আজকের শিরোনাম :

যেভাবে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে আইসোলেশন

  দ্য সায়েন্টিস্ট

২০ আগস্ট ২০২০, ১০:০৭ | অনলাইন সংস্করণ

ডেইজি ফানকোর্ট দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের সারেতে অবস্থান করছিলেন, যখন যুক্তরাজ্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের এপিডেমিওলজিস্ট ফানকোর্টের জন্য এ ঘোষণা তার জীবনে নিছক একটি পরিবর্তনের চেয়ে বেশি কিছু ছিল। এটা তাকে ব্রিটেনের মানুষের আইসোলেশন এবং মহামারী-সংক্রান্ত অন্যান্য পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।

সাধারণ সময়ে ফানকোর্ট এবং তার সহকর্মীরা গবেষণা করতেন সামাজিক ফ্যাক্টর যেমন আইসোলেশন মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে কীভাবে প্রভাবিত করে সেটা নিয়ে। মার্চের শেষ দিকে বরিস জনসনের ঘোষণার আগে তার দল ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের অবস্থা নজরদারি করছিল। যেখানে জনসমাগমের স্থানগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং মানুষের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।

সে সময়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ফানকোর্ট বলেন, আমরা অনুভব করলাম আমাদের দ্রুত ডাটা সংগ্রহ করতে হবে।

তিনি ও তার সহকর্মীরা দ্রুত গ্রাউন্ডওয়ার্ক শুরু করলেন রিয়েল টাইমের মধ্যে লকডাউনের প্রভাব নির্ণয় করার জন্য। মার্চের ২৪ থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সাপ্তাহিক অনলাইন জরিপের জন্য এ গবেষণায় যুক্ত করা হয় ৭০ হাজার অংশগ্রহণকারীকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুস্থতা, মানসিক স্বাস্থ্য এবং মানিয়ে নেয়ার কৌশল সম্পর্কে টেলিফোন ইন্টারভিউতে জানতে চাওয়া হয়।

এই প্রজেক্ট এবং এ রকম আরো প্রজেক্ট অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য জায়গায় চলছে। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আশপাশের মানুষের মিথষ্ক্রিয়ার পরিবর্তন কীভাবে মানুষের বায়োলজিকে প্রভাবিত করে সেটা জানা। এমনকি কভিড-১৯ বৈশ্বিকভাবে বিস্তার লাভ করার আগেই গবেষকরা লাখো মানুষকে আইসোলেটেড হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। যারা কিনা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, অল্প কিছু ব্যক্তিগত যোগাযোগ অবশিষ্ট ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান মতে ৭.২ শতাংশের বেশি মানুষ বলেছে, তারা আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে অনেক সময় বছরে একবারও মিলিত হয় না। যুক্তরাজ্যের এক জরিপ বলছে, ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক অর্ধমিলিয়ন মানুষ সাধারণত প্রতিদিন একাকীই কাটায়।

এ পরিসংখ্যান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা সামাজিক আইসোলেশন এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্ককে উন্মোচিত করেছে। ফানকোর্ট বলেন, আমরা বেশকিছু প্রমাণ পেয়েছি; যা দেখাচ্ছে আইসোলেশন এবং একাকিত্ব বিভিন্ন ধরনের রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। অকালমৃত্যুর সঙ্গেও।

স্থূলতা ও কার্ডিওভাসকুলার সমস্যাসহ দুর্বল স্বাস্থ্যের সঙ্গে অসংখ্য যোগাযোগের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্কের ওপর সম্ভাব্য প্রভাবগুলোও এখন নথিভুক্ত করা হচ্ছে: সামাজিক আইসোলেশন চেতনা হ্রাসের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ও ডিমেনশিয়ার (স্মৃতিভ্রংশ) সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য পরিণতি যেমন হতাশা ও উদ্বেগের সঙ্গেও।

বর্তমানে আমরা যে ধরনের আইসোলেশন দেখছি তা নজিরবিহীন এবং এটা অন্যান্য চাপের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়, যেমন রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয় এবং অর্থনৈতিক চাপ। কিন্তু এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সামাজিক আইসোলেশনের প্রভাব এবং এটাকে প্রশমিত করা নিয়ে গবেষণা জরুরি। সোস্যাল নিউরোসায়েন্টিস্ট স্টেফানে কাকিওপ্পো বলেন, আমরা সামাজিক জীব। আমাদের টিকে থাকার জন্য অন্যদের প্রয়োজন।

চেতনায় দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক আইসোলেশনের প্রভাব

১৯৭২ সালে ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রী ও বিজ্ঞানী মিচেল সিফ্রে নিজেকে টেক্সাসের একটি গুহায় ছয় মাসের বেশি সময়ের জন্য আটকে ফেলেন। যা কিনা ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় স্ব-আইসোলেশনের পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত। বেশ গভীরভাবে তিনি তার মনের মাঝে এই ২০৫ দিনের প্রভাবগুলো লিপিবদ্ধ করেন। তিনি জানান, কয়েক মাস পর কদাচিৎই সুশৃঙ্খলভাবে চিন্তা করতে পেরেছিলেন। পাঁচ মাস পর তিনি কারো সঙ্গ পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এ সময় তিনি একটি ইঁদুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এ ধরনের নিরীক্ষা এবং কম তীব্র আইসোলেশন পিরিয়ড সংবেদন ও সামাজিক বঞ্চনার চেতনাগত ও মানসিক প্রভাব সম্পর্কে কিছুটা মাত্র ধারণা দেয়।

মানুষ নিয়মিতভাবে বিভ্রান্তি ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন সম্পর্কে জানিয়েছে এবং উদ্বেগ ও হতাশার বিষয়েও। এসব পরীক্ষার সবচেয়ে রূঢ় অবস্থাটি দেখা যায় বিশ্বজুড়ে কারাগারগুলোতে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই হাজার হাজার মানুষ নির্জন কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি। যাদের চেতনা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্থায়ী প্রভাব রয়েছে।

মানব সমাজের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক আইসোলেশন এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেয়ে অনেক তীব্র হয়ে থাকে, যা প্রায়ই সামঞ্জস্যহীনভাবে সমাজের দুর্বল ও ভঙ্গুর অংশের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বয়স্কদের কথা।

অনেক গবেষণা বলছে, দীর্ঘকালীন সামাজিক আইসোলেশন চেতনা ক্ষয়ের সঙ্গে জড়িত। আরেকটি গবেষণা বলছে, যেসব মানুষের সামাজিক যোগাযোগ ও কার্যকলাপ কম তাদের জ্ঞানীয় ক্রিয়ার ব্যাপকতর হ্রাস দেখা গেছে। ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় ১১ হাজার মানুষ অংশ নেয়। সেখানে দেখা যায়, যেসব পুরুষের সামাজিক আইসোলেশন পরিমাণ গড়ের চেয়ে বেশি এবং যেসব নারী সামাজিক আইসোলেশন বাড়ার কথা জানিয়েছে উভয়েরই মেমোরি ফাংশন গড়ের বেশি হ্রাস পেয়েছে। যদিও এই ফল দেখায় না যে আইসোলেশন মস্তিষ্ক ক্রিয়ার অবনতি ঘটায়। তবে এটাও সম্ভব যে জ্ঞানীয় অবনতি কিছু মানুষের সামাজিকীকরণে হ্রাস ঘটায়।

আইসোলেটেড মস্তিষ্ক

প্রাণী ও মানুষ যারা আইসোলেশনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে তাদের নিয়ে করা গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে বেশকিছু মস্তিষ্কের কাঠামো সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার অভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যদিও এ গবেষণা কার্যকরী সম্পর্ককে চিহ্নিত করতে পারে না। পাশাপাশি একটি আরেকটির সঙ্গে মতৈক্যে আসতে পারে না।

তারা এমন কিছু পদ্ধতির ওপর আলোকপাত করেছে, যাদের মাধ্যমে শারীরিক বিচ্ছিন্নতা কিংবা একাকিত্বের অনুভূতি মস্তিষ্কের ক্রিয়া ও চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স: কিছু গবেষণায়, যেসব মানুষ নিঃসঙ্গ তাদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে মস্তিষ্কের ভলিউমে হ্রাস দেখা গেছে। এটি এমন অঞ্চল যা কিনা সিদ্ধান্ত নেয় এবং সামাজিক আচরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

হিপ্পোক্যাম্পাস: মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী যারা আইসোলেশনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তাদের হিপ্পোক্যাম্পাস স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট হতে পারে এবং ব্রেইন ড্রাইভ নিউরোট্রাফিক ফ্যাক্টরের (বিডিএনএফ) ঘনত্ব হ্রাস করে। এ দুটি বৈশিষ্ট্যই শেখা ও স্মৃতি ক্ষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্য গবেষণা বলছে, স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোলের স্তর, যা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয় হিপ্পোক্যাম্পাস দ্বারা, যার মাত্রা আইসোলেটেড প্রাণীর ক্ষেত্রে উচ্চ হয়।

এমিগডালা: প্রায় এক দশক আগে গবেষকরা কোনো ব্যক্তির সামাজিক নেটওয়ার্কের আকার এবং তাদের এমিগডালার আয়তনের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন। দুটি বাদামের আকারের মস্তিষ্কের অঞ্চল আবেগ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত। সাম্প্রতিক কিছু প্রমাণ বলছে যারা নিঃসঙ্গ তাদের এমিগডালার আকার ছোট। অবশ্য তবুও আইসোলেশনের সঙ্গে জ্ঞানীয় স্বাস্থ্যের সম্পর্ক পুরোপুরি পরিষ্কার নয় বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

সৌজন্যে: বণিক বার্তা

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ