বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
করোনাভাইরাস : এপ্রিল মাস কেন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ‘ক্রিটিক্যাল’
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২০, ১০:৫০
বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে কোভিড-১৯ পরীক্ষা বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগীর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এপ্রিল মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একদিকে যেমন সামাজিক সংক্রমণ দেখা দিতে শুরু করেছে, তেমনি সেটা ঠেকিয়ে রাখার জন্য ছুটি লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তারপরেও রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে হবে।
৫ এপ্রিল আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান সংক্রমণের তৃতীয় স্তরে প্রবেশে করেছে বাংলাদেশ। কারণ ঢাকার টোলারবাগ ও বাসাবো, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর (শিবচর), গাইবান্ধা (সাদুল্লাপুর)-এসব এলাকায় ‘ক্লাস্টার’ বা গুচ্ছ আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
এর আগে মার্চ মাসের শেষের দিকে তিনি জানিয়েছিলেন, সীমিত আকারে কমিউনিটিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে বলে তারা দেখতে পাচ্ছেন। ঢাকার বাইরের অনেকগুলো জেলাতেও করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে নারী, পুরুষ, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ রয়েছে।
বুধবার আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিবিসিকে বলেন, বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের দিক থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের মাঝামাঝিতে রয়েছে। ভাইরাসটি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়লেও সেটা এখনো ক্লাস্টার আকারে রয়েছে।
সংক্রমণের প্রথম স্তর বলা হয়ে থাকে যখন দেশে কোন রোগী শনাক্ত না হয়। দ্বিতীয় স্তর বলা হয়, যখন বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত হয়। তৃতীয় স্তর হচ্ছে সীমিত আকারে সমাজে রোগটি ছড়িয়ে পড়া।
‘ক্রিটিক্যাল’ এপ্রিল
বার্তা সংস্থা বাসসের খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী প্রলয় সৃষ্টি করেছে। সারাবিশ্বে যেভাবে করোনা রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের এখানে বৃদ্ধি পাওয়ার একটা ট্রেন্ড আছে। তাতে আমাদের সময়টা এসে গেছে, এপ্রিল মাসটা। এই সময় আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।’ এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশে নতুন করে ৫৪ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৪১ জন। তার আগের দিন ছিল ৩৫ জন। গতকালও (৮ এপ্রিল) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগের দিন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল পাঁচজন। দেশটিতে বুধবার পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০ জন। সামাজিক সংক্রমণ এড়াতে মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলাকে লকডাউন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকার ভেতরেও বেশ কয়েকটি এলাকা লকডাউন বলে ঘোষণা করা হয়। লকডাউন করা এসব এলাকায় কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবেন না। বুধবার থেকে লকডাউন করা হয়েছে কক্সবাজার জেলাকেও। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব এলাকায় একাধিক রোগী শনাক্ত হওয়ায় সংক্রমণ ঠেকাতে এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ২৬ মার্চ থেকে যে সাধারণ ছুটি শুরু হয়েছিল, তা বাড়ানো হয়েছে এপ্রিলের ১৪ তারিখ পর্যন্ত। এ সময় সবরকম যানবাহন, নৌযান, বিমান ও রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। মানুষজনের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনীও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিবিসিকে বলছেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের এই এপ্রিল মাসটা খুব ক্রিটিক্যাল।’ তিনি বলছেন, ‘ঢাকা শহরেই বেশিরভাগ পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জেও বেশ কিছু রোগী পাওয়া গেছে। এরকম যেসব স্থানে বেশি রোগী পাওয়া গেছে, সেসব এলাকা লকডাউন করে রোগটি সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটা যদি ঠিকভাবে করা যায় তাহলে আমরা বেঁচে যাব।’ তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস কন্ট্রোল করতে হলে সেটা এই এপ্রিল মাসের মধ্যেই করতে হবে। এর চেয়ে বেশি সময় দেয়া যাবে না। আমরা যদি সেটা করতে না পারি, ব্যর্থ হই, তাহলে অবস্থা খুব খারাপ হবে। তখন লম্বা সময় ধরে আমাদের করোনাভাইরাস পুষতে হবে। তাই এই এপ্রিল মাসটা খুব ক্রিটিক্যাল।’ তিনি বলছেন, এখন সব কিছু বন্ধ রয়েছে, সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও যদি রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে পরে আর নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, যে হারে রোগী শনাক্ত হচ্ছে, সংক্রমণের যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এক কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (ব্যাপক জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণ) বলতে বাধা নেই। রোগী আরও বাড়ার আশঙ্কা
বাংলাদেশের মতো আর্থিক অবস্থার দেশ ভারতে চার সপ্তাহের পর থেকে রোগী বাড়তে শুরু করে। তবে বাংলাদেশে যেখানে ১৬টি কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরু হতেই এক মাস লেগে যায়, ভারতে সেটি করা হয় ৬২টি কেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী বলছেন, ‘আমরা ৩০ দিনের দিনে যে অবস্থায় আছি, ব্রাজিল ১৫ দিনের দিন সেই অবস্থায় ছিল। মানে একশো দেড়শ রোগী শনাক্ত করার হচ্ছিল। আর ভারতেও এ রকম ছিল ৪৫তম দিনের দিন। ব্রাজিলে সেই অবস্থা থেকে আজ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। আর ভারতে রোগীর সংখ্যা ৫ হাজারের কাছাকাছি। সুতরাং ভারতের সাথেও তুলনা করলে বোঝা যায়, আমাদের রোগীর সংখ্যা আগামী কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো কয়েক হাজারে পৌঁছে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা আছে।’ চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব দেশে প্রথম দিকে করোনাভাইরাসে যে হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে, চার সপ্তাহের পরপর পরিস্থিতির রাতারাতি অবনতি হয়েছে। রোগী সংক্রমণ ও মৃত্যু হারও অনেক বেড়ে গেছে। ‘পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে- একই রকমের ভৌগলিক ও পরিবেশ, আচরণ অবস্থা বিবেচনায় - ভারতের সাথে তুলনা করলে, তাদের মতো ট্রেন্ড আমাদের এখানে দেখা দিতে পারে’, বলছেন অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী। তিনি সংশয় প্রকাশ করেন যে, সে রকম পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুতির এখনো অনেক ঘাটতি আছে। ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি আমরা পূরণ করতেও পারি, পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারটি নিয়ে- ঘাটতি যদি নাও বলি- এখনো আমাদের চিন্তার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। কতটি ভেন্টিলেটর, কতটি আইসিইউ, কতটি হাসপাতাল অক্সিজেন থেরাপির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আছে, সেটা জানা গেলে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের প্রস্তুতি বোঝা যাবে।’ ‘কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে চিকিৎসক বলেন, আইসিইউ বলেন, অক্সিজেন থেরাপি বলেন, এগুলো আসলে শেষ অস্ত্র। আমাদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে লকডাউন। সেটা আমরা যতভাবে করতে পারব, স্বাস্থ্য খাতের ওপর ততই কম চাপ পড়বে।’ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, ‘রোগী বাড়ার সম্ভাবনা যেহেতু আছে, তাই পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর জোর দেয়ার উচিত। শুধু করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিতে হবে।’ আরও সমন্বয় দরকার
রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ বলছেন, এখন যে রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কোথায় কোথায় গেছেন, কি করেছেন, তাদের বাড়িতে কে এসেছেন, কোন দোকানে গেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করা, সেগুলো জানা দরকার। ‘এ জন্য স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে নিয়ে টিম গঠন করা দরকার। সেই ঝুঁকি কমাতে কি ব্যবস্থা নেয়া দরকার, কাদের কোয়ারেন্টিন করতে হবে, সেগুলো ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’ তিনি বলছেন, রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে হলে লকডাউনের পাশাপাশি এসব দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এর ফলে সংক্রমণের হারটা কমানো যাচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয় এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি বলছেন। তিনি বলছেন, যারা শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের ঠিকভাবে চিকিৎসা করা, সংক্রমিতদের সীমাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি জরুরি। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ সুরক্ষার ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে হাসপাতালগুলো বা চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে শুরু করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অনেক হুমকি তৈরি করবে। তৃতীয় আর চতুর্থ স্তরের মাঝামাঝি
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, ‘এখনো বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বিস্তার ক্লাস্টার আকারে (ছোট ছোট গ্রুপের মধ্যে) রয়েছে। সেটা কমিউনিটি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বলবো না। তবে কিছু কিছু রোগী আমরা পাচ্ছি, যাদের সংক্রমণের উৎস শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা আসলে এটা ট্রান্সজিশন পিরিয়ডের ভেতরে রয়েছি। তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরে (যখন ব্যাপক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ দেখা দেয়) যারা লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরে চলে গেছি সেটি আমি বলবো না।’ তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ সবচেয়ে জরুরি। তারা যদি নিয়মকানুন মেনে বিচ্ছিন্ন থাকেন,ঘরে থাকেন, তা হলেই এটা রোধ করা সম্ভব হবে। এবিএন/সাদিক/জসিম
বার্তা সংস্থা বাসসের খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী প্রলয় সৃষ্টি করেছে। সারাবিশ্বে যেভাবে করোনা রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের এখানে বৃদ্ধি পাওয়ার একটা ট্রেন্ড আছে। তাতে আমাদের সময়টা এসে গেছে, এপ্রিল মাসটা। এই সময় আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।’ এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশে নতুন করে ৫৪ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৪১ জন। তার আগের দিন ছিল ৩৫ জন। গতকালও (৮ এপ্রিল) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগের দিন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল পাঁচজন। দেশটিতে বুধবার পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০ জন। সামাজিক সংক্রমণ এড়াতে মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলাকে লকডাউন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকার ভেতরেও বেশ কয়েকটি এলাকা লকডাউন বলে ঘোষণা করা হয়। লকডাউন করা এসব এলাকায় কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবেন না। বুধবার থেকে লকডাউন করা হয়েছে কক্সবাজার জেলাকেও। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব এলাকায় একাধিক রোগী শনাক্ত হওয়ায় সংক্রমণ ঠেকাতে এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ২৬ মার্চ থেকে যে সাধারণ ছুটি শুরু হয়েছিল, তা বাড়ানো হয়েছে এপ্রিলের ১৪ তারিখ পর্যন্ত। এ সময় সবরকম যানবাহন, নৌযান, বিমান ও রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। মানুষজনের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনীও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিবিসিকে বলছেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের এই এপ্রিল মাসটা খুব ক্রিটিক্যাল।’ তিনি বলছেন, ‘ঢাকা শহরেই বেশিরভাগ পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জেও বেশ কিছু রোগী পাওয়া গেছে। এরকম যেসব স্থানে বেশি রোগী পাওয়া গেছে, সেসব এলাকা লকডাউন করে রোগটি সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটা যদি ঠিকভাবে করা যায় তাহলে আমরা বেঁচে যাব।’ তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস কন্ট্রোল করতে হলে সেটা এই এপ্রিল মাসের মধ্যেই করতে হবে। এর চেয়ে বেশি সময় দেয়া যাবে না। আমরা যদি সেটা করতে না পারি, ব্যর্থ হই, তাহলে অবস্থা খুব খারাপ হবে। তখন লম্বা সময় ধরে আমাদের করোনাভাইরাস পুষতে হবে। তাই এই এপ্রিল মাসটা খুব ক্রিটিক্যাল।’ তিনি বলছেন, এখন সব কিছু বন্ধ রয়েছে, সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও যদি রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে পরে আর নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, যে হারে রোগী শনাক্ত হচ্ছে, সংক্রমণের যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এক কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (ব্যাপক জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণ) বলতে বাধা নেই। রোগী আরও বাড়ার আশঙ্কা
বাংলাদেশের মতো আর্থিক অবস্থার দেশ ভারতে চার সপ্তাহের পর থেকে রোগী বাড়তে শুরু করে। তবে বাংলাদেশে যেখানে ১৬টি কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরু হতেই এক মাস লেগে যায়, ভারতে সেটি করা হয় ৬২টি কেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী বলছেন, ‘আমরা ৩০ দিনের দিনে যে অবস্থায় আছি, ব্রাজিল ১৫ দিনের দিন সেই অবস্থায় ছিল। মানে একশো দেড়শ রোগী শনাক্ত করার হচ্ছিল। আর ভারতেও এ রকম ছিল ৪৫তম দিনের দিন। ব্রাজিলে সেই অবস্থা থেকে আজ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। আর ভারতে রোগীর সংখ্যা ৫ হাজারের কাছাকাছি। সুতরাং ভারতের সাথেও তুলনা করলে বোঝা যায়, আমাদের রোগীর সংখ্যা আগামী কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো কয়েক হাজারে পৌঁছে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা আছে।’ চীন, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব দেশে প্রথম দিকে করোনাভাইরাসে যে হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে, চার সপ্তাহের পরপর পরিস্থিতির রাতারাতি অবনতি হয়েছে। রোগী সংক্রমণ ও মৃত্যু হারও অনেক বেড়ে গেছে। ‘পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে- একই রকমের ভৌগলিক ও পরিবেশ, আচরণ অবস্থা বিবেচনায় - ভারতের সাথে তুলনা করলে, তাদের মতো ট্রেন্ড আমাদের এখানে দেখা দিতে পারে’, বলছেন অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী। তিনি সংশয় প্রকাশ করেন যে, সে রকম পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুতির এখনো অনেক ঘাটতি আছে। ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি আমরা পূরণ করতেও পারি, পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারটি নিয়ে- ঘাটতি যদি নাও বলি- এখনো আমাদের চিন্তার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। কতটি ভেন্টিলেটর, কতটি আইসিইউ, কতটি হাসপাতাল অক্সিজেন থেরাপির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত আছে, সেটা জানা গেলে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের প্রস্তুতি বোঝা যাবে।’ ‘কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে চিকিৎসক বলেন, আইসিইউ বলেন, অক্সিজেন থেরাপি বলেন, এগুলো আসলে শেষ অস্ত্র। আমাদের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে লকডাউন। সেটা আমরা যতভাবে করতে পারব, স্বাস্থ্য খাতের ওপর ততই কম চাপ পড়বে।’ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, ‘রোগী বাড়ার সম্ভাবনা যেহেতু আছে, তাই পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর জোর দেয়ার উচিত। শুধু করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিতে হবে।’ আরও সমন্বয় দরকার
রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ বলছেন, এখন যে রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কোথায় কোথায় গেছেন, কি করেছেন, তাদের বাড়িতে কে এসেছেন, কোন দোকানে গেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করা, সেগুলো জানা দরকার। ‘এ জন্য স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে নিয়ে টিম গঠন করা দরকার। সেই ঝুঁকি কমাতে কি ব্যবস্থা নেয়া দরকার, কাদের কোয়ারেন্টিন করতে হবে, সেগুলো ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’ তিনি বলছেন, রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে হলে লকডাউনের পাশাপাশি এসব দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এর ফলে সংক্রমণের হারটা কমানো যাচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয় এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি বলছেন। তিনি বলছেন, যারা শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের ঠিকভাবে চিকিৎসা করা, সংক্রমিতদের সীমাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি জরুরি। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ সুরক্ষার ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে হাসপাতালগুলো বা চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে শুরু করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অনেক হুমকি তৈরি করবে। তৃতীয় আর চতুর্থ স্তরের মাঝামাঝি
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, ‘এখনো বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বিস্তার ক্লাস্টার আকারে (ছোট ছোট গ্রুপের মধ্যে) রয়েছে। সেটা কমিউনিটি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বলবো না। তবে কিছু কিছু রোগী আমরা পাচ্ছি, যাদের সংক্রমণের উৎস শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা আসলে এটা ট্রান্সজিশন পিরিয়ডের ভেতরে রয়েছি। তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরে (যখন ব্যাপক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ দেখা দেয়) যারা লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরে চলে গেছি সেটি আমি বলবো না।’ তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ সবচেয়ে জরুরি। তারা যদি নিয়মকানুন মেনে বিচ্ছিন্ন থাকেন,ঘরে থাকেন, তা হলেই এটা রোধ করা সম্ভব হবে। এবিএন/সাদিক/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ