আজকের শিরোনাম :

ডেঙ্গু পরিস্থিতি : মশা দিয়েই মোকাবেলা করা হচ্ছে মশা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০১৯, ১১:১২

মশা। আকারে ক্ষুদ্র হলেও অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে মারাত্মক এই কীট।

ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু- সবই বহন করে এ মশা। শুধু বহন করেই ক্ষান্ত হয় না, সামান্য এক কামড়ে এসব ছড়িয়ে দিতে পারে একজন থেকে আরেকজনের শরীরেও।

এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এডিস মশা। এর জন্ম আফ্রিকায়। ৪০০ বছর আগে। কিন্তু এর পর এটি পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সব এলাকায় এই মশাটি ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র এই প্রাণীটি পরিচিত ‘এশীয় টাইগার’ হিসেবে।

ওয়ার্ল্ড মসকিটো প্রোগ্রামের এক পরিসংখ্যান বলছে, মশার কারণে শুধু এক বছরে নানা রোগে আক্রান্ত হয় ৭০ কোটির মতো মানুষ। তাদের মধ্যে মারা যায় ১০ লাখেরও বেশি। বাংলাদেশেও প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

শুধু চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসেই এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজারের মতো মানুষ। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মারা গেছে ৮ জন। কিন্তু আশঙ্কা করা হয় এই সংখ্যা এর চেয়েও বেশি।

মশা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বছরের পর বছর ধরে মশক নিধনের জন্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও এডিস মশার কারণে যে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার সংক্রমণ ঘটে সেই মশা এখন মানুষের কাছে এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।

ফলে প্রশ্ন উঠেছে মশক নিধনের মতো কর্মসূচির কার্যকারিতা নিয়ে।

ঢাকায় যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে, যেভাবে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত বাড়িঘর ও পরিবেশ, তাতে শুধু ওষুধ স্প্রে করে আসলেই কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব?

এ কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ এখন দুটো বিকল্প উপায় বিবেচনা করছে। এজন্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারা এখন মশা মারতে কামান দাগানো নয় বরং মশা দিয়েই চাইছেন ‘ডেঙ্গু মশা’ মোকাবেলা করতে।

কমিটির কর্মকর্তারা যে দুটো উপায়ের কথা বিবেচনা করছেন-

এই দুটো পদ্ধতিই চীনে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে দুই বছর সময় ধরে। তাতে দেখা গেছে সেখানে মশার বংশ-বিস্তার ৯০ শতাংশের মতো কমে গেছে।

উবাকিয়া পদ্ধতি
উবাকিয়া একটি ব্যাকটেরিয়া, যা প্রকৃতিতেই থাকে। বিভিন্ন কীট-পতঙ্গের দেহকোষে এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় এবং ডিমের মাধ্যমে এটি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।

মজার ব্যাপার হলো, ৬০ শতাংশ কীট-পতঙ্গের দেহে এই উবাকিয়া থাকলেও এডিস মশার শরীরে এ ব্যাকটেরিয়া নেই।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এডিস মশার কোষে এ ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেখা গেছে যে, এর মাধ্যমে চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ও ইয়েলো ফিভারের মতো চারটি ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ওয়ার্ল্ড মসকিটো প্রোগ্রামের বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বিশদ গবেষণা করেছেন। ২০১১ সালে তারা সেখানে উবাকিয়া আছে এরকম মশা ছেড়ে দিয়ে দেখেছেন, স্থানীয় মশার সঙ্গে মিলিত হয়ে তারা এমন মশার প্রজনন ঘটিয়েছে যাদের দেহেও উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া আছে।

ফ্রুট ফ্লাই বা ফলমূলে বসে যেসব মাছি সেগুলোর কোষ থেকে সূক্ষ্ম একটি সুঁই দিয়ে তারা প্রথমে উবাকিয়া সংগ্রহ করেছেন। তার পর সেই ব্যাকটেরিয়া ইনজেক্ট করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এডিস মশার ডিমের ভেতরে।

এটি যে খুব সহজেই করা সম্ভব হয়েছে তা নয়। হাজার হাজার বার চেষ্টা করার পর বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত এটা করতে সক্ষম হন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূক্ষ্ম এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে তাদের সময় লেগেছে ১৫ বছর।

উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া ডিম থেকে জন্ম নেওয়া মশার শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করানোর পর বিস্ময়কর একটি ঘটনা ঘটে। বিজ্ঞানীরা দেখেন যে ভাইরাসটি ওই মশার ভেতরে ঠিক মতো বেড়ে উঠতে পারছে না।

অস্ট্রেলিয়ায় ১০ সপ্তাহ ধরে পরিবেশে এসব মশা ছাড়া হয়েছে। ছাড়া হয়েছে প্রতি সপ্তাহে একবার করে। কিন্তু কয়েক মাস পরেই দেখা গেছে, সেখানকার ১০০ ভাগ মশাতেই উবাকিয়া আছে এবং সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার পরে এই পদ্ধতি বিশ্বের ১২টি দেশে পরীক্ষা করে সাফল্য পাওয়া গেছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো।

কীভাবে কাজ করে
কোনো মশা যখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীকে কামড়ায় তখন ওই রোগীর রক্ত থেকে মশার পেটের ভেতরে চলে যায় ডেঙ্গু ভাইরাস। সেখানে তখন এমন একটি প্রক্রিয়া চলে যাতে ওই ভাইরাসটি মশার পেটের ভেতরে খুব দ্রুত বেড়ে ওঠতে থাকে। তার পর ওই মশাটি যখন একজন সুস্থ মানুষকে কামড়ায় তখন মশার পেটের ভেতর থেকে ডেঙ্গুর ভাইরাসটি চলে যায় ওই সুস্থ মানুষের রক্তের ভেতরেও।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মশার দেহে যদি উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া থাকে তা হলে আর সে রকম ঘটতে পারে না।

বাংলাদেশে রোগ নিয়ন্ত্রণ, রোগ তত্ত্ব ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘একজন রোগীর কাছ থেকে ভাইরাসটি যখন উবাকিয়া আছে এ রকম মশার পেটের ভেতরে যাবে, তখন আর ডেঙ্গু ভাইরাসটি বেড়ে উঠতে পারে না। ফলে এই মশাটি যখন আরেকজনকে কামড়ায় তখন আর তার দেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে না।’

ওয়ার্ল্ড মসকিটো প্রোগ্রামের বিজ্ঞানীরা বলছেন, উবাকিয়া আছে এ রকম কোনো পুরুষ মশা যদি উবাকিয়া নেই এমন নারী মশার সঙ্গে মিলিত হয় তা হলে তাদের ডিম থেকে বাচ্চা হবে না।

কিন্তু নারী মশার দেহে কিংবা নারী ও পুরুষ উভয় মশার শরীরে উবাকিয়া থাকলে, ডিম থেকে বাচ্চার জন্ম হবে এবং এসব নতুন মশাতেও উবাকিয়া থাকবে।

এক সময় দেখা যাবে একটি এলাকাতে শুধু সেসব মশাই আছে যেগুলোর শরীরে উবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া আছে।

জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা বন্ধু মশা
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মূলত উবাকিয়া পদ্ধতি নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলেও বাংলাদেশে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বা জিএম মশা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কমিটিতে আলোচনা হয়েছে।

জিএম মশা দিয়ে রোগ প্রতিরোধের কথা শুনতে অনেকটা বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনির মতো হলেও গত কয়েক বছরে এই পদ্ধতিতে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এই মশাকে বলা হচ্ছে ‘বন্ধু মশা।’

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে ১৬ বছর ধরে গবেষণার পর এ ধরনের মশা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে ব্যবহার করা হয়েছে ম্যালেরিয়া ও জিকা ভাইরাস প্রতিরোধে।

এই পদ্ধতিতে জিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মশার কোষে জিন প্রবেশ করিয়ে এমন কিছু জেনেটিক পরিবর্তন ঘটানো হয় যার ফলে এর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকতে পারে না।

ব্রিটেনে অক্সিটেক নামের একটি বায়োটেক কোম্পানির বিজ্ঞানীরা ২০০২ থেকে এনিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল জিনগত পরিবর্তন ঘটানোর মধ্য দিয়ে পরিবেশে এডিস মশার সংখ্যা কমিয়ে ফেলা।

অক্সিটেকের বিজ্ঞানীরা বলছেন, ল্যাবরেটরিতে জন্ম দেওয়া এসব ‘বন্ধু মশা’ যখন প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয় তখন পরিবেশে থাকা নারী এডিস মশার সঙ্গে মিলিত হলে যেসব মশার জন্ম হয় সেগুলো বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে এডিস মশার সংখ্যা কমতে থাকে।

অক্সিটেকের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ব্রাজিল, পানামা ও কেম্যান আইল্যান্ডের কোন কোন অঞ্চলে এই পদ্ধতিতে এডিস মশার সংখ্যা ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশে কর্মকর্তারা বলছেন, এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশেও এখন মশক নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিনা সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে কোনো পদ্ধতি
বাংলাদেশে ডেঙ্গু মোকাবেলায় কর্মকর্তারা এখন এই দুটো পদ্ধতির তুলনা করে দেখছেন। উবাকিয়া পদ্ধতির ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড মসকিটো প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাবও করা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কমিটির সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের বেশ কয়েকবার আলাপ আলোচনাও হয়েছে। এসব কথাবার্তা চলছে গত সাত মাস ধরে। কিন্তু এখনো তেমন অগ্রগতি হয়নি।

কর্মকর্তারা বলছেন, যে পদ্ধতি বেশি উপযোগী ও কার্যকর বলে মনে হবে বাংলাদেশে সেই পদ্ধতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তবে আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ড. মাহমুদুর রহমান উবাকিয়া পদ্ধতির পক্ষে।

তিনি বলছেন, প্রাকৃতিক উপায় হওয়ার কারণে এতে খরচ কম। ফলে মশার ইকোলজিতেও কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

তিনি বলেন, ‘এর ভালো দিক হচ্ছে এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। আমাদের শুধু একবার হস্তক্ষেপ করতে হবে। আর করতে হবে না।’

যেসব দেশে এই পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে সেসব দেশে এখনো পর্যন্ত এর বড় কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও চোখে পড়েনি।

মাহমুদুর রহমান বলছেন, ‘সব কিছুই আগের মতোই থাকবে, মশাও থাকবে, সেই মশা কামড়াবেও, কিন্তু উবাকিয়ার কারণে ভাইরাসজনিত সেই রোগগুলোর আর সংক্রমণ ঘটবে না।’

অন্যদিকে, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মশা দিয়ে ডেঙ্গু মোকাবেলা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ ল্যাবরেটরিতে এই ‘বন্ধু মশা’ জন্মাতে হবে। এ ছাড়া প্রকৃতিতে সব সময় এই মশা ছাড়া অব্যাহত রাখতে হবে।

তবে মাহমুদুর রহমান বলছেন, এসব পদ্ধতি অন্যান্য দেশে সফল হলেও বাংলাদেশে সেসব কতোটা কার্যকর হবে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রথম বছরে আমরা হয়তো পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যেই থাকবো। তার পর ধীরে এধরনের মশার সংখ্যা বাড়িয়ে পুরনো এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যেতে পারে।
খবর বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ