পুতিনকে প্রেসিডেন্ট হতে সহায়তা করেছিলেন যিনি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:৪৫

যুগে যুগে রাশিয়ান শাসকরা বিভিন্ন উপায়ে ক্ষমতা অর্জন করেছেন। শাসকরা জন্মসূত্রেই এই ক্ষমতা পান। ভ্লাদিমির লেনিন এই ক্ষমতা অর্জন করেন বিপ্লবের মাধ্যমে; সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারিরা দলের সিঁড়ি বেয়ে নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়ে শীর্ষ পদে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন।

তবে ২০ বছর আগে ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্রেমলিনে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সোভিয়েত নিরাপত্তা সংস্থার (কেজিবি)  এই সাবেক কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিন এবং তার অভ্যন্তরীণ চক্র বেছে নিয়েছিলেন একবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।

ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন ভ্যালেন্টাইন ইউমাশেভ। ক্রেমলিন কর্মকর্তা হয়ে ওঠা এই সাবেক সাংবাদিক খুব কমই সাক্ষাতকার দিয়েছেন, কিন্তু তিনি বিবিসির সংবাদ দাতার সাথে দেখা করতে এবং তার গল্প বলতে সম্মত হয়েছেন।

ইউমাশেভ ছিলেন বরিস ইয়েলতসিনের অন্যতম বিশ্বস্ত সহকারী- তিনি ইয়েলতসিনের মেয়ে তাতয়ানাকে বিয়ে করেন। ইয়েলতসিনের চিফ অব স্টাফ হিসেবে ইউমাশেভ ১৯৯৭ সালে পুতিনকে ক্রেমলিনে প্রথম কাজ দেন।

ইউমাশেভ বলেন, ‘ইয়েলতসিনের বিদায়ী প্রশাসনের প্রধান আনাতোলি চুবাইস আমাকে বলেছেন যে তিনি এমন একজন শক্তিশালী ম্যানেজারকে চেনেন, যিনি আমার জন্য একজন ভাল সহকারী তৈরি করে দেবেন। তিনি আমাকে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং আমরা একসাথে কাজ শুরু করি। আমি সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলাম যে পুতিন কতোটা দুর্দান্ত পারদর্শী। যেকোনো আইডিয়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিংবা যেকোনো ঘটনার বিশ্লেষণ ও যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি ভীষণ দক্ষ ছিলেন।’

এরপর বিবিসির সংবাদদাতা জিজ্ঞাসা করেন যে, কখন তার মনে হয়ে হয়েছিল এই লোকটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে পারে?- এমনটা ভাবার কোনো বিশেষ কারণ ছিল?

ইউমাশেভ বলেছেন, ইয়েলতসিনের মনে বেশ কয়েকটি প্রার্থীর নাম ছিল, যেমন বরিস নিমটসভ, সের্গেই স্টেপাশিন এবং নিকোলাই আকসেনেনকো। ইয়েলতসিন এবং আমি সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের নিয়ে অনেক আলোচনা করি। এক পর্যায়ে আমাদের মধ্যে পুতিনকে নিয়েও আলোচনা হয়।

ইয়েলতসিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,  ‘পুতিন সম্পর্কে আমার ধারণা কী?’
জবাবে আমি বলেছি যে, তিনি একজন দুর্দান্ত প্রার্থী বলে আমি মনে করি। আমার মনে হয় আপনার তার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। পুতিন যেভাবে তাঁর কাজগুলো করেন সেটা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে তিনি আরও কঠিন কাজের জন্য প্রস্তুত আছেন।

পুতিনের কেজিবির অতীত কি তাকে ছেড়ে দিয়েছিল?
‘কেজিবির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার পর পুতিনের মতো অনেক কেজিবি কর্মকর্তা সংস্থাটি ছেড়ে দেন। এর অর্থ তার সাবেক কেজিবির পরিচয় কোন অর্থ বহন করে না। পুতিন নিজেকে উদার এবং গণতান্ত্রিক হিসাবে উপস্থাপন করেন, যিনি বাজার সংস্কার চালিয়ে যেতে চেয়েছেন।’

গোপন উত্তরাধিকার
১৯৯৯ সালের অগাস্টে, বরিস ইয়েলতসিন ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এটি একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়েলতসিন পুতিনকে ক্রেমলিনের জন্য প্রস্তুত করছিলেন।

ইয়েলতসিনের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ আরও এক বছর থাকলেও ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি তাড়াতাড়ি ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে চমকে দেন।

ইউমাশেভ বলেন, ‘নববর্ষের তিন দিন আগে, ইয়েলতসিন পুতিনকে তার দেশের বাসভবনে ডাকেন। তিনি আমাকে এবং তার নতুন চিফ অব স্টাফ আলেকজান্ডার ভোলোশিনকে উপস্থিত থাকতে বলেন। পুতিনকে মি. ইয়েলতসিন বলেন যে তিনি জুলাই অবধি ক্ষমতায় থাকবেন না। সামনের ৩১ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করবেন। আমি, ভোলোশিন, পুতিন এবং ইয়েলতসিনের মেয়ে তাতিয়ানা এই হাতে গোনা কয়েকজন এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন। এমনকি ইয়েলতসিন তার স্ত্রীকেও এ বিষয়ে কিছু বলেননি।

ইউমাশেভকে, ইয়েলতসিনের পদত্যাগের বক্তব্য লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

‘তার এই বক্তব্য লেখা বেশ কঠিন ছিল। কারণ এটি স্পষ্ট ছিল যে এই লেখাটি ইতিহাসে থেকে যাবে। কেননা এই বক্তব্য ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই আমি সেই বিখ্যাত লাইনটি লিখেছি 'আমাকে ক্ষমা করুন ’।

‘১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ানদের সেই ধাক্কা ও চাপ সহ্য করতে হয়েছিল। এজন্য ইয়েলতসিনকে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা ছিল বেশ জরুরি।’

নতুন বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের প্রাক্কালে, বরিস ইয়েলতসিন তার চূড়ান্ত টেলিভিশন ভাষণটি ক্রেমলিনে রেকর্ড করেন।

‘সেখানে উপস্থিত সবার জন্য এই ঘোষণা ছিল বিশাল এক ধাক্কার মতো। একমাত্র আমি বক্তব্য লেখার কারণে অবাক হইনি। সবাই সেই ঘোষণা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। খুবই আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেটি। তবে খবরটি ফাঁস না হওয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরকারি ঘোষণাটি প্রচারের জন্য তখনও ৪ ঘণ্টা সময় বাকি ছিল। তাই গোপনীয়তা রক্ষায় ওই রেকর্ড রুমের সমস্ত লোককে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। তাদেরকে কোথাও যেতে দেওয়া হয়নি। আমি টেপটি নিয়ে টিভি স্টেশনে যাই। ভাষণটি মধ্যাহ্নে প্রচারিত হয়েছিল।’

ভ্লাদিমির পুতিন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন। ৩ মাস পরে তিনি নির্বাচনে জয় লাভ করেন।

‘দ্য ফ্যামিলি’র সদস্য?
ভ্যালেন্টাইন ইউমাশেভকে প্রায়শই দ্য ফ্যামিলির সদস্য হিসাবে উল্লেখ করা হয় : এই ফ্যামিলি বা পরিবার বলতে বরিস ইয়েলতসিনের অভ্যন্তরীণ গণ্ডির মধ্যে থাকা কয়েক জনকে বোঝানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে ওই কয়েকজন ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ইয়েলতসিনের ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল।

ইউমাশেভ ‘দ্য ফ্যামিলি’কে ‘একটি মিথ, একটি মনগড়া আবিষ্কার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে সন্দেহ নেই যে, ১৯৯০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট ইয়েলতসিনের স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার সাথে সাথে ক্রেমলিন নেতা তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বের সংকীর্ণ গণ্ডির ওপর তাঁর আস্থা রেখেছিলেন।

‘পুতিনের অনুগামী লোকজন তার ওপর ওই ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে না।’ - এমনটাই মনে করেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ভ্যালেরি সোলোভেই।

‘পুতিন দুই ধরনের লোকেদের সামনে ঝুঁকে থাকেন: প্রথমত, তার শৈশবের বন্ধুদের সামনে, যেমন রোটেনবার্গ ভাই এবং যারা সোভিয়েত কেজিবিতে সেবা দিয়েছিলেন। তবে তিনি তাদের আনুগত্যে গলে যান না। ইয়েলতসিন তার পরিবারের সদস্যদের উপর আস্থা রেখেছিলেন। পুতিন কারও উপর নির্ভর করেন না।

‘কোনো আফসোস নেই- রাশিয়ানরা পুতিনের ওপর আস্থা রেখেছেন’
পুতিন ২০ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় রয়েছেন। সেই সময় থেকে, তিনি এমন একটি ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছেন যা তাকে ঘিরে আবর্তন করে। তার অধীনে, রাশিয়া একটি ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সীমিত।

‘ইয়েলতসিন বিশ্বাস করেন যে তাঁর একটি মিশন ছিল এবং পুতিনেরও তাই আছে, সলোভেই বলেছেন। ইয়েলতসিন নিজেকে ত্রাতা মুসা হিসাবে দেখছেন, তিনি তার দেশকে কমিউনিস্ট দাসত্ব থেকে বের করে এনে শাসন করতে চেয়েছিলেন। পুতিনের মিশন হল, অতীতে ফিরে আসা। তিনি সোভিয়েতের পতনকে ‘বিংশ শতাব্দীর বৃহত্তম ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয়’ উল্লেখ করে তার প্রতিশোধ নিতে চাইছেন। তিনি এবং তাঁর রাজপরিবারের সাবেক কেজিবি কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংস পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার কাজ ছিল।

ইউমাশেভ বলেন, আজকের ভ্লাদিমির পুতিনকে কেউ উদারনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে চেনেন না।

এ অবস্থায় বিবিসির সংবাদদাতা প্রশ্ন রাখেন, তাহলে, পুতিনের সাবেক বস কি তাকে এই ক্ষমতা দেওয়ার জন্য এখন আফসোস করছেন?

ইউমাশেভ জবাবে বলেন, ‘আমার কোনো আফসোস নেই,’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ানরা এখনো পুতিনের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন।’

তবুও, ইউমাশেভ মনে করেন যে বরিস ইয়েলতসিনের পদত্যাগ করা সব রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের জন্য একটি শিক্ষা হিসাবে কাজ করবে, শিক্ষাটি হলো, পদত্যাগ করা এবং অল্প বয়সীদের জন্য পথ তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েলতসিনের জন্য এটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
খবর বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ