আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ঢাকার রাস্তায় ও ফুটপাতে পায়ে হেঁটে চলার ৭ বিপদ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৪:৫৬

দেশে নাগরিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সরকার যখন প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় হাঁটা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে, তখন আমরা দেখার চেষ্টা করেছি, ঢাকায় পথচারীদের হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর আসলেই কোনো পথ আছে কি না? আর থাকলেও সেটা কতটা হাঁটবার উপযোগী? হাঁটতে গিয়ে পথচারী কী ধরনে বিপদ-আপদের মুখে পড়তে পারেন?

নোংরা ও দুর্গন্ধ
ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা বলে পরিচিত তেজগাঁও শিল্প এলাকা। দুপুর ১২টার দিকে, লিংক রোড পার হয়ে নাবিস্কো মোড় দিয়ে সাতরাস্তার মোড় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা হবে। এই রাস্তাটুকু একজন সুস্থ মানুষের পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগার কথা সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। কিন্তু এই রাস্তাটুকু পার হতে আমার সময় লেগেছে ৪৫ মিনিটের বেশি।

এর মধ্যে কয়েকবার ভাঙা-এবড়োথেবড়ো ফুটপাত, আর নোংরা ও দুর্গন্ধের কারণে রাস্তার একপাড়ের ফুটপাত ছেড়ে অপর পাড়ে যেতে হয়েছে।

তেজগাঁও এ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানা বলেন, ‘ফুটপাতে অনেক সময়ই দেখা যায় মানুষ প্রস্রাব করে, নোংরা ফেলে যায়, এগুলো দেখার কেউ নেই।’

পথচারীদের ধাক্কা
এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা হেঁটে যেতে পথচারীদের ধাক্কা হজম করতে হয়েছে কয়েকবার। ওই সময়ে একই রাস্তায় হাঁটছিলেন এমন কয়েকজন পথচারী নারীর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তারাও একই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন।

ছিনতাইয়ের ঝুঁকি
একটি বিস্কুট কারখানার মান-নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার বলেন, ‘হাঁটার সময় নিরাপত্তা একটা বড় সমস্যা, কারণ সন্ধ্যার পরই হাঁটার সময় অনেক জায়গায় আলো থাকে না, আমার নিজের দুইবার ছিনতাই হয়েছে এই ফুটপাতেই। ফলে আমি রাত হয়ে গেলেই আর হাঁটি না রাস্তায়।’

নারীদের বিপদ
সম্প্রতি ঢাকার একটি ব্যস্ত রাস্তায় বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করার পর ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। এ ঘটনাটি বাংলাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তুমুল প্রতিবাদ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী বলছিলেন, ‘শুধু রাস্তায় না, এমনকি বাসার সামনে হাঁটতে গেলেও রাস্তায় ইভটিজিং এর শিকার হতে হয় আমাদের। এজন্য বাসা থেকেও খুব একটা উৎসাহ দেয় না হাঁটার ব্যাপারে।’

ফুটপাতে যানবাহন
ঢাকার ফুটপাতে সাইকেল ও মোটরসাইকেল চলার দৃশ্যের সঙ্গে অনেকেই কমবেশি পরিচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নুরুন্নাহার সুবর্ণা বলছিলেন, ‘ফুটপাত থাকে অনেক সরু, বাড়ি ফেরার সময় দেখা যায় ওই সরু ফুটপাতেই আবার মোটর সাইকেল ওঠে, তার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়।’

দুর্ঘটনার আশঙ্কা
ঢাকাতে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন পথচারীরা। এসবের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।

ঢাকার রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের দুই পথচারী শিক্ষার্থী বাসের ধাক্কায় নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল শিক্ষার্থীরা। এসব বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী কয়েকদিন ধরে ঢাকা শহর অচল করে রেখেছিল, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে।

অবকাঠামো নির্মাণ
ফুটপাত সংলগ্ন অনেক অবকাঠামোই নির্মাণ প্রকল্পই দেখা যায় ঢাকায়, যেখানে ফুটপাত অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। আবার বহুতল নির্মাণ প্রকল্পগুলো এমনই ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলতে দেখা যায় যে অনেক পথচারীরই হয়তো সারাক্ষণ মনে হতে পারে যে, এই বুঝি মাথার ওপর একটি ইট এসে পড়লো। এ ছাড়া, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারের মতো মেগা নির্মাণ প্রকল্প এলাকাগুলোতে ফুটপাত ধরে যে হাঁটার জো থাকে না, এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহে অনেকেই একমত হবেন। এমনকি কোন কোন মেগা প্রকল্প এলাকায় এককালে ফুটপাত থাকলেও এখন এ ধরনের কিছুর অস্তিত্বই আর নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক দশকে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ক্রমে মানুষের মধ্যে হাঁটার প্রবণতা কমে গেছে। ফলাফল হিসেবে মানুষের মধ্যে স্থূলতাসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও আগের চেয়ে বেড়েছে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রায় ২০ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ এবং প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ শিশু স্থূলতা বা ওবেসিটিতে ভুগছে।

চিকিৎসক ডা. ফারহানা খানম বলছিলেন, স্থূলতার কারণে যেসব রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ অন্যতম। মানুষ তো এখন অনেক কম হাঁটে, এজন্য এখন এমনকি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও স্থূলতা দেখা যায়। স্থূলতা থেকে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া এখন শারীরিক নিস্ত্রিয়তার কারণে মানুষ টাইপ-টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় বেশি, এ থেকে মানুষের শরীরের অনেক প্রত্যঙ্গে যেমন চোখ বা শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সরকারের উদ্যোগ কী?
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, পথচারীদের হাঁটার ব্যবস্থার করার জন্য ফুটপাথ দখলমুক্ত, সড়কবাতির সংখ্যা বাড়ানো এবং শহরের পার্ক দখলমুক্ত করার নানা ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে।

তবে সেসব উদ্যোগের অনেকগুলোই যে সফল হয়নি, সেটিও স্বীকার করেছেন তিনি

‘ঢাকা দক্ষিণ সিটির রাস্তায় আমরা ৪২ হাজার দুইশর বেশি সড়কবাতি লাগিয়েছি। এছাড়া গুলিস্তান, মতিঝিল এবং নিউমার্কেটের ফুটপাত দখলমুক্ত করার চেষ্টা করেছি কয়েকবার। তবে সমস্যা হলো দখলমুক্ত করার দুয়েকদিনের মধ্যেই সেগুলো আবার দখল হয়ে যায়। একবার সবোর্চ্চ নয়মাস দখলমুক্ত রাখতে পেরেছিলাম আমরা, এর পর আর পারিনি।’

ফুটপাথ এবং পার্ক দখলমুক্ত করার পর সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত নজরদারিতে না রাখলে, ভবিষ্যতেও সেগুলো বেশিদিন দখলমুক্ত রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন মেয়র সাঈদ খোকন।

তিনি জানিয়েছেন, ঢাকার মোট ৩১টি পার্ক ও খেলার মাঠকে দখলমুক্ত করার কাজ চলছে। এর মধ্যে ১২টি পার্ক ও খেলার মাঠ  ইতোমধ্যেই নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ