আজকের শিরোনাম :

ট্রাম্পের প্রস্তাব 'শতকের সেরা' নাকি জুয়া?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২০, ১৮:০০

হোয়াইট হাউজের পরিবেশ সংবাদ সম্মেলনের তুলনায় যেন একটি পার্টি হয়ে উঠেছিল। আয়োজক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিশেষ অতিথি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেন একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো মনে হচ্ছিল। তাদের চারপাশে থাকা অতিথিরা হাততালি দিচ্ছিলেন।

ইসরায়েলের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা করেছেন, সেজন্য হাততালির বড় অংশটি ছিল তার জন্য। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েলের ১৯৪৮ সালের স্বাধীনতা দিবসের মতোই এই দিনটাকে স্মরণে রাখা হবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য তিনি নতুন একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন। ইসরায়েল যে নিরাপত্তা চায়, সেটা তারা পাবে আর ফিলিস্তিনিরা যে রাষ্ট্র চাইছে, তারা সেটাও পাবে।

এ পর্যন্ত সব ঠিকই- কিন্তু সমস্যা হলো, মি. ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ইসরায়েলের জন্য সবকিছুই রয়েছে আর ফিলিস্তিনিদের জন্য সামান্যই প্রস্তাব করা হয়েছে।

এমন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কথা প্রস্তাব করা হয়েছে যার যথাযথ সার্বভৌমত্ব থাকবে না, চারদিকে ইসরায়েলের ভূখণ্ড দ্বারা বেষ্টিত থাকবে আর সবসময়েই ইহুদি বসতি বিস্তারের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।

শান্তি একবারই সম্ভব বলে মনে হয়েছিল

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো কোনরকম সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বাস করেন যে, তিনি 'শতবছরের মধ্যে সবচেয়ে সেরা প্রস্তাব' করেছেন। মি. নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের জন্য এটা চমৎকার একটি প্রস্তাব।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে বছরের পর বছর ধরে শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সবসময়েই প্রাধান্য ছিল ইসরায়েলের ইচ্ছা, সীমাবদ্ধতা এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো। কিন্তু একের পর এক প্রেসিডেন্ট মেনে নিয়েছেন যে, শান্তির জন্য দরকার ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি টেকসই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র, এমনকি যদি দুই রাষ্ট্রের সমান সার্বভৌমত্ব নাও থাকে।

ইসরায়েল যুক্তি দিতে চায় যে, বেশ কিছু ভালো প্রস্তাবেও রাজি হয়নি ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনি আলোচকরা বলেন, তারা অনেক ছাড় দিয়েছে। এমনকি তাদের নিজেদের মাতৃভূমির ৭৮ শতাংশ জায়গায় ইসরায়েলকে মেনে নিয়েছে।

প্রায় ৩০ বছর আগে একবার শান্তিচুক্তির কাছাকাছি গিয়েছিল আলোচনা। নরওয়েতে উভয় পক্ষের একের পর এক গোপন আলোচনার পর, ১৯৯৩ সালে হোয়াইট হাউজের লনে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সভাপতিত্বে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অসলো শান্তি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়ে ওঠে।

ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন নেতা আইজ্যাক রবিন এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনের নেতা ইয়াসির আরাফাত আর লড়াই না করে শান্তি আলোচনা অব্যাহত রাখার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

দুই চিরশত্রু পরস্পরের করমর্দন করেন। রবিন, আরাফাত এবং ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ পরবর্তীতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

এটা ছিল একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র মেনে নেয়। ইসরায়েলিরা মেনে নেয় যে, ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে।

কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তাতে ফাটল ধরে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে ইসরায়েলের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি বলে বর্ণনা করেন। দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি তৈরির কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয় ইসরায়েলিরা। কোন কোন ফিলিস্তিনি, যেমন শিক্ষাবিদ এডওয়ার্ড সাইদ অসলো শান্তি চুক্তিকে 'আত্মসমর্পণ' বলে নিন্দা করেন।

ফিলিস্তিনি জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস, দ্যা ইসলামিক রেজিট্যান্স মুভমেন্ট ইহুদিদের হত্যা করার জন্য আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী পাঠায় এবং চুক্তিকে নাজুক করে তোলে।

ইসরায়েলের পরিস্থিতিও খারাপ হয়ে ওঠে। আইজ্যাক রবিনকে তার কয়েকজন সহযোগী নাৎসিদের চেয়েও খারাপ বলে নিন্দা করেন এবং বিক্ষোভের সময় তাকে এসএসের অফিসার হিসাবে চিত্রিত করেন। ১৯৯৫ সালের চৌঠা নভেম্বর ইহুদি উগ্রপন্থীদের দ্বারা তাকে হত্যার মাধ্যমে কয়েকমাসের উত্তেজনার অবসান ঘটে।

আত্মসমর্পণের দলিল

আইজ্যাক রবিনের হত্যাকারী চেয়েছিল যেন শান্তি প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যায়। তার ভাবনা ছিল, এর জন্যে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, যে ব্যক্তি সেটি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছেন, তাকেই নির্মূল করে দেয়া। তিনি ঠিকই ভেবেছিলেন।

তবে আইজ্যাক রবিন যদি বেঁচেও থাকতেন, তাহলেও অসলো চুক্তিটি হয়তো ব্যর্থ হতো। ছোটখাটো অনেক কারণ থেকে যার পেছনে জেরুজালেমের মতো অনেক বড় কারণও রয়েছে।

উভয় পক্ষের নেতারা সমঝোতার চেয়ে দ্বন্দ্বকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। সেই সঙ্গে রয়েছে ইসরায়েলের অব্যাহত দখল আর ফিলিস্তিনিদের সহিংস বিরোধিতা।

ঘোষণাটি এমন সময়ে দিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা মি. ট্রাম্প এবং মি. নেতানিয়াহুর জন্য রাজনৈতিক এবং আইনগত, উভয় দিক থেকেই সুবিধাজনক হয়েছে। দুইজনেরই সামনে নির্বাচন রয়েছে।

সেই সঙ্গে ইমপিচমেন্ট, অপরাধ ও বেআইনি কাজের অভিযোগে সেনেটে শুনানির কারণে চাপের মধ্যে রয়েছেন মি. ট্রাম্প। দুর্নীতি, ঘুষগ্রহণ এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগের মুখে রয়েছেন মি. নেতানিয়াহু।

আমেরিকার শক্তি বাড়ানোর কোন সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বিশ্বাস করেন যে, আমেরিকার সামরিক শক্তি এবং অর্থনীতি তাকে তার ইচ্ছা প্রয়োগ করার ক্ষমতা দিয়েছে।

অতীতে পুরোপুরি শান্তি অর্জন করা যায়নি, এমন সব পুরনো ধ্যানধারণাকে ধ্বংস করে দিয়ে নতুন পথে হাঁটতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব প্রস্তাবনার মধ্যে বেশ কিছু অস্বস্তিপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যেমন জাতিসংঘের ২৪২ রেজ্যুলিশনে বলা হয়েছে যে, যুদ্ধের মাধ্যমে দখল করা কোন ভূমি অধিগ্রহণ করা যাবে না অথবা আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে যে, কেউ দখল করা জমিতে বসতি তৈরি করতে পারবে না।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব ঘোষণার পর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিয়েছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনি অধিকার ও আশা বিক্রির জন্য নয়।

আসলে ফিলিস্তিনিদের বলে দেয়া হয়েছে, হয় তোমরা এটা গ্রহণ করো না হলে চলে যাও। তাদেরকে একটি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, ইসরায়েল বিজয়ী হয়েছে এবং তার আমেরিকান বন্ধুরা ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে দিচ্ছে।

ফিলিস্তিনিরা যদি এটা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলেও ইসরায়েলের যা পাবার, সেটা তারা পেয়ে গেছে এবং তারা হয়তো আরো খারাপ হবে।

সম্ভাবনা রয়েছে যে, ফিলিস্তিনিরা আরো ক্ষুব্ধ, বেপরোয়া এবং আশাহীন হয়ে উঠতে পারে। উত্তেজনাপ্রবণ এই বিশ্বে এটা খুবই বিপজ্জনক। বলা যায়, এই পরিকল্পনা দিয়ে আসলে জুয়া খেলছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ