নেটো সামরিক জোট কি এখনো প্রয়োজন?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:১৬
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তর আটল্যান্টিক নিরাপত্তা জোট বা নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, যার সংক্ষিপ্ত নাম নেটো। স্নায়ু যুদ্ধের শুরুর দিকে এ ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সমন্বিত সুরক্ষা দেয়া।
৭০ বছর পরে এসে, একটি পরিবর্তিত বিশ্ব যেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সুরক্ষার অগ্রাধিকার রয়েছে সেখানে কি এটি এখনো প্রাসঙ্গিক?
সম্প্রতি নেটোর ভেতরকার পরিস্থিতিই আর আগের মতো নেই। খোদ সংস্থাটি কিংবা এর সদস্যভুক্ত অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও তুরস্ক।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ২৯ সদস্যের এই জোট মঙ্গল এবং বুধবার লন্ডনে বৈঠকে বসছে। যদিও জোটের সদস্যরা একে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে সফল সামরিক জোট হিসেবেই উল্লেখ করে থাকেন, তবুও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নেটো কীভাবে গঠিত হয়েছিল?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইউরোপের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে গঠন করে নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা নেটো। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করা। যুদ্ধের অন্যতম বিজয়ী হওয়ায়, পূর্ব ইউরোপজুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ সেনা রয়ে যায়। পূর্ব জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর আধিপত্য পায় মস্কো। যুদ্ধের পর জার্মানির রাজধানী বার্লিন দখলে নেয় বিজয়ীরা এবং ১৯৪৮ সালের মধ্যভাগে, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্ট্যালিন পশ্চিম বার্লিনের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু করেন। সে সময়ে ওই এলাকা ছিল তৎকালীন মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পুরো এলাকাটি অবস্থিত ছিল সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানিতে। শহরটির সাথে বিমান যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তবে এই সংকট সোভিয়েত শক্তিকে মোকাবেলায় একটি জোট গঠনে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং আরও ১১টি দেশ (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, আইসল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ) মিলে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠন করে। ১৯৫২ সালে তুরস্ক ও গ্রিসকে সদস্য করার মাধ্যমে জোটটি আরও প্রসার লাভ করে। ১৯৫৫ সালে যুক্ত হয় পশ্চিম জার্মানি। ১৯৯৯ সাল থেকে এটি সাবেক পূর্বাঞ্চলীয় জাতি রাষ্ট্রগুলোকেও সদস্য করে এবং জোটভুক্ত মোট দেশের সংখ্যা হয় ২৯। সবশেষ ২০১৭ সালে সদস্য হয় মন্টিনিগ্রো। নেটোর উদ্দেশ্য কী?
দাপ্তরিকভাবে নেটো গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘উত্তর আটল্যান্টিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও কল্যাণ’ নিশ্চিত করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ‘স্বাধীনতা, অভিন্ন ঐতিহ্য এবং সভ্যতার’ রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা। চুক্তি অনুযায়ী, নেটোভুক্ত যে কোনো দেশের ওপর সশস্ত্র হামলা হলে সেটি জোটভুক্ত সব দেশের ওপর হামলা বলেই গণ্য হবে এবং সব দেশ একে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। বাস্তব ক্ষেত্রে, জোটটি এটা নিশ্চিত করে যে, ‘ইউরোপিয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা অবিচ্ছেদ্যভাবে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর নিরাপত্তার সাথে জড়িত।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সাম্যবাদকে জোটটি তাদের বড় হুমকি মনে করত। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে নেটোর সীমান্ত মস্কোর দিকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে জোটটি সাবেক সোভিয়েত স্যাটেলাইট জাতিকে নিজেদের সদস্য হিসেবেই গণ্য করে। যেহেতু এখন ইউএসএসআর নেই, তা হলে নেটো এখনো টিকে আছে কেন?
স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই- তার মানে এই নয় যে পশ্চিমারা মস্কোকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করে দেবে। ‘কেউ-ই হঠাৎ করে বিশ্বাস করেনি যে কমিউনিজমের অনুপস্থিতি একটি দুঃশ্চিন্তামুক্ত পরিস্থিতি, একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করেছে যেখানে মিত্র শক্তিরা কোনো ধরনের সশস্ত্র বাহিনী ছাড়াই থাকবে, বা সুরক্ষা ছাড়াই বসবাস করতে পারবে,’ ২০০৩ সালে দেয়া এক ভাষণে জনপ্রিয় এই উক্তিটি করেছিলেন নেটোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেমি শেয়া। বাস্তবে রাশিয়া সামরিকভাবে শক্তিশালী রয়ে যায়। আর যুগোস্লাভিয়ার পতনের পর ১৯৯০ সালে খোদ ইউরোপেই যুদ্ধ দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে নেটোর ভূমিকা পরিবর্তিত হয়ে এটি হস্তক্ষেপকারী জোটে পরিণত হয়েছে। যার উদাহরণ মেলে বসনিয়া এবং কসোভোয় সার্বিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা, নৌপথে প্রতিরোধ এবং শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে। ২০০১ সালে নেটো প্রথম ইউরোপের বাইরে তাদের অভিযান চালায়। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর আফগানিস্তানে জাতিসংঘের নির্দেশনায় যৌথ বাহিনীর কৌশলগত নেতৃত্ব নেয় নেটো। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, উপদেশ এবং সহযোগিতার উদ্দেশ্যে এখনো পর্যন্ত দেশটিতে নেটোর নেতৃত্বে ১৭ হাজার সেনা রয়েছে। নেটোভুক্ত দেশগুলো কেন পরস্পর বিতর্কে জড়াচ্ছে?
নেটোর কড়া সমালোচনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালে যখন তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন, তখন রিপাবলিকানরা নেটোকে ‘বিলুপ্ত’ ঘোষণা করেছিল এবং তিনি বলেছিলেন যে, জোটটি ‘ভেঙে গেলেও’ সমস্যা হবে না। ট্রাম্প আভাসও দিয়েছিলেন যে, হামলার কবলে পড়া মিত্র দেশগুলোকে রক্ষার অঙ্গীকার নাও মানতে পারে যুক্তরাষ্ট্র-এমনকি চুক্তি থেকে বের হয়েও যেতে পারে। তিনি অভিযোগও তুলেছিলেন যে, নেটোভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি অর্থ প্রতিরক্ষায় খরচ করে ওয়াশিংটন। ‘অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র নেটোর পেছনে বেশি ব্যয় করছে। এটা ঠিক নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়,’ ২০১৮ সালে এক টুইটে এ কথা বলেন তিনি। অবশ্য তার যৌক্তিক কারণও ছিল, নেটোভুক্ত সবগুলো দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই জোটটির ৭০ ভাগ ব্যয়ভার বহন করে (২০১৮ সালের হিসাব) এবং যদিও ২০১৪ সালে নেটোভুক্ত দেশগুলো একমত হয় যে, ২০২৪ সাল নাগাদ তারা তাদের জিডিপির ২% প্রতিরক্ষায় ব্যয় করবে, খুব কম সংখ্যক দেশই সেটা অর্জন করেছিল। তুরস্কের বিষয়টি কী?
তুরস্ক ১৯৫১ সাল থেকে নেটো সদস্য। অক্টোবরে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে জোটের মধ্যে একটি ফাটল তৈরি করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়- ইইউভুক্ত ২৮টি দেশের ২২টিই নেটোর সদস্য। এই তালিকায় ছিল ফ্রান্স, স্পেন ও যুক্তরাজ্য। এই দেশগুলো তুরস্কে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করত। কিন্তু মস্কোর সাথে আঙ্কারার ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ক ইতোমধ্যেই উত্তেজনা তৈরি করছিল। ওয়াশিংটনের আপত্তি সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার জন্য রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি সই করে। ২০১৩ সাল থেকেই তুরস্কের কাছে নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির চেষ্টা করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এরদোয়ান প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব আনার পর তা আর এগোতে পারেনি। প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হলে তুরস্ক নিজেই নিজেদের ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হতো। বারাক ওবামার প্রশাসনও এটি নাকচ করেছিল। এ কারণেই আঙ্কারা মস্কোর সাথে যোগাযোগ করে এবং তুরস্কের সরকার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয় করে। এর পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে আধুনিক ফাইটার জেট এফ-৩৫ উৎপাদনের যৌথ কর্মসূচি থেকে বাতিল করে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, এস-৪০০ চুক্তি এফ-৩৫ এর প্রযুক্তি সম্পর্কিত স্পর্শকাতর বিষয় রাশিয়ার হাতে চলে যেতে পারে। আরও বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, তুরস্কের ভূখণ্ডের মধ্যেই নেটোর ঘাঁটি রয়েছে এবং দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে সিরিয়ার কাছে আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ইনসারলিক বিমান ঘাঁটি রয়েছে। এ ছাড়া তুরস্ক হচ্ছে নেটোভুক্ত পাঁচটি ইউরোপীয় দেশগুলোর একটি যাদের ভূখণ্ডে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। আর ফ্রান্স?
ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রো বলেছেন যে নেটো হচ্ছে ‘অকার্যকর’ একটি জোট এবং নেটোকে সতর্ক না করেই সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে এই জোটের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার নিয়েও উদ্বেগ জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, হামলার সময় নেটোভুক্ত দেশগুলো পরস্পরের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসবে কিনা সে বিষয়েও সন্দিহান তিনি। ‘যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের দিক থেকে দেখতে গেলে নেটোর বাস্তবতা আসলে কি সেটি আমাদের পুনর্বিবেচনা করা উচিত,’ ম্যাক্রো বলেন। ‘সামরিক সামর্থ্য এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে ইউরোপকে অবশ্যই স্বায়ত্তশাসিত হতে হবে।’ ম্যাক্রোর এই সাক্ষাৎকারের পর আলোড়ন তৈরি হয় এবং এটি তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মেরকেলের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়। ‘বার বার আমাকে আপনার কাজের জন্য ভর্তুকি দিতে হয় যাতে করে আমরা একসাথে বসে আলাপ-আলোচনা করতে পারি,’ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ফরাসি নেতাকে এ কথা বলেন মেরকেল। ব্রেক্সিট কি সমস্যা তৈরি করতে পারে? যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে লন্ডনে নেটোর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যার ফলাফল অজানা। যুক্তরাজ্য এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার শর্ত নির্ধারণ করতে পারে নি-যাকে ব্রেক্সিট বলা হচ্ছে। বিদ্বেষপূর্ণ ব্রেক্সিট জোটের মধ্যে একটি মতবিরোধের কারণ হতে পারে। কারণ ইউরোপীয় ২৮ দেশের ২২টিই এই জোটের সদস্য। বর্তমানে নেটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষায় যুক্তরাজ্যের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। নেটোর ভবিষ্যৎ কী হবে?
এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর রয়েছে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে। ‘যত দিন রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব থাকবে ততদিন নেটো দরকার হবে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরোধের জন্য,’ চলতি বছরের শুরুর দিকে এনপিআর রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন নেটোর সাবেক উপ-মহাসচিব আলেক্সান্ডার ভার্শবো। ‘তাই আমার মনে হয়, আরও অন্তত কয়েক দশক এমনকি আরও ৭০ বছর ধরেও নেটো টিকে থাকতে পারে।’ সেই সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনার পরও মার্কিন কংগ্রেস গত জানুয়ারিতে দেশটিকে নেটো থেকে বেরিয়ে আসা ঠেকাতে এক প্রস্তাব পাসের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান-সবাই এই প্রস্তাবনার পক্ষে ভোট দিয়েছে, এর পক্ষে পরে ৩৫৭ ভোট আর বিপক্ষে মাত্র ২২টি ভোট পরে। নেটোর ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হয়তো এর অনেক সদস্যের আশার তুলনায় কিছুটা ফিকে হবে কিন্তু এটাই জোটটির শেষ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নয়।
খবর বিবিসি বাংলার এবিএন/সাদিক/জসিম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ইউরোপের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে গঠন করে নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা নেটো। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করা। যুদ্ধের অন্যতম বিজয়ী হওয়ায়, পূর্ব ইউরোপজুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ সেনা রয়ে যায়। পূর্ব জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশের ওপর আধিপত্য পায় মস্কো। যুদ্ধের পর জার্মানির রাজধানী বার্লিন দখলে নেয় বিজয়ীরা এবং ১৯৪৮ সালের মধ্যভাগে, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্ট্যালিন পশ্চিম বার্লিনের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু করেন। সে সময়ে ওই এলাকা ছিল তৎকালীন মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পুরো এলাকাটি অবস্থিত ছিল সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানিতে। শহরটির সাথে বিমান যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তবে এই সংকট সোভিয়েত শক্তিকে মোকাবেলায় একটি জোট গঠনে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং আরও ১১টি দেশ (যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, আইসল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গ) মিলে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গঠন করে। ১৯৫২ সালে তুরস্ক ও গ্রিসকে সদস্য করার মাধ্যমে জোটটি আরও প্রসার লাভ করে। ১৯৫৫ সালে যুক্ত হয় পশ্চিম জার্মানি। ১৯৯৯ সাল থেকে এটি সাবেক পূর্বাঞ্চলীয় জাতি রাষ্ট্রগুলোকেও সদস্য করে এবং জোটভুক্ত মোট দেশের সংখ্যা হয় ২৯। সবশেষ ২০১৭ সালে সদস্য হয় মন্টিনিগ্রো। নেটোর উদ্দেশ্য কী?
দাপ্তরিকভাবে নেটো গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘উত্তর আটল্যান্টিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও কল্যাণ’ নিশ্চিত করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ‘স্বাধীনতা, অভিন্ন ঐতিহ্য এবং সভ্যতার’ রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা। চুক্তি অনুযায়ী, নেটোভুক্ত যে কোনো দেশের ওপর সশস্ত্র হামলা হলে সেটি জোটভুক্ত সব দেশের ওপর হামলা বলেই গণ্য হবে এবং সব দেশ একে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। বাস্তব ক্ষেত্রে, জোটটি এটা নিশ্চিত করে যে, ‘ইউরোপিয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা অবিচ্ছেদ্যভাবে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর নিরাপত্তার সাথে জড়িত।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সাম্যবাদকে জোটটি তাদের বড় হুমকি মনে করত। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে নেটোর সীমান্ত মস্কোর দিকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে জোটটি সাবেক সোভিয়েত স্যাটেলাইট জাতিকে নিজেদের সদস্য হিসেবেই গণ্য করে। যেহেতু এখন ইউএসএসআর নেই, তা হলে নেটো এখনো টিকে আছে কেন?
স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই- তার মানে এই নয় যে পশ্চিমারা মস্কোকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করে দেবে। ‘কেউ-ই হঠাৎ করে বিশ্বাস করেনি যে কমিউনিজমের অনুপস্থিতি একটি দুঃশ্চিন্তামুক্ত পরিস্থিতি, একটি স্বর্ণযুগের সূচনা করেছে যেখানে মিত্র শক্তিরা কোনো ধরনের সশস্ত্র বাহিনী ছাড়াই থাকবে, বা সুরক্ষা ছাড়াই বসবাস করতে পারবে,’ ২০০৩ সালে দেয়া এক ভাষণে জনপ্রিয় এই উক্তিটি করেছিলেন নেটোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেমি শেয়া। বাস্তবে রাশিয়া সামরিকভাবে শক্তিশালী রয়ে যায়। আর যুগোস্লাভিয়ার পতনের পর ১৯৯০ সালে খোদ ইউরোপেই যুদ্ধ দেখা দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে নেটোর ভূমিকা পরিবর্তিত হয়ে এটি হস্তক্ষেপকারী জোটে পরিণত হয়েছে। যার উদাহরণ মেলে বসনিয়া এবং কসোভোয় সার্বিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা, নৌপথে প্রতিরোধ এবং শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে। ২০০১ সালে নেটো প্রথম ইউরোপের বাইরে তাদের অভিযান চালায়। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর আফগানিস্তানে জাতিসংঘের নির্দেশনায় যৌথ বাহিনীর কৌশলগত নেতৃত্ব নেয় নেটো। আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, উপদেশ এবং সহযোগিতার উদ্দেশ্যে এখনো পর্যন্ত দেশটিতে নেটোর নেতৃত্বে ১৭ হাজার সেনা রয়েছে। নেটোভুক্ত দেশগুলো কেন পরস্পর বিতর্কে জড়াচ্ছে?
নেটোর কড়া সমালোচনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালে যখন তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন, তখন রিপাবলিকানরা নেটোকে ‘বিলুপ্ত’ ঘোষণা করেছিল এবং তিনি বলেছিলেন যে, জোটটি ‘ভেঙে গেলেও’ সমস্যা হবে না। ট্রাম্প আভাসও দিয়েছিলেন যে, হামলার কবলে পড়া মিত্র দেশগুলোকে রক্ষার অঙ্গীকার নাও মানতে পারে যুক্তরাষ্ট্র-এমনকি চুক্তি থেকে বের হয়েও যেতে পারে। তিনি অভিযোগও তুলেছিলেন যে, নেটোভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি অর্থ প্রতিরক্ষায় খরচ করে ওয়াশিংটন। ‘অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র নেটোর পেছনে বেশি ব্যয় করছে। এটা ঠিক নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়,’ ২০১৮ সালে এক টুইটে এ কথা বলেন তিনি। অবশ্য তার যৌক্তিক কারণও ছিল, নেটোভুক্ত সবগুলো দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই জোটটির ৭০ ভাগ ব্যয়ভার বহন করে (২০১৮ সালের হিসাব) এবং যদিও ২০১৪ সালে নেটোভুক্ত দেশগুলো একমত হয় যে, ২০২৪ সাল নাগাদ তারা তাদের জিডিপির ২% প্রতিরক্ষায় ব্যয় করবে, খুব কম সংখ্যক দেশই সেটা অর্জন করেছিল। তুরস্কের বিষয়টি কী?
তুরস্ক ১৯৫১ সাল থেকে নেটো সদস্য। অক্টোবরে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে জোটের মধ্যে একটি ফাটল তৈরি করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়- ইইউভুক্ত ২৮টি দেশের ২২টিই নেটোর সদস্য। এই তালিকায় ছিল ফ্রান্স, স্পেন ও যুক্তরাজ্য। এই দেশগুলো তুরস্কে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করত। কিন্তু মস্কোর সাথে আঙ্কারার ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ক ইতোমধ্যেই উত্তেজনা তৈরি করছিল। ওয়াশিংটনের আপত্তি সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার জন্য রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি সই করে। ২০১৩ সাল থেকেই তুরস্কের কাছে নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির চেষ্টা করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এরদোয়ান প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব আনার পর তা আর এগোতে পারেনি। প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হলে তুরস্ক নিজেই নিজেদের ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হতো। বারাক ওবামার প্রশাসনও এটি নাকচ করেছিল। এ কারণেই আঙ্কারা মস্কোর সাথে যোগাযোগ করে এবং তুরস্কের সরকার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয় করে। এর পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে আধুনিক ফাইটার জেট এফ-৩৫ উৎপাদনের যৌথ কর্মসূচি থেকে বাতিল করে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, এস-৪০০ চুক্তি এফ-৩৫ এর প্রযুক্তি সম্পর্কিত স্পর্শকাতর বিষয় রাশিয়ার হাতে চলে যেতে পারে। আরও বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, তুরস্কের ভূখণ্ডের মধ্যেই নেটোর ঘাঁটি রয়েছে এবং দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে সিরিয়ার কাছে আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ইনসারলিক বিমান ঘাঁটি রয়েছে। এ ছাড়া তুরস্ক হচ্ছে নেটোভুক্ত পাঁচটি ইউরোপীয় দেশগুলোর একটি যাদের ভূখণ্ডে মার্কিন পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। আর ফ্রান্স?
ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রো বলেছেন যে নেটো হচ্ছে ‘অকার্যকর’ একটি জোট এবং নেটোকে সতর্ক না করেই সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে এই জোটের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার নিয়েও উদ্বেগ জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, হামলার সময় নেটোভুক্ত দেশগুলো পরস্পরের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসবে কিনা সে বিষয়েও সন্দিহান তিনি। ‘যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের দিক থেকে দেখতে গেলে নেটোর বাস্তবতা আসলে কি সেটি আমাদের পুনর্বিবেচনা করা উচিত,’ ম্যাক্রো বলেন। ‘সামরিক সামর্থ্য এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে ইউরোপকে অবশ্যই স্বায়ত্তশাসিত হতে হবে।’ ম্যাক্রোর এই সাক্ষাৎকারের পর আলোড়ন তৈরি হয় এবং এটি তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মেরকেলের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়। ‘বার বার আমাকে আপনার কাজের জন্য ভর্তুকি দিতে হয় যাতে করে আমরা একসাথে বসে আলাপ-আলোচনা করতে পারি,’ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী ফরাসি নেতাকে এ কথা বলেন মেরকেল। ব্রেক্সিট কি সমস্যা তৈরি করতে পারে? যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে লন্ডনে নেটোর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যার ফলাফল অজানা। যুক্তরাজ্য এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার শর্ত নির্ধারণ করতে পারে নি-যাকে ব্রেক্সিট বলা হচ্ছে। বিদ্বেষপূর্ণ ব্রেক্সিট জোটের মধ্যে একটি মতবিরোধের কারণ হতে পারে। কারণ ইউরোপীয় ২৮ দেশের ২২টিই এই জোটের সদস্য। বর্তমানে নেটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষায় যুক্তরাজ্যের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। নেটোর ভবিষ্যৎ কী হবে?
এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর রয়েছে রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের মধ্যে। ‘যত দিন রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব থাকবে ততদিন নেটো দরকার হবে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরোধের জন্য,’ চলতি বছরের শুরুর দিকে এনপিআর রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন নেটোর সাবেক উপ-মহাসচিব আলেক্সান্ডার ভার্শবো। ‘তাই আমার মনে হয়, আরও অন্তত কয়েক দশক এমনকি আরও ৭০ বছর ধরেও নেটো টিকে থাকতে পারে।’ সেই সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনার পরও মার্কিন কংগ্রেস গত জানুয়ারিতে দেশটিকে নেটো থেকে বেরিয়ে আসা ঠেকাতে এক প্রস্তাব পাসের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান-সবাই এই প্রস্তাবনার পক্ষে ভোট দিয়েছে, এর পক্ষে পরে ৩৫৭ ভোট আর বিপক্ষে মাত্র ২২টি ভোট পরে। নেটোর ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হয়তো এর অনেক সদস্যের আশার তুলনায় কিছুটা ফিকে হবে কিন্তু এটাই জোটটির শেষ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নয়।
খবর বিবিসি বাংলার এবিএন/সাদিক/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ