বাংলাদেশ টিকাদানে এতো সাফল্য পেলো কিভাবে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০১৯, ১৮:১৩

জন্মের পর কিংবা শিশু বয়সে অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ এক সময় বাংলাদেশের শিশুদের জন্য ছিলো নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায়না। বরং টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ফলে অনেক সংক্রামক রোগই বরং এখন বিলুপ্তির পথে।

ঢাকার আদাবর এলাকায় বাস করেন খন্দকার জহুরুল আলম। খুবই অল্প বয়সে প্রথমে জ্বর হয়ে পরে এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি কয়েক দশক আগে যার ফলে তার জীবন হয়ে উঠেছিলো দুর্বিষহ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "আমাকে বলা হয়েছিলো টাইফয়েডের কারণে আমার পায়ের এই অবস্থা হয়েছে। আসলে এটা ছিলো পোলিও যা অনেক পরে জানা গেছে। পড়াশোনাও দেরিতে শুরু হয়েছে। ছোট ভাই যখন স্কুলে গেলো তখন দেয়া হলো কারণ আমি তো একা যেতে পারবোনা। মানুষ আমার নামও ভুলে যেতো, ল্যাংড়া বলতো। পরে একটি ব্যাংকের চাকরীর পরীক্ষা দিতে গেলাম আমাকে ভেতরেই ঢুকতে দেয়া হয়নি"।

মিস্টার হক বলেন, "পোলিও নামটাই তখন আমার পরিবার বা ডাক্তার বলতে পারেননি। সে আক্ষেপটা মনে আসে যে জন্মের পর যদি এখনকার মতো টিকা পেতাম তাহলে এমন প্রতিবন্ধী জীবন হতোনা। আমরা চার ভাই ও দুই বোন। দুই ভাইয়ের বাসায় যেতে পারিনা কারণ তারা চার তলায় থাকে কিন্তু লিফট না থাকায় আমি উঠতে পারিনা"।

শুধু পোলিও নয়, একসময় যক্ষ্মা, হাম, ধনুষ্টংকার, ডিপথেরিয়া ও হুপিং কাশির মতো রোগের কারণে বহুকাল ধরেই বহু শিশুকে প্রাণ হারাতে হয়েছে কিংবা প্রতিবন্ধী হয়ে মিস্টার হকের মতো এমন কষ্টের জীবন মেনে নিতে হয়েছে। তবে সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। সরকারি হিসেবে গত ২৪ বছরে শিশু মৃত্যুহার কমেছে ৭৩ শতাংশ। এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবরও তেমন একটা শোনা যায়না।

সেন্টার ফর ডিএসঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এএইচএম নোমান খান বলছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের টিকাদান কর্মসূচি পুরো পরিস্থিতিই পাল্টে দিয়েছে।

"গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবাই জানে বাচ্চাকে টিকা দিতে হবে। ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত মানুষ নিজ উদ্যোগেই আসে। মায়েরা নিজেরাই জানে কোন তারিখে কোন টিকার জন্য যেতে হবে। পরিকল্পিতভাবেই সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ কাজ করেছে বলেই মানুষ এ সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পেয়েছে"।

তবে মারাত্মক রোগগুলো থেকে শিশুকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে এখনকার অভিভাবকরা আসলে কতটা সচেতন? জবাবে নোয়াখালীর ফারহানা বিথী বলছেন, "আমার বাচ্চাকে নিয়মিত টিকা দিয়েছি। সবটিকা দিয়েছি। আমার আশেপাশে যারা তারও বাচ্চাকে নিয়মিত টিকা দিতেই দেখছি। আমি।"

মাদারীপুরের আনজুমান জুলিয়া বলেন বাচ্চা গর্ভে থাকা অবস্থাতে তিনি নিজে টিকা নিয়েছিলেন ও তার বাচ্চাকে সব টিকা দিয়েছেন তিনি।

আর সুবর্ণা হাই হীরা বলছেন বাচ্চার টিকা ও ভ্যাক্সিন যা যা দেয়া দরকার সবই দিয়েছেন তিনি যাতে করে বাচ্চার সুরক্ষা কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে।

এখন দেশজুড়ে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে যেমন টিকা দেয়া হয় তেমনি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতেও টিকা দেয়ার সুযোগ নেন বহু মানুষ।

অথচ ১৯৭৯ সালে যখন টিকাদান কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়ে ছিলো বাংলাদেশে তখন বিষয়টি এমন ছিলোনা।

১৯৮৫ সালের সরকারি জরিপে দেখা যায়, ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের পূর্ণ টিকা প্রাপ্তির হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। সময়ের পরিক্রমায় সরকারি ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার নানা উদ্যোগে এখন টিকাদানের হার ৮২ শতাংশের বেশি। যেসব রোগ ঠেকাতে টিকাগুলো দেয়া হতো তার কয়েকটি এখন নেই বললেই চলে। যেমন পোলিও। বাংলাদেশ সরকার দেশকে পোলিও মুক্ত ঘোষণা করেছে আরও কয়েক বছর আগেই। বিলুপ্তির পথে শিশুদের আরও কয়েকটি রোগও। কিভাবে এলো এই সফলতা।

জবাবে সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মওলা বখশ চৌধুরী বলেন, "১৯৭৯ সালে ইপিআই র যাত্রা শুরু হয়। একটি ওয়ার্ডকে আট ভাগ করে টিকাদানের কাজ শুরু হয়। এখনকার মত সচেতন তখন মানুষ ছিলোনা। ফ্রেমওয়ার্ক, শক্তিশালী নজরদারিসহ নানা কারণে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে আমাদের নিয়ে"।

মিস্টার চৌধুরী বলেন আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বাধা টপকাতে অনেক বাধাও পার হতে হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা কিংবা মানুষকে সম্পৃক্ত করেই আজকের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে টিকাদান কর্মসূচি যা ১৯৮৫ সালে সর্বজনীন টিকাদান কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছিলো। এর সফলতা হলো ১০০ জনের মধ্যে ৮২ জন শিশু ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে।

আর ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ভ্যাকসিনের দশক ধরা হয়েছে। প্রতিবছর ২০ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এ জন্য নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিনও অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা হচ্ছে। রুবেলা থেকে মুক্তির জন্য প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৮৬ জনকে এমআর ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে।

কিন্তু এখন মানুষ নিজে থেকে সন্তানকে টিকা দিতে আনলেও শুরুর দিকে স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য কাজটি ছিলো খুবই কঠিন, বলছেন ১৯৮৭ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করতেন জাহানারা পারভীন।

"তখন বাড়ি বাড়ি যেতাম। অনেকে ভয় পেতো। বুঝায়া আনতাম টিকা দেয়ার জন্য। কেউ দিতো। আবার কেউ একটা দিয়ে আর আসতোনা"।

চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ ক্বারী মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান শান্তি বিশ্বাস বলছেন টিকার বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাদের সম্পৃক্ত করেছিলো এবং মানুষকে টিকাদানে উৎসাহিত করতে তারাও বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন।

আর এতোসব উদ্যোগের ফরে এখনকার স্বাস্থ্য কর্মীদের কাজ অনেকটাই সহজ হয়েছে বলে মনে করেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়ি উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের একজন স্বাস্থ্য পরিদর্শক ফারুকুল হাসান।

একসময় টিকাদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে গলদঘর্ম হতে হতো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও। তবে রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী বলছেন এটি নিয়ে তাকে কোনো বাড়তি চাপ নিতে হয়না।

"এখন প্রত্যেকে সচেতন হয়ে গেছে। শিশু সন্তান গর্ভে আসার সাথে সাথে মা টিকা নিচ্ছে। সন্তান হওয়ার সাথে সাথে টিকা নিচ্ছে। খুব আগ্রহ নিয়ে তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসছে। আগে সমস্যা ছিলো। আমার শ্বশুর আশির দশকে চেয়ারম্যান ছিলেন। তখন সমস্যা হতো। অনেক নারীরা টিকা দিতে নারাজ ছিলো। মানুষকে বোঝাতে তখন তাদের অনেক কষ্ট হয়েছে।"

তবে এতো সব উদ্যোগ ও সচেতনতার পরও টিকাদানে শতভাগ সফলতা আসেনি।

ইউনিসেফের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মেরিনা অধিকারী বলছেন এক্ষেত্রে বিস্ময়কর ভাবে বাংলাদেশে গ্রামের চেয়ে শহরে এমনকি রাজধানী ঢাকাও টিকাদানে পিছিয়ে আছে।

তিনি বলেন, "বিশ্বের সব জায়গায় টিকাদানের ক্ষেত্রে ভালো অবস্থান থাকে শহর এলাকার। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানে গ্রামের অবস্থা বেশি ভালো। সাফল্যকে শতভাগে নিয়ে আসতে হলে শহরের পাশাপাশি চা বাগান, হাওড় এলাকা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে জোর দিতে হবে। এমনকি ঢাকা নিজেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে কিন্তু তাদের কোনো স্বাস্থ্য কাঠামো নেই"।

মেরিনা অধিকারী বলছেন গ্রামে যেখানে টিকাদানের আওতায় ৮২ ভাগ শিশু সেখানে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে এ হার ৭৮ শতাংশের মতো। যদিও সরকারিভাবে বলা হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশে এক বছরের নিচে শিশুদের প্রথম টিকা গ্রহণের হার প্রায় ৯৯ শতাংশ।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মওলা বখশ চৌধুরী বলছেন দেশের সব শিশুর টিকা ডিজিটালি রেকর্ড করার কার্যক্রম শুরু হবে শিগগিরই এবং এটি হলে আর কোনো শিশুই টিকার বাইরে থাকতে পারবেনা বলে আশা করছেন তারা।

যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন পার্শ্ববর্তী দেশে পোলিও সহ কিছু রোগ নির্মূল হয়নি বলে বাংলাদেশ সবসময় ঝুঁকির মধ্যে থাকবে এবং ঝুঁকি মোকাবেলায় তাই রোগ নির্মূল হলেও চালিয়ে যেতে হবে টিকা কার্যক্রম।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ