আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

প্রথম শনাক্তের ৬ মাস পর চিকিৎসা সক্ষমতা এখন যে পর্যায়ে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:২৪

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন মার্চের ৮ তারিখে, সে হিসাবে আজ ৬ মাস পূর্ণ হচ্ছে। গত ছয় মাসে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলার কাজে সরকার কতটা এগিয়েছে তা নিয়ে ভিন্নমত আছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন সংক্রমণের গতি কমানো, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো ও রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করা যায়নি।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবর দাবি করা হয়েছে, মহামারি মোকাবেলায় প্রতিবেশী অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো।

সংক্রমণের গতি কি এখনো উর্ধমুখী, না কমেছে?
বাংলাদেশে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন তিন লাখ ২৭ হাজার ৩৫৯ জন মানুষ। এর মানে হচ্ছে মার্চের ৮ তারিখ থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৭৮৮ জনের বেশি মানুষ শনাক্ত হয়েছেন। মারা গেছেন সাড়ে চার হাজারের বেশি মানুষ।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হবার পর সংক্রমণের হার ‘পিকে’ বা শীর্ষে পৌঁছাতে আড়াই থেকে তিনমাস সময় লাগতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশে শুরুতে বলা হয়েছিল এপ্রিলে সংক্রমণের পিক দেখা যাবে, পরে বলা হয় সেটি হবে মে মাসে। কিন্তু জুন এবং জুলাই মাসেও সংক্রমণ বাড়তে থাকে।

এর পর কখন বাংলাদেশ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি শীর্ষ অবস্থানে অর্থাৎ পিকে উঠেছে, সে বিষয়ে কোন সরকারি ঘোষণা দেখা যায়নি।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকার দাবি করছে বাংলাদেশে সংক্রমণের হার এখন নিম্নগামী। যদিও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন সংক্রমণের গতি নিম্নমুখী না হলেও এখন ‘ফ্ল্যাট কার্ভে’ এসেছে।

‘জুলাইয়ের মাঝামাঝি সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি ছিল, এরপর সেটা ক্রমে একটু একটু করে কমে। কেউ কেউ বলেন এখন হার নিম্নমুখী, আমি এখনো নিম্নমুখী বলবো না। কিন্তু বলা যায় সেটা এখন একটি 'ফ্ল্যাট কার্ভে' রয়েছে।’

এই পরিস্থিতি ধরে রাখার জন্য কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

নমুনা পরীক্ষার হার নিয়ে প্রশ্ন
শুরুতে বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষার হার খুবই অল্প ছিল। প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের নমুনা করানোর অবস্থায় যেতে সময় লাগে দুই মাসের বেশি। কিন্তু জুন মাস নাগাদ পরীক্ষার সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশিতে উত্তীর্ণ হয়। এর পর ক্রমে সে সংখ্যা কমতে থাকে। কিন্তু অগাস্ট মাস নাগাদ সরকারি হিসাবেই দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষার হার জুনের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ কমে গেছে।

তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নমুনা পরীক্ষা করাতে সরকারের নির্ধারিত ফি এবং মানুষের মধ্যে কোভিড ১৯ নিয়ে উদ্বেগ কমে যাবার কারণে পরীক্ষার হার কমছে।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা মনে করেন, নমুনা পরীক্ষার প্রক্রিয়ার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার ফলেই কমে যাচ্ছে পরীক্ষার হার।

‘নমুনা পরীক্ষা না করেই ভুয়া ফলাফল প্রকাশের যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, তার ফলে এখন পরীক্ষার ওপরই মানুষের মধ্যে এক ধরণের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে হাসপাতালে ভর্তি হবার ক্ষেত্রেও, কারণ হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার ফলে মানুষ এখন হাসপাতালে যেতে চাইছে না।’

অধ্যাপক সুলতানা মনে করেন, মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে কঠোরভাবে পরিস্থিতি মনিটরিং করতে হবে।

চিকিৎসা সক্ষমতা কি বাড়ল?
যদিও সরকার মনে করে মহামারি মোকাবেলার কাজে রোগী শনাক্ত এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে বাংলাদেশ। শুরুর দিকে চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি এবং নতুন ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল।

কিন্তু মহামারি শুরু হবার পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি, ডাক্তার ও টেকনিশিয়ানের অপ্রতুলতা এবং সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের বিষয় সামনে আসে। গত ছয় মাসে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংখ্যা সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ক্রমে বেড়েছে। 

এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং এ বলা হয়েছিল দেশে পরিপূর্ণ আইসিইউ ইউনিট রয়েছে মাত্র ১১২টি। এখানে পরিপূর্ণ আইসিইউ শয্যা বলতে একটি পূর্ণাঙ্গ নিবির পর্যবেক্ষণ ইউনিটকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে বিশেষ ধরণের শয্যা, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ভেন্টিলেটর, টিউব, পাম্প, হার্টরেট, রক্তচাপসহ অন্যান্য শারীরিক পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক চিত্র পাবার মনিটরসহ নানা আধুনিক মেডিকেল সরঞ্জাম থাকে।

সরকারি হিসাবে সে সংখ্যা ৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫০টিতে।

জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলছেন, জরুরি চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদির সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে।

‘সমস্যা একে একে সমাধান হবে, এই মূহুর্তে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যাও বেড়েছে, অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের সংখ্যাও বাড়ছে। একমাত্র হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা প্রায় ছিলই না, এর সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে হবে। সরকার এখন একটি বড় সংখ্যক হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ক্রয় প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, শীঘ্রই চলে আসলে এর অভাব অনেকটাই দূর হবে।’

তবে, চিকিৎসা ও সুরক্ষা সরঞ্জামের সংখ্যা ক্রমে বাড়লেও জুলাই মাস থেকেই মানুষের মধ্যে সচেতনতা কমে গেছে এমন একটি অভিযোগ শোনা যায়।

এছাড়া গত ছয় মাসেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে মানুষের অসচেতনতাকেই দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর পেছনে একটি বড় কারণ বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমিত হলে মানুষের মধ্যে মৃদু উপসর্গ দেখা দেবার হারই বেশি।

যে কারণে কোভিড ১৯ আক্রান্ত হওয়া নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা কমে গেছে বলে মনে করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘মহামারি নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলার জন্য সরকারকে যেসব পরামর্শ আমরা দিয়েছিলাম, তার ৬০-৭০ শতাংশ সরকার শুনেছে। কিন্তু যেমন কোরবানির হাট ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে অনুমতি না দেবার পরামর্শ দিয়েছিলাম আমরা, সেটা শোনেনি।’

‘আমরা বুঝি যে বাংলাদেশের মত একটি দেশে অর্থনীতি দীর্ঘদিন বন্ধ রাখা সম্ভব নয়, কিন্তু ঝুঁকি বেড়ে যায় এমন কিছু কাজ থেকে বিরত থাকাই দরকার। কিন্তু এখন যে অবস্থায় আছে পরিস্থিতি, তাতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা গেলে ঝুঁকিটা আস্তে আস্তে কমবে।’

তবে ঠিক কতদিন পর সংক্রমণ কমে আসবে এমন কোন সময়সীমা তিনি বলেননি।

সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার মার্চের শেষ দিক থেকে টানা ৬৬দিন সাধারণ ছুটি নামে কার্যত লকডাউন দিয়েছিল। এর ফলে সংক্রমণ অনেকটা কমানো গেছে বলে অনেকে মনে করেন।

এবিএন/সাদিক/জসিম 

এই বিভাগের আরো সংবাদ