আজকের শিরোনাম :

করোনা ভাইরাস কী বাংলাদেশে সরকারের জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে?

  বিবিসি

২২ মে ২০২০, ২১:১২ | অনলাইন সংস্করণ

মাদারীপুরের রিনা বেগম তিন সন্তানের জননী এবং বসবাস করেন ঢাকার মগবাজার এলাকায়। মগবাজার ও বেইলি রোডের বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করছিলেন তিনি যাতে আয় হতো মাসে প্রায় পনের হাজার টাকা।

কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর গত দুমাস তার কোনো কাজ নেই, বন্ধ হয়ে গেছে উপার্জন।

"তিন বাসায় কাজ করতাম। কাজ বন্ধ হওয়ার পর আমাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমরা কাজে কর্মে যেতেই পারছি না। খাওয়া দাওয়া, ঘরভাড়া নিয়া খুব কষ্ট হচ্ছে। কোনো সাহায্য সহযোগিতাও আমরা পাইনি"।

রিনা বেগমের মতো অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে গত দু তিন মাসের লকডাউন ও সাধারণ ছুটির কারণে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে উন্নয়ন কার্যক্রম, অন্যদিকে মানুষকে দিতে হচ্ছে নগদ টাকা।

ওদিকে করোনা পরিস্থিতিরও উন্নতির তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে তা কি সরকারকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে?

এমন পরিস্থিতির জের ধরে গত প্রায় এক দশক ধরে কঠোরভাবে সরকার বা প্রশাসন সরকার যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে তাতে কি কোনো ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে ?

আবার অর্থনৈতিক সংকটের জের ধরে সরকার বেকায়দায় পড়লে তাতে বিরোধী দলগুলোর লাভবান হবার সম্ভাবনাই বা কতটা।

এসব কিছুও এখন নানাভাবে চিন্তায় আনছেন বিশ্লেষক বা গবেষকরা।

যদিও সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখনই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাননি কেউই, তবে স্বাস্থ্যসেবা পুনরুদ্ধার থেকে শুরু করে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাবে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তার কোন প্রতিক্রিয়া হবে না সেটিও মানতে নারাজ অনেকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলছেন সবাইকে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পারলে ভঙ্গুর অর্থনীতির হাত ধরে তৈরি হতে পারে চরম নৈরাজ্য।

"যে চ্যালেঞ্জটা আসবে সেটা হলো অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা। এটি অনেকদিন ধরেই আছে। আমরা আগেই বলেছি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হয় না। তো আপনার সামাজিক অস্থিরতা আসবে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা আসবে। মানুষের চাকরি থাকবে না, খাওয়া থাকবে না। তখন একটা নৈরাজ্য তৈরি হতে পারে, যেটাকে আমরা বলি অরাজকতা"।

তিনি বলেন সরকার হয়তো তার কর্তৃত্ব হারাবে না, আবার বিরোধী দলগুলোও এ সুযোগে খুব বেশি লাভবান হবার সুযোগ পাবে বলে তিনি মনে করেন না।

তবে যেভাবে স্বচ্ছন্দে সরকার সব নিয়ন্ত্রণ করেছে এতদিন সেটি টিকিয়ে রাখাটা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

তবে এ ঝুঁকির মূল কারণ হবে যদি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কাজ না থাকে বা আয়ের সংস্থান না থাকে।

আর এ দুটি সমস্যার সমাধান করতে হলে দরকার হবে পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করা।

কিন্তু করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘকাল হলে সেটি কতটা সম্ভব হবে তা বলা কঠিন। এখন করোনাভাইরাস জনিত পরিস্থিতির কারণে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনে দরিদ্র শ্রমজীবীদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

ফলে কবে নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে তা কারও জানা নেই।

অথচ এর ওপরই নির্ভর করছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোদমে স্বাভাবিক হওয়ার বিষয়টি।

পরিস্থিতি সামাল দিতে ৫০ লাখ দরিদ্র বা অতিদরিদ্র মানুষের জন্য এককালীন আড়াই হাজার টাকা নগদ দেয়ার কাজ করছে সরকার ।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন ত্রাণ কিংবা প্রণোদনার বিষয়টিতেও সুশাসন নিশ্চিত করাটাই এখন প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এমন পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে তা মোকাবেলায় সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করা অর্থাৎ একটি ঐক্য তৈরি করা এবং মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে না দেয়াই হবে সামনের দিনগুলোতে সরকারের জন্য বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

"অর্থনীতি শুধু না, স্বাস্থ্য খাত দেখেন সেখানেই অনেক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। অসন্তোষের জায়গা বাড়তে না দিতে সমাজের সব শ্রেণী পেশার পরামর্শ নিতে হবে। সবাইকে নিয়ে এগুবার চেষ্টার দিকে নজর না দিলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বিলম্বিত হবে, আরও নানামুখী অসন্তোষের জায়গা তৈরি হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করতে হলে মানুষকে আস্থার জায়গায় নিতেই হবে, এটিই হবে বড় চ্যালেঞ্জ"।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তৈরি হয়েছিলো গণতন্ত্র বা উন্নয়ন- কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গত দুটি বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের পর সরকার পন্থীরা জোর দিয়ে বলছিলেন বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নটাই বেশি দরকার।

এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ফ্লাইওভার, কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে এগুলোকেই দেখানো হচ্ছিলো বেশি গুরুত্ব দিয়ে। পাশাপাশি সরকারের দাবি ছিলো মানুষের আয় বেড়েছে, কাজ বেড়েছে।

এখন এর সব কিছুকেই বড় ধাক্কা দিয়েছে করোনাভাইরাস। পদ্মা সেতু ছাড়া বাকী মেগা প্রকল্প যেমন বন্ধ তেমনি বন্ধ হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের আয়ের পথও।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমালোচনার মধ্যেই গার্মেন্ট খুলে দেয়া হয়েছে, স্বল্প পরিসরে চালু করার চেষ্টা হয়েছে ব্যবসা বাণিজ্যও। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন এমন পরিস্থিতিতেও সামনে সরকারের কর্তৃত্ব আরও সুদৃঢ় হবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন উন্নয়নের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার যে প্রচারের মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক লাভ বা পলিটিক্যাল লিড নিচ্ছিলো সেটিকে করোনাভাইরাস বড় সংকটে ফেলে দিয়েছে, যা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করবে বলে মনে করেন মিস্টার আহমেদ।

"এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে গত ১০/১৫ বছরে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ দারিদ্রসীমার বাইরে যেতে পেরেছিলো এবং মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী বেশ স্ফীত হয়েছিলো। ফলে অনেক বড় একটা বাজার তৈরি হয়েছিলো। সেটা একটা ধাক্কা খাবে কারণ অনেকে দারিদ্রসীমার নিচে পড়ে যাবেন। ফলে মধ্য আয়ের দেশে সহসাই যাওয়ার যে ঘোষণা এসেছিলো সেটি হচ্ছে না"।

সব কিছু মিলিয়ে দু মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রায় বন্ধ আছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বিরোধিতার মুখেও গার্মেন্ট খুলে দেয়া হয়েছে। ৫ই এপ্রিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে তৈরি পোশাক খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিলো। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের জন্য আলাদা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৮ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলও গঠন করেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি বিলম্বিত হলে অর্থনীতি স্থবির থাকার প্রভাবে যে ব্যাপক চাপ তৈরি হবে তাও সরকারের জন্য বড় ধরণের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে।

কারণ একদিকে বন্ধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য সামনে বাড়তি সময় ও অর্থের দরকার হবে। আবার যে বিপুল অর্থ এখন ব্যয় হচ্ছে তার সরাসরি অর্থনৈতিক ফল কমই পাওয়া যাবে।

অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলছেন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হলো এতো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা। আবার মনে রাখতে হবে সেজন্য যে বিশাল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে তা দিয়ে অর্থনৈতিক কোনো উৎপাদন কিন্তু হচ্ছে না।

"সামাজিক সুরক্ষা খাতে অন্য সময় যা ব্যয় করতে হয় এখন আরও বহুগুণ ব্যয় করতে হবে। কিন্তু তা দিয়ে কোনো অর্থনৈতিক উৎপাদন হবেনা অর্থাৎ এটি দেশের প্রবৃদ্ধিতে তেমন কোনো অবদান রাখবেনা। তবে চ্যালেঞ্জ হবে পরে কতটা আমরা পুষিয়ে নিতে পারি, কত দ্রুত আমরা দৌড়াতে পারি। কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়েই গেলো। যার প্রভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অর্থনীতিতে যে প্রবৃদ্ধি যা হবার তা হবে না"।

আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এমন নেতিবাচক অবস্থার পাশাপাশি মানুষের সহায়তায় দেয়া রিলিফসহ অন্যান্য সহায়তার ক্ষেত্রেও সুশাসন নিয়ে ইতোমধ্যেই বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

সাধারণ মানুষের জন্য দেয়া সহযোগিতা তাদের হাতে কতটা পৌঁছাবে তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান। ফলে গত কয়েক বছর ধরে যে সামাজিক স্থিতিশীলতার যে লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছিলো তা নিয়েও সংকট তৈরির আশংকা করছেন অনেকে।

আরেকজন অর্থনীতিবিদ সায়মা হক বিদিশা বলছেন স্বাস্থ্য সেবা, মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা ও আয় রোজগার ফিরিয়ে আনাটাই হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

"কোভিড ও নন কোভিড রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা এবং সংক্রমণ হার আস্তে আস্তে কমিয়ে আনা। যাতে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। দ্বিতীয়ত কাউকে যেনো খাবারের অভাবে না পড়তে হয়। এর পর আরেকটি বড় পরীক্ষা হবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে সেটি পূরণ করে আনা।

''আরেকটি বিষয় হলো দুর্নীতিকে কত শক্তভাবে দমন করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে লিকেজ দেখা যাচ্ছে। ত্রাণের টাকা মানুষের কাছে পৌছাচ্ছে না। এটার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হলে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে।''

তিনি বলেন আর এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য দরকার বড় ধরনের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ও এর বাস্তবায়ন, যা করতে হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সংখ্যাগত দিক না থেকে গুনগত দিকে জোর দেয়া জরুরি বলেনই মনে করেন তিনি।

অন্যথায় এসব কিছুই সরকারের জন্য বাড়তি রাজনৈতিক চাপ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ