পুরনো ঢাকা এখনও কতোটা ঝুঁকির মুখে আছে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:০৯

বাংলাদেশের পুরনো ঢাকার চুরিহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার এক বছর পরেও সেখানে এখনো কাটেনি নতুন কোন অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্ক। সেই ভয়াবহতার চিহ্ন বহন করছে চুরিহাট্টা মসজিদের পাশে আসগর লেন, নবকুমার দত্ত রোড এবং হায়দার বক্স লেন, এই তিনটি সরু রাস্তার মাঝখানে পুড়ে কালো হয়ে থাকা মুখোমুখি দুটো চার তলা ভবন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়ার মূলেই ছিল আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা রাসায়নিকের গুদাম।

শুক্রবার ঘটনাস্থলে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত জীবনের জন্য সার্বিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও পুরনো ঢাকাবাসী। গত বছরের ওই ঘটনায় ৭১ জন নিহত হয়েছিল।

সংবাদ সম্মেলনে এই রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণেরও জোর দাবি জানানো হয়েছে।

"আমাদেরকে তারা শুধু আশ্বাসে ভাসিয়ে রাখে"

অগ্নিকাণ্ডের মাত্র আট মিনিট আগে এর একটি ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান স্থানীয় এম এ রহিম। কিন্তু ভবনের ভেতরে পুড়ে মারা যান তার দুই ভাতিজাসহ কাছের মানুষ।

এর আগেও মি. রহিমসহ এলাকাবাসী বার বার সরকারের কাছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের কারাখানা ও গুদাম আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়ে আসলেও আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাননি।

"আমরা সরকারকে কতবার বলে আসছি আপনারা কেমিকেলগুলো সরান। সরকার ইচ্ছা করলে এক সপ্তাহের মধ্যে কেমিকেল কারখানাগুলো সরে যেতে বাধ্য। কিন্তু আমাদেরকে তারা শুধু আশ্বাসে ভাসিয়ে রাখে। কোন কথায় কান দেয় না," বলেন মি. রহিম।

"আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে"

চুরিহাট্টার এই দুর্ঘটনার পর এলাকাবাসীর দাবির মুখে সরকার রাসায়নিক গুদাম এবং কারখানাগুলো সরিয়ে নেয়ার অভিযান শুরু করলেও বাস্তবে দেখা যায় দাহ্য পদার্থের অনেক গুদাম এবং কারখানা এখনও চালু রয়েছে।

পুরনো ঢাকার প্লাস্টিক ব্যবসায়ী আসাদুর রহমান রিপন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের তালিকাভুক্ত দাহ্য রাসায়নিকগুলো দ্রুত সরিয়ে না নিলে যেকোনো সময় আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে।

"এই ভবনটায় একটা বডি স্প্রের গোডাউন ছিল। যেটা খুবই দাহ্য পদার্থ। উল্টাপাশেই ছিল আরেকটা কেমিকেলের গোডাউন।"

"পরে অভিযান হয়েছে, অনেক কারখানা সরেও গেছে, কিন্তু ওই যে গোডাউনগুলো স্প্রে/বডি স্প্রে সেগুলো বিভিন্ন ভবনের ভেতরে ভেতরে রয়ে গেছে। এগুলোই তো ঝুঁকি তৈরি করছে," বলেন মি. রহমান।

ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা ও গুদাম সরাতে আর কতো সময় লাগবে?

গত বছরের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পুরনো ঢাকায় প্রায় ২৫,০০০ রাসায়নিক এবং প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদাম আছে।

এগুলো সরাতে আরও চার থেকে ১০ মাসের মতো সময় লাগবে বলে জানান শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল হালিম। স্থানীয় এলাকাবাসী দৃশ্যত কোন পরিবর্তন হয়নি দাবি করলেও সরকার কাজ করছে বলে তিনি জানান।

"একটা উন্নয়ন প্রকল্প শুধু পাস হলেই হয় না। এখানে সরকারকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বিত হয়ে আইনানুযায়ী অনেকগুলো ধাপে কাজ করতে হয়।"

"জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। খতিয়ে দেখতে হয় জমির কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা। পরিবেশসহ বিভিন্ন সংস্থার ছাড়পত্র নিতে হয়।"

"সেখানকার পরিবেশ, যাতায়াত ব্যবস্থা সবকিছু বিবেচনা করেই তো কাজ চলে। এগুলো তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কমন মানুষের মনে হতে পারে কিছুই হচ্ছে না। আসলে কাজ চলছে ঠিকই।" বলেন মি. হালিম।

গত বছরের ওই দুর্ঘটনার পর পর পুরানো ঢাকা থেকে শুরু করে সব ধরণের আবাসিক ভবন থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে তিনটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা জানায় শিল্প মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে দুটি দ্রুত গতির প্রকল্প এবং তৃতীয়টি দীর্ঘমেয়াদী।

দ্রুততম প্রকল্পটির দুটির মধ্যে একটি নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকার শ্যামপুরে। সেখানে রাসায়নিক গুদামজাত করার জন্য ৫৪টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রকল্পটি হচ্ছে ঢাকার টঙ্গিতে। সেখানে মূলত অ্যাসিডের মতো রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। এর কাজ শেষ হতে এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

এছাড়া অন্যান্য রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নিতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় ৩১০ একর জায়গাজুড়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা জানান মি. হালিম।

প্রকল্পটি ইতোমধ্যে একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। সেখানকার সার্বিক কাজ শেষ হতে দুই বছর সময় লাগবে বলে তিনি জানান।

ঝুঁকির পেছনে দায়ী আরও যেসব কারণ

তবে এসব কেমিকেল কারখানা ও গুদামের পাশাপাশি পুরানো ঢাকাকে আরও দুটি কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

একটি হল দুর্ঘটনার পরবর্তী উদ্ধারকাজ চালানোর মতো প্রশস্ত রাস্তার অভাব এবং যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের নগর পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ইশরাত ইসলাম মনে করেন, আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল সরিয়ে নেয়ার সরকারি প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি পুরনো ঢাকার অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলোয় নজর দেয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, "এই ধরণের দুর্ঘটনা ঘটনার সবগুলো উপাত্ত পুরানো ঢাকায় এখনও বিদ্যমান। এক হল সেখানে রাসায়নিক কারখানা আছে। দ্বিতীয়ত কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে উদ্ধারকাজ চালানো খুব কঠিন। কারণ রাস্তা ভীষণ সরু।"

"ভবনগুলো একটার সাথে আরেকটা লাগানো, যার কারণে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক তার ও ট্রান্সফর্মারও খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব সমস্যার কথা আগেও বলা হয়েছে। কিন্তু ইমপ্লিমেন্টেশনে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি।"

এদিকে এ ধরণের দুর্ঘটনা এড়াতে যে কোন ধরণের রাসায়নিক উৎপাদন, মজুদ, বাজারজাত ও ব্যবহারের বিষয়ে সামগ্রিক একটি নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেন পরিবেশ বাচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ