আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

শিবচরের এক ইতালিফেরত প্রবাসী যেভাবে ৬ জনকে সংক্রমিত করেন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২০, ১৫:৩৮

দেশে এখন পর্যন্ত যে ২৭ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষ চিহ্নিত হয়েছেন, তার সাতজনই একটি পরিবার থেকে এসেছেন। তারা মাদারীপুরের শিবচরের একজন ইতালিফেরত প্রবাসীর পরিবারের সদস্য এবং শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়স্বজন।

কীভাবে বিদেশফেরতদের জন্য জারি করা স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনের নির্দেশ লঙ্ঘন করে অসতর্ক চলাফেরা ও আচরণের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিটি এতগুলো মানুষকে সংক্রমিত করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ বিবিসিকে জানিয়েছেন একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

এই পরিবারটি সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার পরেই সরকারিভাবে শিবচরকে লকডাউন করবার সিদ্ধান্ত হয়।

শিবচরে এই সংক্রমণের শুরু হয় দুজন ইতালিফেরত প্রবাসীর মাধ্যমে। তারা মূলত দুজন বন্ধু। প্রথমেই তাদের দুজনকে কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরে তাদের আত্মীয়স্বজনকে পরীক্ষা করে দেখা যায়, একজনের বাবা, স্ত্রী, দুই সন্তান, শাশুড়ি এবং শ্যালকের স্ত্রীও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। শাশুড়ি, শ্যালকের স্ত্রী ও ইতালিফেরত একজন এখন মাদারীপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর বাকি পাঁচজন, অর্থাৎ ইতালিফেরত অন্য প্রবাসী, তার বাবা, স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায়।

শুরু থেকেই সরকারিভাবে বলা হয়ে আসছে, যারা বিদেশ থেকে আসছেন তাদের স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে। কিন্তু এই নির্দেশ কার্যকর করাটাই সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বিবিসিরই একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কীভাবে বিদেশফেরতরা বাংলাদেশে এসে অসচেতন এবং অসতর্কভাবে ঘোরাফেরা করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক জনসমাগমে হাজির থেকেছেন। এক শিবচরেই চলতি মাসে প্রায় ৭০০ প্রবাসী ফিরেছেন।

যে কর্মকর্তা বিবিসিকে শিবচরের এই সংক্রমণের তথ্য দিয়েছেন, তিনি বলছিলেন, হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষজনকে ঘরে আটকে রাখাটাই তাদের জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আজকেরই একটি উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, ‘এক বাড়িতে গিয়েছি, সে বাড়ির সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে আছে। সবার ঘরের ভেতরে থাকার কথা। কিন্তু ঢুকে দেখি সেখান থেকে একজন ফেরিওলা বের হচ্ছেন। বাড়ির সবাই এই ফেরিওলার কাছ থেকে কেনাকাটা করছেন।’

যে ব্যক্তিটি ছয়জনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছেন তার সম্পর্কে ওই কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, তিনি গত ৭ মার্চ বাংলাদেশে ফেরেন। এর একদিন পরেই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়ার খবর প্রকাশ হয়। এই খবর প্রকাশ হওয়ার পর সারা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়। কিন্তু ইতালিফেরত ওই ব্যক্তি তার বাড়ির এবং শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়দের সঙ্গে মেলামেশা অব্যাহত রাখেন। ১১ মার্চ ওই ব্যক্তিটির শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়। উপসর্গ দেখা দিলে তিনি মাদারীপুরের চিকিৎসকদের পরামর্শে ঢাকায় আসেন। ঢাকাতেই পরীক্ষায় তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত বলে ধরা পড়েন। সাথে সাথেই ঢাকা থেকে প্রতিনিধি দল শিবচরে যায় এবং তার পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টিন করে। ধীরে ধীরে পরিবারের বাকি সদস্যদের মধ্যেও উপসর্গ দেখা দেয় এবং তারা একে একে আক্রান্ত বলে পরিগণিত।

শিবচরের বর্তমান অবস্থা
ইটালি থেকে আসা দুজন ছাড়া সরকারি হিসাব অনুযায়ী শুধু শিবচরে ৬৮৪ জন লোক বিদেশ থেকে এসেছেন যাদের মধ্যে অনেকেই ১৪ দিন পার করেছে। ১৯ মার্চ যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মাদারীপুর ফরিদপুরে লকডাউনের সম্ভাবনার কথা বলেন সেদিন বিকেলেই শিবচর উপজেলার চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শামসুদ্দিন খান বিবিসিকে বলেন, শিবচর উপজেলায় শুধু ওষুধের দোকান এবং অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা থাকবে। এ ছাড়া বাকি সব কিছু বন্ধ থাকবে।

তিনি বলেন, পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এই লকডাউন চলবে। এ সময়ের মধ্যে শিবচর উপজেলায় থেকে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না এবং সেখান থেকে বেরও হতে পারবেন না।

মানুষ যাতে অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে রাস্তায় পুলিশি টহল থাকবে। অতি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় পাওয়া গেলে জেল-জরিমানা করা হবে বলে জানান তিনি।

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জায়গা যেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য লকডাউন করা হয়।

শিবচরের অবস্থা এখনো আগের মতোই বলছেন সহকারী পুলিশ সুপার, তবে তিনি বলছেন আগে যে দুজন ছিলেন তারা সুস্থ হয়ে উঠছেন। অনেক স্যাম্পল টেস্ট করা হয়েছে বলছেন তবে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো সংক্রমণ পাওয়া যায়নি।

তবে শিবচর থানার সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন বলছেন, আতঙ্ক আছে। ‘একটা জিনিস যেটা খালি চোখে দেখা যায়না, যারা সচেতন তাদের আতঙ্ক বেশি কিন্তু যারা অসচেতন তারা কিছু মনেই করছেন না।’

শিবচরের এই পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, তারা এটা নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করছে। আমরা অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু এই লোকগুলো একজন আরেকজনের বাড়ি যাবে না সেটা ভাবতেও পারছে না।

তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘অনেকের মধ্যেই ১৪ দিনে লক্ষণ দেখা যায়না। কিন্তু কারো ১৪ দিনে কোনো লক্ষণ দেখা গেল না কিন্তু পরিবারের কারো কাছে ছড়ায়, এর পর কিন্তু ২৮ দিনের ব্যাপার চলে আসে।’

শিবচর থানা কর্তৃপক্ষ যেহেতু সবার পরীক্ষা করতে পারছে না আলাদাভাবে, তাই নিজের পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছেন তারা।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ