আজকের শিরোনাম :

সাবান না স্যানিটাইজার- করোনাভাইরাস মারতে কোনটা ভালো?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:২২

করোনাভাইরাস মহামারি আকারে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর লকডাউনে আমরা প্রতিনিয়ত শুনেছি, মাস্ক পরুন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। কিন্তু প্রথম দিকে সবচেয়ে জোর দেয়া হয়েছিল কোভিড জীবাণু নিধনে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ওপর। আমরা কি সে পরামর্শের কথা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি?

হাত ধোয়াটা মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। হাত নোংরা হলে আমরা হাত ধুই। প্রাত্যহিক জীবনে অনেক সময় অভ্যাসের বশে হাত ধুই। কিন্তু গত ছয় মাসে হাত ধোয়া আমাদের জীবনে মরা-বাঁচার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যেসব অস্ত্র নিয়ে আমরা লড়তে নেমেছিলাম, যেমন মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, নিজেকে আলাদা রাখা বা সেলফ আইসোলেশন এসবের ভিড়ে যে সহজ অস্ত্রটির কথা সহজেই আমরা ভুলে যেতে বসেছি সেটি হলো- হাত ধোয়া।

ফেব্রুয়ারিতে যখন করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী জরুরিকালীন একটা স্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নিল, তখন স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো তড়িঘড়ি মানুষকে পরামর্শ দিয়েছিল নতুন ভাইরাস থেকে বাঁচতে আমাদের কী করতে হবে।

একটা পরামর্শ- যা দিনের পর দিন প্রতিদিন আমরা শুনেছি, পড়েছি, দেখেছি- সংবাদ বুলেটিনে, খবরের কাগজের পাতায়, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকারে- সেটি ছিল সাবান এবং গরম পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে ভালো করে হাত ধুতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কীভাবে ঠিকমতো হাত ধুতে হবে তার যেসব গ্রাফিক্স চিত্র প্রকাশ করেছিলে, তা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই চিত্র আমরা মহামারির শুরুর দিকে দেখেছি সর্বত্র- রেস্তোরাঁয়, পানশালায় যেখানেই জনসাধারণের হাত ধোবার ব্যবস্থা আছে।

করোনা মহামারি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর ছয় মাস পার হয়েছে। কোথায় সংক্রমণ এখনো শীর্ষে, কোথায় কমছে বা কমে আবার বাড়ছে, কোথায় স্থানীয়ভাবে লকডাউন জারি হচ্ছে বা সংক্রমণ ঠেকাতে কোথায় কারফিউ দিতে হবে এসব নিয়ে নানা বিভ্রান্তির মধ্যে হাত ধোয়ার বিষয়টি এখন কিছুটা গৌণ হয়ে পড়েছে।

লকডাউন যত শিথিল হচ্ছে, যত সব কিছু খোলা হচ্ছে, তত ফেস মাস্ক পরা বা মুখ ঢাকা রাখার গুরুত্বটা বেশি করে সামনে আসছে। কোথায়, কখন, কীভাবে মাস্ক পরা হবে এটাই এখন আলোচনার কেন্দ্রে। ফলে এই ভাইরাস ঠেকানোর আদি মূলমন্ত্র এখন কি অন্য পরামর্শের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে?

ইথিওপিয়ায় একটি জরিপে সম্প্রতি দেখা গেছে হাসপাতালে যাওয়া এক হাজারের ওপর মানুষের মধ্যে ১ শতাংশেরও কম সঠিকভাবে হাত ধুচ্ছে। তাহলে কি পরামর্শ বদলে গেছে?

মোটেই না- বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছেন হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের থেকে দ্বিগুণ বেড়েছে। কারণ মানুষ এখন আগের মত ঘরবন্দি নেই। অনেক মানুষ বেরতে শুরু করেছে। ফলে তাদের সাথে সাথে ভাইরাসের চলাচলও বেড়েছে।

আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের বস্টনে নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রসায়ন ও জৈব রসায়নের অধ্যাপক টমাস গিলবার্ট বলছেন করোনাভাইরাসের যে রাসায়নিক গঠন তাকে ভাঙতে সবচেয়ে কার্যকর সস্তার সাবান ও গরম পানি।

‘এই ভাইরাসের বাইরে যে আবরণ থাকে, যেটি জীবাণুর জেনেটিক কণাগুলোকে ঘিরে রাখে সেটাকে বলা হয় লিপিড মেমব্রেন। এই আবরণটা তৈলাক্ত ধরনের,’ তিনি বলছেন। ‘এই আবরণটাকেই সাবান আর পানি গলিয়ে দেয়।’

ভাইরাসের কোষগুলোকে ‘খাম’-এর মত ঘিরে রাখে যে আবরণ, সেই আবরণটা ভেঙে দিতে পারলে জীবাণুর কোষগুলো আর এক জোটে থাকতে পারে না, সেগুলো ভেঙে পড়ে আর সাথে সাথে তার জিনের উপাদানগুলোও কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই জিনগত উপাদানই মানুষের দেহকোষকে আক্রমণ করে থাকে, এবং কোষের মধ্যে বংশ বৃদ্ধি করে ছড়াতে থাকে। ফলে ওই আবরণটা নষ্ট করতে পারলে ভাইরাসকে অক্ষম করে দেয়া সম্ভব।

‘হাত ধোয়ার সময় কম করার ব্যাপারে কোনরকম পরামর্শ এখনও দেয়া হয়নি,’ বলছেন টমাস গিলবার্ট।

‘কাজেই হাত ভিজিয়ে নিয়ে সাবান মাখিয়ে দুই হাতে ভালো করে ফেনা তৈরি করতে হবে। তার পর ২০ সেকেন্ড ধরে সেই সাবান দিয়ে হাতের প্রতিটা অংশ ভালো করে ডলে ধুতে হবে। প্রতিটা খাঁজ, ভাঁজ নখের চারপাশ সব অংশ সাবানের ফেনা দিয়ে ঘষে ধুতে হবে।’ গিলবার্ট বলছেন, ‘তৈলাক্ত আবরণকে ভাঙার জন্য যে রাসায়নিক ক্রিয়ার প্রয়োজন তা সম্পন্ন হতে বিশ সেকেন্ড সময় লাগে। জীবাণুর শেষ অংশটুকু হাত থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য সাবানকে তার কাজ করতে এই সময় দিতে হবে এবং অল্প গরম পানি এই সাবান ধুয়ে ফেলতে কাজ করবে।’

‘সাবান ব্যবহার জরুরি’
ব্রিটেনে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার বিজ্ঞানের অধ্যাপক মার্টিন মিকেলিস বলছেন শুধু পানি দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাসকে ধ্বংস করা যাবে না। ‘ধরুন আপনি রান্না করছেন, আপনার হাতে বা আঙুলে তেল লেগে আছে। শুধু পানি ব্যবহার করলে কি সেই তেল যাবে? যাবে না। তার জন্য দরকার সাবান। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই। তার তৈলাক্ত আবরণ ভেঙে দিতে চাই সাবান। তবেই এই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে।’

সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার কার্যকারিতার বিষয়টা কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ার কারণে। হাত জীবাণুমুক্ত করার এই রাসায়নিক ছোট বোতলে করে এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া সহজ। দোকানে বাজারে যে কোনো জায়গায় এর ব্যবহার অনেক সুবিধাজনক। তাই মানুষ এই স্যানিটাইজারের দিকে বেশি ঝুঁকছে।

টমাস গিলবার্ট বলছেন, আপনি যদি সারা দিন বাসার ভেতরে থাকেন। আপনার ঘরে যদি বাইরের লোক না আসা যাওয়া করে, তাহলে অবশ্যই আপনার বারবার হাতে ধোয়ার প্রয়োজন হবে না।

‘এ ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার হয়ত আপনি গাড়িতে রাখতে পারেন বা আপনার ঘরে ঢোকার দরোজার মুখে রাখলেন অথবা ব্যাগে বা পকেটে রাখলেন, যেখানে সাবান বা পানি পাওয়া যাবে না সেখানে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু যেখানে সাবান আর পানি আছে, সেখানে সাবান আর পানির ব্যবহারই সবচেয়ে ভাল বলে আমি মনে করি।’

কত ঘন ঘন হাত ধোয়া উচিত?
মহামারি শুরুর সময় প্রথমদিকে ব্রিটেনের সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টারা পরামর্শ দিয়েছিলেন কয়েক ঘন্টা পর পর হাত ধুতে, যদিও সেসময় বেশিরভাগ মানুষই লকডাউনের কারণে ঘরের ভেতরেই থাকছিল। গিলবার্ট বলছেন যারা মূলত ঘরের ভেতর থাকেন তাদের এত ঘন ঘন হাত ধোয়ার প্রয়োজন নেই। তবে টয়লেট ব্যবহারের পর এবং খাবার তৈরির আগে ও খেতে বসার আগে অবশ্যই সবার হাত ধোয়া উচিত।

কেউ যদি কোভিড-১৯এ কিংবা অন্য যে কোন ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সেবা বা পরিচর্যা করেন, তাহলে তাদের ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে যদি তারা আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ করা কোন জিনিস ধরেন অথবা এমন কোন জিনিসের ওপর আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিয়েছেন, যেটা তিনি হাত দিয়ে ধরেছেন তাহলে অবশ্যই সাথে সাথে হাত ধোয়া দরকার।

সাবান করোনাভাইরাসের বাইরের তেলতেলে আবরণ ধ্বংস করে দেয়, যাতে জীবাণুর কোষের ভেতর যে জিনগত উপাদান থাকে তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে

জার্মানির একজন গবেষক থি মুই ফাম তার গবেষণাপত্রে লিখেছেন তার গবেষণায় তিনি দেখেছেন আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ করা কোন জিনিস যদি কেউ ধরে, তাহলে সাথে সাথে হাত ধুয়ে ফেলা অনেক বেশি কার্যকর হয়। সেক্ষেত্রে কয়েক ঘন্টা পর হাত ধুলে তা অতটা কার্যকরা নাও হতে পারে।

সাবান বনাম অ্যান্টি ভাইরাল হ্যান্ডওয়াশ
অনেকে অ্যান্টি ভাইরাল হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহারের পক্ষে সুবিধার কারণে নয়, কারণ তারা মনে করে সাধারণ সাবানের থেকে অ্যান্টি ভাইরাল হ্যান্ডওয়াশ বেশি কার্যকর। কিন্তু অধ্যাপক মিকেলিস বলছেন সেটা সঠিক নয়।

‘এসবের আসলে কোন দরকার নেই,’ তিনি বলছেন।

‘অনেকে সাধারণ সাবানের বদলে জীবাণু নাশক বা অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এসব খুব বেশি ব্যবহারের আবার অন্য ঝুঁকি রয়েছে। খুব বেশিদিন এসব জীবাণু নাশক ব্যবহার করলে বর্জ্য পানিতে এই জীবাণু নাশক জমা হয় এবং অনেক জীবাণু এসব রাসায়নিকের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যখন এসব জীবাণু নাশক আর কাজ করে না। দীর্ঘ মেয়াদে এগুলোর ব্যবহার পরিবেশেরও ক্ষতি করে,’ বলছেন অধ্যাপক মিকেলিস।

অধ্যাপক গিলবার্ট এবং অধ্যাপক মিকেলিস দুজনেই বলছেন নির্ভরযোগ্য মানের পানি থাকলে সাবান পানিতে হাত ধোয়াই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে ভাল অস্ত্র।

তবে পৃথিবীর অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত অনেক দেশে মোটামুটি বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। অনেক জায়গায় পানিই দুষ্প্রাপ্য। এ মাসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের একটি রিপোর্টে বলেছে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আগেও বিশ্বে প্রতি পাঁচটির মধ্যে দুটি স্কুলে হাত ধোবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল না।

পৃথিবীর অনেক জায়গায় নিয়মিত হাত ধোয়ার ব্যবস্থা খুব সহজ নয়। কারণ অনেক জায়গায় তীব্র জলাভাব রয়েছে।

তবে করোনাভাইরাস ঠেকাতে হাত ধোয়ার পানি খাবার পানির মতো বিশুদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে তারা বলছেন। ‘হাতের কাছে সাবান বা সাবান জাতীয় কিছু থাকলেই কাজ হবে।’

বিজ্ঞানীরা বলছেন শুধু কোভিড-১৯ জীবাণু নয়, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অন্য আরও রোগ জীবাণু ঠেকাতে হাত ধোয়া একটা ভালো অভ্যাস। করোনা ঠেকাতে যেভাবে হাত ধোয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, একইভাবে এই অভ্যাস যদি আমরা প্রাত্যহিক জীবনের অংশ করে নিতে পারি তাহলে অনেক সংক্রামক রোগ ঠেকানো সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন।

শীতের মৌসুমে যখন সর্দিজ্বর বা ফ্লু ছড়ায়, তখনও যদি হাত ধোয়ার অভ্যাস আমরা বজায় রাখতে পারি, তাহলে ‘সেটি আমাদের রোগ ঠেকানোর একটা সুযোগ করে দেবে’ বলে মনে করছেন অধ্যাপক মিকেলিস।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ