আজকের শিরোনাম :

উৎস স্থানের চেয়ে ঢাকায় কেন ইলিশের দাম কম

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৮:০১

বরিশালের মেয়ে লাভলী আক্তার ঢাকায় এক জোড়া ইলিশ মাছ কিনেছিলেন ১৬০০ টাকা দিয়ে। কয়েকদিন পরে তিনি গ্রামের বাড়ি বাকেরগঞ্জে গিয়ে গিয়ে দেখতে পান, একই আকৃতির একজোড়া ইলিশ সেখানে বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকায়।

''আমি খুব অবাক হলাম। কারণ এসব জায়গা থেকেই তো ইলিশ ধরে ঢাকায় পাঠানো হয়। অথচ সেখানে ইলিশ মাছের দাম কম, আর যেখানে ইলিশ ধরা পড়ছে, সেখানে মাছের দাম এতো বেশি!''
এরকম অভিজ্ঞতা শুধু তার একার নয়।

ঢাকার কাঠালবাগান মাছ বাজারের একজন ক্রেতা নাজমা আনোয়ার বলছেন, দুইদিন আগে তিনি এক কেজি ওজনের একেকটি ইলিশ মাছ কিনেছেন ৯০০ টাকা কেজি দরে।

অপরদিকে ঝালকাঠির একজন ক্রেতা তৈমুর হোসেন বলছেন, সেখানে এখন এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা কেজি হিসাবে।

এসব ইলিশ নদী বা সাগর থেকে ধরার পর, বরফ দিয়ে, ট্রলার বা ট্রাকে করে বহু পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকার মতো শহরগুলোয় বিক্রি করা হয়।

কিন্তু যেখানে ধরা পড়ছে, ঢাকার তুলনায় সেসব উৎস স্থানে কেন ইলিশের দাম চড়া?

উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙতে চলেছে বাংলাদেশের ইলিশ

ইলিশ এলাকার চেয়ে ঢাকায় কেন দাম কম?

বরগুনার পাথরঘাটায় ইলিশ মাছের ব্যবসা করেন মজনু হোসেন। তিনি পাইকারি দরে ইলিশ কিনে ঢাকায় পাঠান।

তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই ইলিশের মোকামে [ব্যবসার জন্য নির্ধারিত স্থান] মূলত দুই ধরণের ইলিশ মাছ আসে। একটি নদী থেকে ধরা ইলিশ মাছ, যেগুলো আশেপাশের বড় বড় নদী, যেমন পশুর নদী, বলেশ্বর নদী ইত্যাদি থেকে ধরা হয়।

এগুলো আসলে ধরার দিনেই আড়তে চলে আসে। স্বাদও বেশি। এগুলো একটু চড়া দামে বিক্রি করা হয়। এই মোকামে এগুলোর কেজি বিক্রি হয় ৭৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৯০০ টাকার মধ্যে। ইলিশ বেশি বড় হলে দামও একটু বেশি হয়।

আরেকটি হচ্ছে সাগর থেকে ধরা ইলিশ। জেলেরা ট্রলার নিয়ে ১০/১৫দিন সাগরে থেকে অনেক মাছ বরফ দিয়ে নিয়ে একবারে ফিরে আসে। এসব মাছের দাম তুলনামূলক কম। যেমন বড় ইলিশেরই দাম ৪০০/৫০০ টাকা কেজি। পরিবহন খরচ যোগ করার পরেও এই ইলিশ ঢাকায় ৫০০/৬০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। তিনি জানান, ঢাকায় মূলত এই ইলিশ মাছগুলোই কম দামে বিক্রি হয়।

আবার কোন কোন জেলে বা আড়তদার জেলেদের কাছ থেকে কিনে স্থানীয় বাজারে ইলিশ বিক্রি করেন। সংখ্যা কম হওয়ায়, নদীর মাছ আর তাজা হওয়ায় এসব ইলিশের দামও একটু বেশি হয়ে থাকে।

ইলিশ মাছের চেইন

ব্যবসায়ী মজনু হোসেন বলছেন, স্থানীয় বাজারে আসলে ইলিশ কম যায়। কারণ হিসেবে তিনি জানান, জেলেদের সাথে দাদনদারদের চুক্তি থাকায় তারা সরাসরি সব মাছ আড়তে দিয়ে যায়। আবার আড়তদাররা সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি না করে বরফ দিয়ে সেগুলো ঢাকায় বা অন্যান্য শহরে পাঠিয়ে দেন।

"ফলে কাছের নদী থেকে ধরা হলেও, এখানকার মাছ স্থানীয় বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না।'' এর ফলে অল্প যা পাওয়া যায়, তার মূল্য খুব চড়া থাকে।

নদী থেকে ধরা ইলিশ মাছগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকরা কিনে নেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশ মাছ ধরার জেলেদের সঙ্গে স্থানীয় আড়ত ব্যবসায়ীদের চুক্তি থাকে। সে অনুযায়ী তারা অমৌসুমের সময় জেলেদের অর্থ সাহায্য করেন। ইলিশ ধরার জাল ও খরচ দেন। শর্ত থাকে, ধরে আনা ইলিশ শুধুমাত্র তাদের কাছেই বিক্রি করতে হবে।

এই পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ থাকে ঢাকার পাইকারি ইলিশ বিক্রেতাদের। অনেক সময় ঢাকার বড় পাইকারি বিক্রেতা ও রপ্তানিকারকরা এই আড়ত মালিকদেরও আগাম অর্থ দিয়ে থাকেন।

ফলে ইলিশ ধরার পর জেলেরা এই আড়ত মালিকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের আগাম নেয়া অর্থের সমন্বয় করেন। এরপর আড়ত মালিকরা বরফ দিয়ে সেসব মাছ সরাসরি ঢাকার পাইকারি বিক্রেতা এবং রপ্তানিকারকদের কাছে পাঠিয়ে দেন।

যেহেতু পুরো প্রক্রিয়াটি আগাম অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে ঘটে থাকে, তাই এসব ইলিশ ক্রয়-বিক্রয়ও বাজারের দামের চেয়ে কিছুটা কম দরে হয়।

'স্থানীয় বাজারে ইলিশ নেই'

যেসব স্থানে ইলিশ ধরা পড়ে, সেখানকার স্থানীয় বাজারে অনেক সময় ইলিশ কম পাওয়া যায়।

শরীয়তপুরের একজন বাসিন্দা শাহরিয়ার হোসেন বলছেন, ''নদী থেকেই মাছগুলো আড়তদারদের আড়তে চলে যায়। সেখান থেকে বরফ দিয়ে চাঁদপুর, ঢাকা ইত্যাদি অঞ্চলে চলে যায়। আমাদের বাজারে মাছ ওঠে অনেক কম।''

ব্যবসায়ী মজনু হোসেন বলছেন, ইলিশ ধরার এলাকাগুলোয় এই প্রক্রিয়ার ফাঁক গলে অল্প কিছু ইলিশ বাজারে ওঠে। ফলে সেখানে দামও থাকে তুলনামূলক বেশি।

ইলিশের 'সিন্ডিকেট'

বিভিন্ন স্থান থেকে ইলিশ মাছ সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করেন একজন উদ্যোক্তা প্রবীর কুমার সরকার।

তিনি বলছেন, যেসব স্থানে ইলিশ ধরা পড়ে, সব জায়গাতেই সেখানে ইলিশের একটা 'সিন্ডিকেট' আছে। সেই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে ইলিশ কেনাবেচা করা যায় না।

তিনি বলছেন, ঢাকায় যেসব ইলিশ মাছ পাওয়া যায়, তার বড় একটি অংশ আসে কোল্ড স্টোরেজ থেকে, যেগুলো সাধারণত ঈদের মতো সময়ে সস্তায় কিনে রাখা ইলিশ।

''এছাড়া মিয়ানমার থেকে আসা ইলিশ, সাগরে ধরা ইলিশ কিনতে খরচ কম পড়ে বলে সেগুলো বাজারেও কম দামে বিক্রি করা যায়। পরিবহন খরচ যোগ করার পরেও সব মিলিয়ে এগুলোর দাম কমই পড়ে।''

''ঢাকার ক্রেতারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনটা সাগরের, কোনটা নদীর বুঝতে পারেন না। ফলে ক্রেতাদের কাছে বিক্রেতারা এসব ইলিশ অনেক কম দামে বিক্রি করতে পারে, যা একজন সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে ধরা কঠিন,'' বলছেন মি. সরকার।

তিনি জানান, ইলিশের বড় একটি মোকাম চাঁদপুর, যেখানে বরিশাল, ভোলা, চট্টগ্রামসহ নানা জায়গার ইলিশ আসে। নদীর ভালো আর তাজা ইলিশগুলো এই ঘাট থেকেই রপ্তানির জন্য বেশি দামে বিক্রি হয়ে যায়। এমনকি এখান থেকে ইলিশ নিয়ে পদ্মার ইলিশ বলেও মাওয়ায় বিক্রি করা হয়।

এখানে সাগরের, মিয়ানমারের বা চট্টগ্রামের ইলিশের দাম কম থাকে। আবার নদীর মাছের দাম বেশি হয়।

''কিন্তু এখানে আপনি যদি একটা-দুইটা ইলিশ কিনতে যান, তাহলে আপনাকে ঢাকার চেয়েও বেশি দাম দিতে হবে।"

কারণ এখানে বড় একটি সিন্ডিকেট আছে, যারা জেলেদের কাছ থেকে কম দামে কিনে নিতে পারে। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে কিনতে গেলে সেখানে দাম অনেক বেশি পড়বে।, বলেন তিনি।

এই পাইকারি মার্কেটের ফাঁক গলে সামান্য কিছু ইলিশ স্থানীয় বাজারে পৌছাতে পারে। ফলে সেখানে এর দাম হয় অনেক চড়া। তবে দাম বেশি হলেও এই মাছগুলো তরতাজা হয়ে থাকে।

ঢাকার অনেক পাইকারি বিক্রেতা বিভিন্ন ইলিশ এলাকার জেলে ও আড়তদারকে আগাম টাকা-পয়সা দিয়ে রাখেন। ফলে তারা যে ইলিশ পান, সেগুলো তারা এই পাইকারি ব্যবসায়ীদের পাঠিয়ে দেন। অনেক সময় এসবের দাম বাজার মূল্যের চেয়েও কম হয়ে থাকে। বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ