আজকের শিরোনাম :

করোনা ভাইরাস: ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন কি আসলে কাজে এসেছে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২০, ১৮:৫১

ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে তিন সপ্তাহের এলাকাভিত্তিক পরীক্ষামূলক লকডাউন শেষ হওয়ার পর আজ (বুধবার) থেকে ঐ এলাকার বাসিন্দারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন।

তবে বাসিন্দাদের স্বাভাবিক চলাফেরায় বাধা না থাকলেও আগামী কিছুদিন বাইরে থেকে ঐ এলাকায় মানুষ প্রবেশ করার বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলে জানান তিনি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ৯ই জুন থেকে পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দাদের চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এলাকায় প্রবেশের একটি গেট বাদে বাকিগুলো বন্ধ ছিল।

শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ বিবেচনায় এলাকায় বসবাসরত মানুষকে এলাকা থেকে বের হতে অনুমতি দেয়া হয়।

এই সময়ে পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় আইইডিসিআরের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরা এলাকার ভেতরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা, রোগীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং তাদের আইসোলেশন নিশ্চিত করার মত কাজ করেছেন।

পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন তুলে নেয়া উপলক্ষে সেখানে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী স্থানীয় প্রতিনিধি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অভিবাদন জানিয়ে প্রকাম করা এক ভিডিও বার্তায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন 'সংখ্যাতাত্বিক দিক থেকে এখনও' পূর্ব রাজাবাজারকে রেড জোন থেকে ইয়েলো জোনের অন্তর্গত হিসেবে ঘোষণা করা যাবে না।

তাহলে পূর্ব রাজাবাজারকে 'রেড জোন' হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন করার সুফল আসলে কতটুকু পাওয়া গেলো?

তিন সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে

পূর্ব রাজাবাজারকে রেড জোন ঘোষণা করে পরীক্ষামূলক লকডাউন কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয় জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। আইইডিসিআর'এর হিসেব অনুযায়ী সেসময় পূর্ব রাজাবাজারে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৩৯ জন।

আর তিন সপ্তাহ পর লকডাউন শেষ হওয়ার আগে ২৭শে জুনের তথ্য অনুযায়ী পূর্ব রাজাবাজারে কোভিড-১৯ রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ জনে, অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

তবে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানেই যে পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন ব্যর্থ হয়েছে, সেরকম নয় বলে মন্তব্য করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজীর আহমেদ জানান, 'জোনিং' করে কোনো এলাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রধান উপাদানগুলো হলে 'আইসোলেশন', 'ট্রেসিং', 'কোয়ারেন্টিন' ও সবশেষে 'চলাফেরা নিয়ন্ত্রন' করা। আর সেই হিসেবে চিন্তা করলে পূর্ব রাজাবাজারকে 'রেড জোনে'র অন্তর্ভূক্ত করে বাসিন্দাদের আইসোলেশনে নেয়া ও তাদের কোয়ারেন্টিন করা যথেষ্ট সফল পদক্ষেপ ছিল।

বে-নজীর আহমেদ বলেন, "'জোনিং' করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো একটি এলাকার মধ্যে যতজন রোগী রয়েছে তাদের শনাক্ত করা, রোগীর পাশাপাশি রোগীর সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের আইসোলেশন নিশ্চিত করা।"

লকডাউনের তিন সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও রোগতাত্বিক বিবেচনায় সেটি গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

"ধরুন, লকডাউনের শুরুতে আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো ছিল ৪০ জন। পরের এক সপ্তাহে লকডাউন চলাকালীন অবস্থাতেই আরো ২০ জন আক্রান্ত হলেন। এই এক সপ্তাহ সময়ে কিন্তু কর্তৃপক্ষ এবং স্বেচ্ছাসেবীরা ঐ সব রোগীদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করবেন এবং তাদের আইসোলেশনও নিশ্চিত করবেন।"

"আর যেহেতু রোগীরা ও তাদের সংস্পর্শে আসা কেউই এলাকা থেকে বের হতে পারবেন না, তাদের মাধ্যমে তখন ভাইরাস সংক্রমণও হওয়া সম্ভব না।"

এভাবে একটি এলাকার ভেতরে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এলাকার ভেতরে রোগী ও রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আইসোলেশন নিশ্চিত করলে ভাইরাস সংক্রমণের হার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মূলত চলাফেরা সীমিত করা নয়, নিখুঁতভাবে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা এবং আইসোলেশন নিশ্চিত করাই 'জোনিং' করার প্রধান উদ্দেশ্য বলে মন্তব্য করেন মি. আহমেদ। আর রাজাবাজারের ক্ষেত্রে সেই প্রয়াস যথেষ্ট সফল হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেনও মনে করেন পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন কার্যকর করায় স্থানীয় কমিউনিটিকে যুক্ত করা খুবই ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ ছিল।

মোশতাক হোসেন বলেন, "রাজাবাজারের স্থানীয়রা যখন সেখানকার বাসিন্দাদের বাসায় গিয়ে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করেছে, নমুনা সংগ্রহে সাহায্য করেছে, তখন বাসিন্দাদের মধ্যে এক ধরণের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। নিজেদের এলাকার মানুষজনের সহায়তার ফলে বাসিন্দারাও সঠিক তথ্য দিয়েছেন, যেটা এর আগে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি।"

তবে শহরের শুধূমাত্র একটি এলাকা 'রেড জোন' হিসেবে থাকার কারণে রাজাবাজারের লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নও চ্যালেঞ্জিং ছিল বলে মন্তব্য করেন মোশতাক হোসেন। একসাথে বেশ কয়েকটি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করলে এই ধরণের পদক্ষেপের সুফল আরো দ্রুত পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

'তথ্য লুকানোর প্রবণতা ক্ষতিবৃদ্ধি করছে'

পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউন কীভাবে কার্যকর করা হয়েছে এবং সেখানকার সংখ্যাতাত্বিক চিত্রের পেছনের ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষকে বিস্তারিত জানালে অন্য এলাকার বাসিন্দারাও একই পদ্ধতিতে লকডাউন কার্যকর করতে উদ্বুদ্ধ হবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজীর আহমেদ।

তিনি মন্তব্য করেন যে এতদিন করা হয়েছে 'নিয়ন্ত্রণ' আর এখন করতে হবে 'প্রতিরোধ।'

"রাজাবাজারকে 'রেড জোন' ঘোষণা করে লকডাউন করার পর প্রতিদিন কতজন রোগী শনাক্ত হলো, ঐ রোগীদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কীভাবে করা হলো, এরকম তথ্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে শেয়ার করা হলে তারা বলতে পারতো যে সেখানে সংক্রমণের পরিস্থিতিটা কী।"

বে-নজীর আহমেদ ধারণা প্রকাশ করেন কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাথে সমন্বয় করে এই তথ্য আদান প্রদান না করায় বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছেন না।

"বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দিতে না পারায় জনগণের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি বাড়ছে। পূর্ব রাজাবাজারের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতিটা গণমাধ্যমের সাহায্যে মানুষকে জানালে আরো অনেকগুলো এলাকার মানুষ হয়তো নিজেদের এলাকায় রাজাবাজারের মত কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইতো।"

তবে মোশতাক হোসেনের মত বে-নজীর আহমেদও মনে করেন একটি একটি এলাকা রেড জোনে না নিয়ে একসাথে অনেকগুলো এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিলে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরো দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসতো।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ