হেরে গেছেন চিলির কাছে।

একবার তো পেনাল্টি শুটআউট পর্যন্ত ম্যাচ গড়ানোর পর লিওনেল মেসির শট চলে যায় পোস্টের ওপর দিয়ে। রাগে-অভিমানে অবসরের ঘোষণা দিয়ে বসেন লিওনেল মেসি। কিন্তু তিনি ফিরেও আসেন। ফিরে এসে আবারও বিশ্বকাপ খেলেন আর্জেন্টিনার হয়ে, আবারও ব্যর্থ হন, দ্বিতীয় রাউন্ডেই বাদ পড়েছিলেন।

এর পর আরও একটা কোপা আমেরিকা, নেইমারকে ছাড়াই ব্রাজিল সেবার লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল।

২০১৫ সালের পর ইউরোপেও ট্রফি পাননি লিওনেল মেসি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা নেই, নেই আন্তর্জাতিক শিরোপাও। এবারও তরুণ কিলিয়ান এমবাপের নৈপুণ্যে বাদ পড়ে যায় বার্সেলোনা।

লিগে অবস্থান তৃতীয় এমন অবস্থায় কোপা আমেরিকায় আসে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে লিওনেল মেসি
অনেক ফুটবল ভক্ত, এমনকি আর্জেন্টিনার ভক্তদেরও অভিযোগ মতোই ছিল মেসির প্রতি, যে বার্সেলোনার মেসি আর আর্জেন্টিনার মেসি একরকম খেলেন না।

লিওনেল মেসি বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জিতেও মন ভরাতে পারেননি। কারণ ভক্তদের চাই ট্রফি, আনন্দের উপলক্ষ্য।

এবার দানে দানে চার দানে এসে কাপ পেলো লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা।

একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল, দুটো কোপা আমেরিকা ফাইনাল হেরে যান মেসি।

লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলছেন ১৫ বছর হয়ে গেছে।

এরই মধ্যে খেলে ফেলেছেন চারটি বিশ্বকাপ, ছয়টি কোপা আমেরিকা। বড় এই দুটো টুর্নামেন্টে খেলে ফেলেছেন ৫৩টি ম্যাচ।

লিওনেল মেসি কিংবদন্তি উপাধি পেয়েছেন আগেই, কিন্তু দশবার লা লিগা এবং চারবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী মেসির আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রভাব না রাখায় প্রশ্ন থেমে থাকেনি।

অনেকেই আবার এটাও বলেন, লিওনেল মেসি কী জিতেছে আর কী জেতেননি তাতে কিছু আসে যায় না, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে অলংকৃত ফুটবলারদের একজন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

যাদের সন্দেহ ছিল, এই কোপা আমেরিকা তাদের মুখ বন্ধ করে দেবে এটুকু বলাই যায়।

যদিও লিওনেল মেসির ফাইনালে তেমন প্রভাব ছিল না। এমনকি ফাইনালে প্রায় ফাঁকা গোলপোস্টের সামনে একবার বল পেয়েও শট নিতে ব্যর্থ হন। তবুও ফাইনালে তোলা পর্যন্ত পাঁচটা গোল হয়েছে লিওনেল মেসির প্রত্যক্ষ সহায়তায়, চারটা গোল তিনি নিজে করেছেন, যার মধ্যে দুটি ফ্রি কিক থেকেই।

কোপা আমেরিকার গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট তারই স্বীকৃতি।

লিওনেল মেসির যত স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি
>> বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি' অর জয়ী ফুটবলার- ছয়বার
>> স্প্যানিশ লিগ ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা- ৪৭৪টি
>> এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা- ৬৪৩টি, বার্সেলোনার হয়ে
>> বার্সেলোনার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শিরোপা- ৩৫টি
>> আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি গোলদাতা- ৭৫টি

আর্জেন্টিনার কোপা জয় যেভাবে
জুন মাসটাও খুব একটা ভালো যায়নি আর্জেন্টিনার। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ম্যাচে চিলির সাথে ১-১ গোলে ড্র, কলম্বিয়ার সাথে ২-২ গোলে ড্র, কোপা আমেরিকাও শুরু হয় চিলির সাথে ১-১ গোলে ড্র দিয়েই, লিওনেল মেসির গোল দিয়েই।

এর পর গুইদো রদ্রিগেজের করা একমাত্র গোলে উরুগুয়েকে হারায় আর্জেন্টিনা।

এই ম্যাচের পর বিশ্লেষকদের মধ্যে দেখা যায় সমালোচনার সুর। এভাবে রক্ষণভাগে গুরুত্ব দিয়ে খেলা আর্জেন্টিনার স্বভাব কি না সেই প্রশ্নও ওঠে।

আর্জেন্টিনা আবারও একইভাবে প্যারাগুয়ের সাথেও ১-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা নিশ্চিত করে লিওনেল মেসির দল বলিভিয়ার জালে গোলবন্যায় ভাসান, চারটি গোল করে আর্জেন্টিনা, যার মধ্যে দুটি লিওনেল মেসির।

কোয়ার্টার ফাইনালেও দাপুটে জয় পায় আর্জেন্টিনা, শেষ মুহূর্তে মেসির ফ্রি কিক গোলসহ মোট তিনটি গোল দেয় ইকুয়েডরের জালে।

এর পর সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার ফাইনাল নিশ্চিত, এবারে আর লিওনেল মেসি পা হড়কাননি।

বাঁ পায়ের জোড়ালো শট দিয়ে পেনাল্টিতে গোল দেন তিনি।

যেই রক্ষণশীল খেলার সমালোচনা হচ্ছিল আর্জেন্টিনাকে শেষ পর্যন্ত ফাইনালে জেতালো সেই রক্ষণভাগই।

পুরো আসরে বদলি হিসেবে নামা ডি মারিয়া ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে শুরুর একাদশে। তিনিই খেললেন চোখ ধাঁধানো খেলা।

রবার্তো ডি পলের লং বল পায়ে নামিয়ে আলতো টোকায় ব্রাজিলের গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে জালে জড়ান।

পুরো দল একত্র হয়ে যেন জয়ের উৎসব অগ্রীম সেরে নেয় তখনই।

এরপর বাকি কাজ সারেন ডিফেন্ডাররা, রোমেরো, অ্যাকুনিয়ারা একের পর এক ব্রাজিলের আক্রমণ ঠেকিয়ে দেন।

গোলকিপার অ্যামিলিয়ানো মার্টিনেজও লক্ষ্যে থাকা দুটি শটই ঠেকান।

ব্রাজিল পায়ে বল রাখে ৫৯ শতাংশ সময়, কিন্তু ফুটবল তো গোলের খেলা, সেই গোলের দেখা আর পাওয়া হয়নি নেইমারদের।

লিওনেল মেসি জিতে নিয়েছেন প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা, তবে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হয়নি ভক্তদের, ছোটবেলা থেকে যে ক্লাবে তিনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তী, সেই বার্সেলোনায় কি তিনি থাকছেন?

আগামী বছরই কাতারে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ, সেখানেও কি নেতৃত্ব দেবেন মেসিই? ৩৫ বছর বয়সে? আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ শিরোপার আক্ষেপটা তো কোপার থেকেও পুরনো। সেই ১৯৮৬ সালের পর আর জেতা হয়নি।

ম্যারাডোনার জুতায় পা রাখতে পারবেন লিওনেল মেসি? সময়ের সাথে এসব প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যাবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ