আজকের শিরোনাম :

বস্তিবাসীর আবাসন

‘রান্না, গোসল, টয়লেট সবখানেই লম্বা লাইন’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৩৪

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত সর্বশেষ ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকা শহরের দুই সিটি কর্পোরেশনে সাড়ে ৬ লাখের মতো মানুষ বস্তিতে বসবাস করছেন। এতদিন পর সেই সংখ্যা কততে দাঁড়িয়েছে সেটির নিশ্চিত তথ্য এখন না পাওয়া গেলেও সংখ্যা বাড়ছে, কারণ প্রতিদিন নতুন করে বহু মানুষ ঢাকায় আসছেন।

তাদেরও আশ্রয় মিলছে বস্তিতেই। যারা গৃহকর্মী থেকে শুরু করে গার্মেন্টস শ্রমিক, গাড়িচালক, দিনমজুর এমন নানা পেশায় নিযুক্ত।

অর্থনীতিতে এবং ঢাকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনে তাদের না হলেই নয়। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের জন্য কোন স্বাস্থ্যকর আবাসনের ব্যবস্থা নেই।

যেভাবে বাঁচেন বস্তিবাসীরা
ওজুফা আক্তার, ঢাকার কড়াইল বস্তিতে ১০ বছর ধরে থাকেন। গৃহকর্মীর কাজ করেন গুলশান আবাসিক এলাকায়। জন্মের পর থেকেই ভূমিহীন তার পরিবার। তাই আরও অনেকের মতো ঢাকার পথেই পাড়ি জমিয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, ‘ঘরবাড়ি নাই। পোলাপাইন মানুষ করতে পারি না। এই কারণে ঢাকা শহর আসলাম। দেখি যাই কিছু কইরা খাই।’

তার ঘরের মধ্যে বাতি না জ্বালালে কিছু দেখা যায়না কারণ কোনো জানালা নেই। একটা খাটে ৪ জন থাকেন।

গাদা করে রাখা হাঁড়ি-পাতিল, ছোট আলমারিসহ সংসারের সব কিছু। রাতের বেলায় কয়েকটি মুরগিও ঘরের ভেতরে খাঁচায় রাখা হয়।

এই বস্তিতে খুপরির মালিক ছাড়া বাকি সবঘর একই রকম। হাঁটতে হাঁটতে একটি গণ-রান্নাঘরে চোখে পড়ল।

দিনের রান্নার বর্ণনা করছিলেন শাহিনা বেগম। একটি মেসের জন্য রান্না করেন তিনি। বলছিলেন বস্তিতে সবাইকে প্রতিটি কাজের জন্য লম্বা লাইন দিতে হয়।

তিনি বলছেন, ‘ধরেন আমাদের এইখানে চারটা চুলা। যেমন ৪ জন ৪টা তরকারি বসাইছে। তাদের রান্না শেষ না হলে তো আমারে জায়গা দেবে না। একজনের পর একজন রান্না করে। অনেক সিরিয়াল দিতে হয়।’

তিনি বলছেন, এই অভিজ্ঞতা টয়লেট, গোসলখানা, পানির কল সবখানেই।

বস্তির সরু গলিতে দুজন পাশাপাশি কোনোরকমে হাঁটতে পারেন। এখানে সেখানে আবর্জনা। টয়লেট আর গোসল করার জায়গাগুলোর এতটাই করুণ অবস্থা সেদিকে তাকানো মুশকিল। এখানকার মানুষগুলোর এর বাইরে আরও কোনো উপায় নেই।

বস্তিবাসীদের ছাড়া চলে না শহুরে মানুষদের
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে বড় শহরগুলোয় সারা দেশের গ্রাম থেকে আসা বস্তিবাসী বা ভাসমান মানুষদের মধ্যে অর্ধেকই এসেছেন কাজের খোঁজে। বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম‌ই তাদের গন্তব্য। যখন আসেন তারা নানা পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন। এমন সব পেশায় তারা নিযুক্ত যাদের ছাড়া শহুরে ধনী ও মধ্যবিত্তের চলে না।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ‘সে হতে পারে আপনার আমার বাসার গৃহকর্মী, গাড়ির চালক বা পোশাক শ্রমিক। যাদের শ্রমের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। তাদের জন্য শহরের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে।’

ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ‘যেমন ধরুন তারা একটা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। সেটি আনুষ্ঠানিক কোন পদ্ধতিতে হচ্ছে না। সেজন্য তারা কাউকে না কাউকে তো টাকা দিচ্ছেন। কিংবা পানির লাইনের কথা যদি বলি, সেখানেও তার অর্থ যাচ্ছে। তারা যে ঘর ভাড়া দিচ্ছে সেখানে তাকে একজন মধ্যস্বত্বভোগীকে টাকা দিতে হচ্ছে। যারা এই ভাড়াটা নেয় তারা আবার প্রভাবশালী চক্রের সাথে জড়িত। এখানে একটা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ডাইমেনশন রয়েছে।’

তিনি বলছেন, অর্থের এই লেনদেন আনুষ্ঠানিকভাবে হলে এর মূল্যটা বোঝা যেত।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৬৫% বস্তিবাসী কাউকে না কাউকে ভাড়া দিয়ে থাকেন। ৯০%-এর মতো বস্তিবাসী বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন।

বেলতলা বস্তির তানিয়া আক্তার আড়াআড়ি ১০ ফিট আকারের ঘরের জন্য মাসে ২৫ শ টাকা ভাড়া দেন।

তিনি বলছেন, ‘যখন তখন ভাইঙ্গা দেয়ার কথা শুনি। ভাইঙ্গা দিলে কোথায় আশ্রয় নেব। ভয় লাগে।’

যে কারণে শহরে আসেন তারা
একরকম নিরাপত্তাহীনতা থেকেই ঢাকায় আসেন বস্তিবাসীরা। একই জরিপে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৩০% এসেছেন দারিদ্রের কারণে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নদী ভাঙনের কারণে এসেছেন বাকিরা। দেশের মোট বস্তিবাসীর প্রায় ৯০% ভূমিহীন। পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১৭শ নতুন মানুষ।

আভ্যন্তরীণ অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা রামরুর প্রধান অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকি বলছেন কাজের উৎস ও উন্নয়ন মূলত ঢাকা এবং চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হওয়ার কারণেই সংকট তৈরি হয়েছে।

তিনি বলছেন, পরিস্থিতি সামনে আরও জটিল হবে। সেবা দানকারীদের জন্য আমরা একটু যায়গাও রাখিনি। গবেষণা বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ অর্ধেকের বেশি লোক শহরে বসবাস করবে। গ্রাম শহর হয়ে যাবে সেজন্য নয় বরং মানুষ শহরমুখি হচ্ছে বলেই এটা হবে। এই থেকেই আমরা বুঝতে পারি শহরের ওপরে যে চাপের প্রসঙ্গ, সেটা কতটা গভীর ও তীব্র।

তিনি বলছেন, ‘বেশিরভাগ মানুষের বস্তিতে এখন মানবেতর জীবন। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল নিরাপত্তা। মেয়েদের কথা একবার ভাবুন। তাদের অনেক সময় এমন জায়গায় রাত কাটাতে হয় যেখানে তাদের নিরাপত্তা ধাক্কার সম্মুখীন।’

বস্তির নিরাপত্তাহীন জীবন
কড়াইল বস্তিতে শরিয়তপুর থেকে আসা মাহফুজা আক্তার বলছেন, ‘ডর লাগে কারণ বস্তির ভিতরে অনেক খারাপ লোক আছে। দেখা গেছে স্বামী কাজে গেছে তখন একজন মানুষ আইসা সমস্যা করতে পারে। অনেক মানুষ একসাথে থাকে।’

যে নিরাপত্তাহীনতার কথা তিনি বলছেন তার অন্য আরও অনেক রূপ আছে। বাবা-মায়েরা কাজে গেলে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা।

বস্তি থেকে শিশু নারী পাচার ঝুঁকির কথা বলছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকি। রয়েছে অনেক বেশি অসুখ বিসুখের সম্ভাবনা। অপরাধমূলক কার্যক্রম।

প্রায়শই বস্তি উচ্ছেদের কথা শোনা যায়।

কড়াইল বস্তির ওজুফা আক্তার বলছেন, ‘আমার নিজের তোলা ঘর ছিল ওইপাশে। ঘর ভাইঙ্গা দিছে। এলাকার নেতারা এখন সেইখানে বাজার তুলছে। এখন ভাড়া থাকি।’

সম্মানজনক আবাসন কতটা সম্ভব?
শহরের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই বস্তির এই মানুষগুলোর জন্য সম্মানজনক আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কতটা সম্ভব?
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক আফসানা হক বলছেন, শহরের বর্তমান অবস্থার মধ্যেই সেটি সম্ভব।

তিনি বলছেন, ‘শহরের মধ্যে সেই জায়গা আছে। ঢাকায় অনেক বেশি দোতলা তিনতলা বাড়ি রয়েছে। সেখানে আমরা বহুতল ভবন করতে পারি। তারপর আরেকটা জিনিস হল বস্তিবাসীরা কিন্তু অনেকেই নানা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে। যেমন একটা বড় অংশই আছে যারা পোশাক শিল্পে কাজ করে। ওনাদের একত্র করে এই ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই কিন্তু থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে পারে। সোশাল হাউজিং চিন্তা করলেই এই মানুষগুলোকে সুন্দরভাবে থাকার জায়গা করে দেয়া সম্ভব।’

তিনি বলছেন, বড় শহরগুলোর আশপাশেও সোশাল হাউজিং তৈরি করা সম্ভব যা বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে।

সরকার কী করছে?
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে রয়েছে দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। সর্বশেষ নির্বাচনের আগে বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের কথাও বলা হয়েছে। শহরের বস্তিতে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সম্মানজনক আবাসন তৈরিতে কী করছে সরকার?

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলছেন, বেশ কিছু কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। যারা ছিন্নমূল বস্তিবাসী তাদের জন্য পরিপূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই আমরা ঢাকায় ক্যান্টনমেন্টের ধামালকোট এলাকায় বড় প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছি। ভাষানটেক বস্তির কাছে কাজ শুরু করেছি।

তিনি বলছেন, ‘এই আবাসনগুলো হলো ফ্ল্যাট হবে। সেখানে তারা এখন যে ভাড়া দেন সেরকম ভাড়ায় থাকবেন। গৃহহীনদের জন্য বাড়ি বানানো হচ্ছে। তাদের কোন আবাসন আছে কি না সেটি কঠোরভাবে যাচাই করে তারপর তাদের দলিল করে দেয়া হবে। যে পদ্ধতিতে সেটা করা হচ্ছে তাতে অন্য কেউ এর সুযোগ নিতে পারবে না।’

কিন্তু ঢাকা ও বড় শহরগুলোকে নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছে বহু বছর ধরে। এমন পরিকল্পনাও হয়েছে অনেক।

ওজুফা আক্তারের মতো মানুষের কাছে তাই বিষয়টা হয়ত স্বপ্নের মতো। ১০ বছর ধরে তো বস্তিতেই থাকছেন।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ