আজকের শিরোনাম :

আইএনএফ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া

বিশ্ব কি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার মুখে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০১৯, ১১:২০

স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে চলে আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক মিসাইল চুক্তি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

ঐতিহাসিক ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) ট্রিটি নামের ওই চুক্তিটি ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতারা স্বাক্ষর করেন।

গত কয়েক বছর ধরে ওয়াশিংটন অভিযোগ করছে যে, ওই চুক্তির শর্তের বাইরে গিয়ে রাশিয়া ক্রুজ মিসাইল তৈরি করছে।

শুক্রবার একটি বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, ‘আজ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। চুক্তিটি নষ্ট করার জন্য রাশিয়া পুরোপুরিভাবে দায়ী।’

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওই চুক্তিটি ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়াও এরপরে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তারাও চুক্তিটি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা স্থগিত করে।

এটি বাতিল হওয়ার ফলে বিশ্বজুড়ে মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে এবং আরো অনেক বিপজ্জনক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করবে।

ওই চুক্তি সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত বর্ণনা করা হচ্ছে। এ চুক্তিটি বাতিল হলে কীভাবে বিশ্বের জন্য মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিপজ্জনক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করবে?

আইএনএফ কী?
এটি হলো যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি। সে সময় দুই পরাশক্তি সম্মত হয়েছিল যে, তারা তাদের পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পন্ন সব মিসাইল ধ্বংস এবং ৫০০ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন মিসাইলগুলো স্থায়ীভাবে অকেজো করে ফেলবে।

ছোট আকারের, সহজে বহনযোগ্য এবং সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুতে সহজে আঘাত হানতে সক্ষম এসব অস্ত্রকে চরম হুমকি হিসেবে দেখা হতো, বলছেন বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা জোনাথন মার্কুইস।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে, পশ্চিম ইউরোপের নানা স্থানকে লক্ষ্যবস্তু করে এসএস-২০ মিসাইল মোতায়েন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফলে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন নেটো সামরিক জোটে থাকা অনেক দেশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

আইএনএফ চুক্তিটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
চুক্তিটির ফলে প্রথমবারের মতো পরাশক্তিগুলো তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা কমিয়ে আনতে সম্মত হয়। একটি ক্যাটেগরির সব পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্মস কন্ট্রোল এসোসিয়েশনকে অস্ত্রের ঘাটিগুলো পরিদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়।

ওই চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালের জুন মাসের মধ্যে সবমিলিয়ে ২৬৯২টি স্বল্পমাত্রার, মধ্যম মাত্রার এবং আন্ত মহাদেশীয় মিসাইল ধ্বংস করে।

এখন কেন সংকট তৈরি হলো?
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তোলে যে, ৯গ৭২৯ নামের নতুন ধরণের মিসাইল তৈরি করে রাশিয়া ওই চুক্তির লঙ্ঘন করছে, যা নেটোর কাছে এসএসসি-এইট নামে পরিচিত।

কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার এ ধরনের প্রায় ১০০ মিসাইল রয়েছে।

১ ফেব্রুয়ারিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে মাইক পম্পেও বলেছেন, ‘অনেক বছর ধরে কোনরকম বিকার ছাড়াই রাশিয়া ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস টিট্রির শর্তগুলো লঙ্ঘন করছে রাশিয়া। যদি স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলো মেনে না চলে, তা হলে এমন কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের মানে নেই।’

মস্কো বলছে, তাদের মিসাইলগুলো ৫০০ কিলোমিটারের কম যেতে সক্ষম। তাদের যুক্তি, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিরক্ষা মিসাইলগুলো রয়েছে, সেগুলোকে পরিবর্তন করে আক্রমণকারী মিসাইলে রূপান্তর করা সম্ভব, যা হয়তো রাশিয়ার বিপক্ষে ব্যবহৃত হতে পারে।

ওয়াশিংটন বলছে, মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি আইএনএফ চুক্তির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে তৈরি করা হয়েছে।

এটা কি তা হলে নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার শুরু?
বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা জোনাথন মার্কুইসের মতে, আইএনএফ চুক্তিটি বাতিল হওয়ার মানে- যা এক পুরো একটি বিশেষ ধরণের পারমাণবিক অস্ত্রের নির্মূল করে দিয়েছিল- বিশ্বের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের পিছিয়ে যাওয়া।

বিশ্লেষকদের মতে, ঐতিহাসিক এ চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেখা দিতে পারে।

মার্কুইসের মতে, এ চুক্তির অবসানের বিষয়টি বিশেষভাবে চিন্তার এই কারণে নতুনভাবে জেগে ওঠা রাশিয়ার হুমকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে উদ্বেগে রয়েছে।

‘মস্কো বা ওয়াশিংটন, কেউই ওই চুক্তিকে আর গুরুত্ব দিতে চাইছে না বলেই মনে হচ্ছে,’ মার্কুইস বলছেন।

থমাস কান্ট্রিম্যান, আর্মস কন্ট্রোল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান, বলছেন, ‘রাশিয়ার শর্ত লঙ্ঘনের জবাবে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসার পরে হয়তো এমন পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে, যা আশির দশকে দেখা গেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন একে অপরকে জবাব দিতে মিসাইল মোতায়েন করেছে।’

রাশিয়া কী বলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার আগে আগে মস্কো পরামর্শ দিয়েছে যে, চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্র যেন কিছু শর্ত বজায় রাখে।

রাশিয়ার তাস বার্তা সংস্থাকে দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় কোন অস্ত্র মোতায়েন না করে, তাহলে রাশিয়াও সে রকম আচরণ থেকে বিরত থাকবে।’

এই চুক্তিটি বাতিল আরও একটি কারণে উদ্বেগজনক। তা হলো স্টার্ট নামের একটি চুক্তি নবায়নের ডেটলাইন রয়েছে ২০২১ সালে, যা হয়তো সংকটে পড়তে পারে। ২০১০ সালের ওই চুক্তিতে দূরপাল্লার মিসাইলের সংখ্যা বেঁধে দেয়া হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া যদি সম্মত হয়, তা হলে নতুন স্টার্ট চুক্তিটি আরো পাঁচবছরের জন্য হতে পারে। কিন্তু অনেক বিশ্লেষকের আশঙ্কা, বর্তমান উদ্বেগজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিটি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

নিরাপত্তার ওপর কী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে?
ওয়াশিংটন এবং মস্কোর এই উত্তেজনায় যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার তুলনায় বেশি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে ইউরোপের নিরাপত্তার ওপর।

‘নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা যদি শুরু হয়, তাহলে ইউরোপিয়ানরা প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার নতুন অস্ত্রের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকবে,’ বলছেন মার্কুইস।

গত মাসে নেটোর মহাসচিব জেনারেল জেনস স্টলতেনবার্গ বিবিসিকে বলেছিলেন যে, রাশিয়ার মিসাইলগুলো পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম, সহজে বহন করা যায় আর সনাক্ত করা কঠিন। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেগুলো ইউরোপের শহরগুলোয় আঘাত হানতে সক্ষম।

তিনি বলেছেন, ইউরোপে ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল মোতায়েনের কোন পরিকল্পনা নেটোর নেই, কিন্তু প্রচলিত আকাশ ও মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নতুন কৌশল ও প্রস্তুতি, নতুন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সবভাবেই মোকাবেলা করা হবে।

‘আইএনএফ চুক্তি ছাড়া একটি বিশ্ব এবং আরও রাশিয়ান মিসাইলের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে’ তিনি বলেছেন।

চীন এবং অন্যান্য দেশের জন্য কী বার্তা?
অনেকে বলছেন, আইএনএফ চুক্তিটি যখন স্বাক্ষর করা হয়েছিল, তার পর বিশ্বের পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে।

জোনাথন মার্কুইস বলছেন, ‘হয়তো ওয়াশিংটন আর মস্কোকে নিয়ে দ্বিপাক্ষিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যুগ শেষ হতে চলেছে। চীন এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ছাড়াও আরও অন্তত ১০টি দেশের আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক মিসাইল রয়েছে।’

এসব দেশ কখনই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে পক্ষ হয়নি, ফলে তারা এ জাতীয় অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০২ সালে অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল ট্রিটি (এবিএম) থেকে বেরিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। তখন তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, ইরান বা উত্তর কোরিয়া দূরপাল্লার মিসাইল তৈরি করছে।
খবর বিবিসি

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ