আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

গরুর দুধে জীবাণু : নতুন পরিকল্পনা কতটা কাজে দেবে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ মে ২০১৯, ১১:৪৫

সম্প্রতি দেশের ৪ জেলার বিভিন্ন খামারে দুধের মান পরীক্ষার গবেষণা চালায় জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি। তাদের গবেষণায় ৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯৩টিতেই ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়।

এমন অবস্থায় দুধের মান ঠিক রাখতে উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত তিন ধাপের কর্ম পরিকল্পনা হাতে নেয়ার কথা জানায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ১৬ সদস্যের কমিটি।

তবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে এই কর্মপরিকল্পনা বৃথা যাবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে ওই গবেষণা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানার পর থেকেই বাজার থেকে তরল দুধ কেনা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন ভোক্তারা।

এ ব্যাপারে ঢাকার বাসিন্দা জাহানারা বেগম জানান, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কর্তৃপক্ষ যদি সুনজর না দেন তা হলে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাবে।

তিনি বলেন, ‘এতগুলো নমুনায় সমস্যা দেখে তো আমি বাসায় দুধ রাখাই বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন। সরকারের উচিত যারা ভেজাল মেশাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়া।’

কী সেই কর্ম পরিকল্পনা
ন্যাশনাল ফুড সেফটির গবেষণায় গরুর দুধে সহনীয় মাত্রার চাইতে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক, অণুজীব ও সিসা রয়েছে বলে জানা যায়।

এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তিন ধাপের কর্ম পরিকল্পনার কথা জানায়।

যার মধ্যে রয়েছে কাঁচা তরল ও পাস্তুরিত দুধের নমুনা সেই সঙ্গে পশুখাদ্যের নমুনা সংগ্রহ, গবেষণাগারে পরীক্ষা ও কমিটির মাধ্যমে ফলাফল পর্যালোচনা।

সেই সঙ্গে প্রাথমিক উৎপাদন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং কমিটির মাধ্যমে সুপারিশ প্রণয়নের কথাও সেখানে জানানো হয়।

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
তবে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে বলে জানান আইনজীবী আমিন উদ্দিন মানিক।

তিনি বলেন, ‘এখানে সব পক্ষের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে। জনগণ যদি ভেজালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তা ছাড়া যে কমিটি হয়েছে তারা যদি নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি নজরদারি করে- তা হলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এই কর্ম পরিকল্পনাকে বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

পুষ্টিবিদ চৌধুরী তাসনিম মনে করেন, যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নমুনা পরীক্ষা শুরু করে তাহলে সেটা অসাধু ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের চাপের মুখে ফেলবে।

তবে যে কোনো পরীক্ষার স্বচ্ছতা থাকাও জরুরি বলে মনে করেন চৌধুরী তাসনিম। ‘ভেজাল পণ্য যদি সবাই বর্জন করে, বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। তাহলে ব্যবসায়ীরা এ ধরণের ক্ষতির মুখে পড়তে চাইবেন না। তবে কোনো উপায়ে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে সেটা জানাও জরুরি।’

চৌধুরী তাসনিম বলেন, ‘বাজার থেকে কেনা কাঁচা দুধ পরীক্ষা করলে কিন্তু হবে না। কেননা মানুষ দুধটা জাল দিয়ে খায়। যদি উত্তাপে সেই ক্ষতিকর উপাদানগুলো অকার্যকর হয়ে তা হলে সেটা নিয়ে আর ভয়ের কিছু নেই।’

গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট
এদিকে বুধবার এ গবেষণার প্রক্রিয়া ও ব্যাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট। এ জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ডা. শাহনীলা ফেরদৌসিকে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে ২১ মে হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বিএসটিআইয়ের পক্ষের আইনজীবী এম হাসান মামুন জানান, ন্যাশনাল ফুড সেফটি যে পদ্ধতিতে এই নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করেছে সেটা বিএসটিআইয়ের স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা সেটাই যাচাই করা হবে।

তিনি বলেন, ‘সারাদেশে লাইসেন্সবিহীনভাবে অসংখ্য খামারি দুধ উৎপাদন করে। এখন উনি কোন খামারিদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। কিভাবে করেছেন। সেটা আমাদের স্ট্যান্ডার্ডের সাথে যায় কিনা। আমরা সেটাই দেখবো।’

বিএসটিআইকে যা বললেন গবেষণাপ্রধান
এ ব্যাপারে শাহনীলা ফেরদৌসি জানান, তারা যে পদ্ধতিতে দুধের নমুনা সংগ্রহ বা যে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করেছেন সেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তাই এই পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানে আইএসও ও বাংলাদেশের অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

‘আমাদের এই ল্যাবরেটরি সরকারিভাবে স্বীকৃতি। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের পরীক্ষাগারের ওপর বেশি আস্থাশীল। তাই এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। তারপরও যদি তাদের সন্দেহ হয় তা হলে বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তাদের মতো গবেষণা করুক। তারা প্রমাণ করুক যে আমরা ভুল।’

এ ছাড়া সম্প্রতি বিএসটিআই তাদের ল্যাব পরীক্ষায় অকৃতকার্য পণ্যের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল তার অনেকগুলো পণ্যের ব্যাপারে ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি আগেই সতর্ক করেছিল বলে জানান মিজ ফেরদৌসি।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে যা বললেন গবেষণাপ্রধান
এদিকে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে অনেক তথ্যের উল্লেখ নেই বলে জানিয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

এমন অবস্থায় কোন কোন খামার বা প্রতিষ্ঠানের কোন পণ্যগুলোয় ভেজাল শনাক্ত হয়েছে, সেগুলো কী এবং কেমন পরিমাণে আছে, এর পেছনে কারা জড়িত, এমন সব প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরির কথা জানান নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম।

কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথাও তাদের কর্ম পরিকল্পনায় রয়েছে বলে জানান ফরিদুল ইসলাম।

এ ব্যাপারে ফেরদৌসি জানান, এই গবেষণায় কেবল চারটি জেলার খামারগুলোয় জরিপ চালানো হয়। তাই তার মতে এটি কোন অবস্থাতেই পুরো দেশকে উপস্থাপন করে না।

গবেষণা প্রতিবেদনে খামার বা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম নীতির কথা উল্লেখ করেন ফেরদৌসি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের জরিপের নিয়ম হলো, আমরা কারও ক্ষতির কারণ হব না। আমরা লিখিতভাবে ওই খামারিদের জানিয়েছি যে এই নমুনা সংগ্রহ কেবল গবেষণার জন্য। তাদের পরিচয় গোপন রাখা হবে। এই এথিক্সের কারণেই কিছু বলিনি। তবে যেহেতু আদালত থেকে নির্দেশ এসেছে। আমি সেগুলো প্রকাশ করতে বাধ্য।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আর্থিক সহায়তায় গরুর দুধ, প্যাকেটজাত দুধ, দই ও গোখাদ্য নিয়ে ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি সম্প্রতি ওই গবেষণা পরিচালনা করেছিল। যেটা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়ে।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ