আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

মহামারিতে বিধ্বস্ত ভারতের অর্থনীতির মাথা তুলে দাঁড়ানো যে কারণে কঠিন হবে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৪৫

ভারতের অর্থনীতি চলতি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ সংকুচিত হয়েছে- দেশটির সরকার এই তথ্য প্রকাশের পর গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় লকডাউন শুরুর পর তিন মাসে জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন সঙ্কুচিত হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

উৎপাদন, নির্মাণ, হোটেল, পরিবহন, আবাসনসহ অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সঙ্কোচন দেখা গেছে। এপ্রিল থেকে জুন- এই তিন মাসের জিডিপি-র সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে কৃষি ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই সঙ্কোচন হয়েছে অর্থনীতির।

লকডাউনের কারণ দেশটির অর্থনীতি প্রায় স্তব্ধ হয়ে থেকেছে কোভিড মহামারির সময়কালে- শুধু খাদ্যপণ্য এবং ওষুধ উৎপাদন ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া ওই সময়কালে সব কিছুই বন্ধ রাখা হয়েছিল। সে জন্য একমাত্র কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩.৪ %।

কিন্তু শুধুই কি লকডাউনের জন্য অর্থনীতির এই রেকর্ড সংকোচন?
অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিত বসু বলছিলেন লকডাউনের আগে থেকেই ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছিল ভারতের অর্থনীতি, লকডাউন শুধু ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ দিয়েছে। গত দুবছর ধরে প্রতিটা ত্রৈমাসিকেই ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমেছে। বিনিয়োগ যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে রপ্তানি। অর্থনীতির মূল অভিমুখটাই ছিল অনেকদিন ধরেই নিম্নগামী। তারওপরে এই লকডাউন হয়েছে- পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে কড়া লকডাউন হয়েছে। তার প্রভাব কোভিড সংক্রমিতর সংখ্যায় খুব একটা দেখিনি - কিন্তু অর্থনীতির একেবারে যাকে বলে বারোটা বেজে গেছে।’

প্রায় ২৪ % সংকোচনের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাও অসম্পূর্ণ বলে সরকার নিজেই জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর অর্থ হল সঙ্কোচনটা আরও বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ অসংগঠিত ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ হিসাব হয়তো জোগাড় করা যায় নি।

জনজীবনের স্থবিরতার প্রতিফলন
অসংগঠিত ক্ষেত্রেই জড়িত রয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। তাদের মধ্যে যেমন পরিযায়ী শ্রমিকরা আছেন, তেমনই আছেন ইঁটভাটার শ্রমিক বা শহর-গ্রামের রিকশাচালক বা ছোটখাটো দোকানকর্মী। লকডাউন পর্বে তাদের অনেককেই অনাহারে থাকতে হতো, যদি না বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ছাত্রছাত্রীরা তাদের মধ্যে খাবার বিলি করতেন।

দেড়শ দিনেরও বেশি সময় ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-গবেষকরা রান্না করা খাবার বিলি করছেন সেই সব মানুষের মধ্যে, যাদের ওপরে জিডিপি সংকোচনের সরাসরি প্রকাশ দেখা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অনুষ্কা পাল প্রথম থেকেই রান্না করা খাবার বিলির কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। তারা যেভাবে মানুষকে অনাহারে দিন কাটাতে দেখেছেন, তার নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই অর্থনৈতিক সঙ্কোচনের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।

তার কথায়, ‘আমরা প্রথমে উদ্যোগটা শুরু করেছিলাম স্যানিটাইজার তৈরি আর বিলি করার মধ্যে দিয়ে। যারা দিন-আনি-দিন-খাই শ্রেণির মানুষ, তাদের পক্ষে ওই সময়ে চড়া দামে স্যানিটাইজার কিনে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব ছিল না। ওই কাজটা করতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হল, যারা তখনই বেশ কয়েকদিন না খেয়ে ছিলেন কারণ হঠাৎ করে লকডাউন হওয়ায় তাদের জীবনটা হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে যায়।’

প্রথমে তারা ভেবেছিলেন শুকনো চাল-ডাল বিলি করবেন, কিন্তু তখন দেখা গেল অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের কাছে রান্নার বাকি উপকরণ জোগাড় করাও অসাধ্য। তাই একবেলা রান্না করা খাবার দেওয়া শুরু হল, যা এক সময়ে বাড়তে বাড়তে এক হাজার জনেরও বেশি হয়ে গিয়েছিল সংখ্যায়।

‘এমনও অনেকের কথা জানি, যারা পরিবারের সাত-আট জনের মধ্যে হয়তো দুজন খাবার নিতে আসতে পেরেছেন, কিন্তু বাকিরা হয়তো চিঁড়ে খেয়ে থাকবেন। আমাদের মতো যারা রিলিফ নিয়ে মানুষের কাছে গেছি, দেখেছি এক কেজি চিঁড়ে নিয়েও কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে, খিদের জ্বালা এতটাই বেশি ছিল,’ বলছিলেন অনুষ্কা পাল।

নানা সংস্থা বা ব্যক্তির দেওয়া রিলিফের একবেলা খাবারই যাদের একমাত্র ক্ষুধা নিবারণের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওই সময়টায়, যে সময়ের অর্থনৈতিক তথ্য সোমবার সামনে এসেছে, সেইসব পরিবারের শিশু সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষার ওপরেও প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিচী ট্রাস্ট এই করোনাকালের শহরে আর গ্রামের মানুষের ওপরে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন।

প্রতিচীর গবেষক সাবির আহমেদ বলছিলেন, ‘গ্রাম হোক বা শহর, গরীব মানুষদের মধ্যেও একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে অনেকদিন ধরে যে ছেলে মেয়ে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুক। কিন্তু অর্থনীতির অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে এই করোনাকালে যে অনেকেই এখন সরকারি বিনাবেতনের স্কুলে ভর্তি করানোর কথা ভাবছেন। তারা বেসরকারি স্কুলে যত কম বেতনই হোক, সেটা দিতে যে অপারগ এই অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে, সেটা আমাদের গবেষণার সময়ে দেখতে পাচ্ছি।’

‘আবার এটাও দেখা যাচ্ছে স্কুলে মিড-ডে মিলের খাবার অনেক পরিবারের ছাত্রছাত্রীরাই খেত না। কিন্তু এখন শুকনো চাল-ডাল-আলু দেওয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। সেটাই পরিবারের অন্ন সংস্থানের ক্ষেত্রে কিছুটা সাহায্য করছে এখন,’ বলছিলেন আহমেদ।

সরকারি সূত্রগুলি বলছে যে তিন মাসে এই রেকর্ড সঙ্কোচন হয়েছে, তার পরেই শুরু হয়েছে আনলক পর্ব - যখন ধীরে ধীরে কলকারখানা খুলেছে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হচ্ছে। আবার সরকারও নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে কিছু কিছু অর্থ পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তাই পরের তিনমাসে অর্থনীতি কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কিন্তু অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলছিলেন, ঘুরে দাঁড়ানোটা অত সোজা হবে না।

‘প্রথমত মহামারিটা কতদিন চলবে আমরা জানি না। আর যতদিন মহামারি চলবে, ততদিন অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। আমার আশঙ্কা আরও একটা বা দুটো ত্রৈমাসিকেও নেতিবাচক বৃদ্ধি, অর্থাৎ সঙ্কোচন দেখতে পাব আমরা। একটা কারণ এখনও শ্রমিকদের ব্যবহার করা যাচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধির কারণে, তাই উৎপাদন শুরু করা যাচ্ছে না। আবার উল্টোদিকে যেসব ক্ষেত্রে শ্রমটাই সরাসরি পণ্য, যেমন পরিষেবার ক্ষেত্রে, সেখানে শ্রমের চাহিদাটাই কমে গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো খুব সহজ নয়।’

তিনি আরও বলছিলেন, শুধু যে জিডিপির ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন তা নয়। যে সময়ের তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেই একই সময়ে পুঁজির লগ্নিও কমেছে ৪৭ %। এখনও লগ্নি স্বাভাবিক নয়। আর লগ্নি না এলে উৎপাদন থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান - প্রতিটা দিক থেকেই ভারতের অর্থনীতির ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আগামী বেশ কিছুকাল।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ