আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

রাজধানী কি ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিতে হবে?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৫৯

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো জাকার্তা থেকে তার দেশের রাজধানী সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার পরিকল্পনামন্ত্রী প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বলেছেন, জনবহুল জাকার্তা নগরীর নানা সমস্যার কথা বিবেচনা করে প্রেসিডেন্ট এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বিশ্বের আরও অনেক ছোট বড় দেশ তাদের রাজধানী শহর সরিয়ে নিয়েছে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা নতুন কোনো শহরে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, কাজাখাস্তান, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমার বা নাইজেরিয়ার মতো দেশ। ইন্দোনেশিয়া যদি তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, সেই তালিকায় এখন তাদের নামও যুক্ত হবে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরীর এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, একদিন সেখানেও কী একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার হতে পারে? ঢাকা থেকে বাংলাদেশের রাজধানী কি অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া সম্ভব? আর যদি সেটা করা হয়, তার জন্য কী অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে বাংলাদেশকে? বিবিসি বাংলা এ নিয়ে কথা বলেছে বাংলাদেশের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।

রাজধানী কেন ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হতে পারে?
বিপুল মানুষের চাপ, যানজট, নানা ধরনের নাগরিক সুবিধার অভাব, বাসস্থানের সংকট এবং ব্যাপক দূষণ ঢাকার নাগরিকদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে। শহরের অনেক ভবন এবং এলাকাকে রীতিমত মৃত্যুফাঁদ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ নগরীর চেহারা কেমন হবে, সেটা ভেবে অনেকে এখনই আঁতকে উঠছেন।

এসব কারণে ঢাকা যদি অচল এবং বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন আর বিকল্প কী?

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক রাজধানী বিকল্প কোনো শহরে সরিয়ে নেয়ার চিন্তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ঢাকা নগরীর অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিকাশের চিন্তার সঙ্গে এর অবস্থা অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে গেছে। ঢাকার পরিবহন জট, আবাসন এবং বিভিন্ন সামাজিক সেবা, তার কোনোটির অবস্থাই ভালো নয়। বিশ্বের অনেক দেশে যখন এ রকম পরিস্থিতি হয়েছে, তারা উদ্ভাবনী উপায়ে এর সমাধানের চেষ্টা করেছে। এর একটি সমাধান হচ্ছে দুই কেন্দ্রিক দেশ। একটি হবে প্রশাসনিক কেন্দ্র, একটি হবে বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ভারতের ক্ষেত্রে যেমন দিল্লি এবং মুম্বাই, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যেমন করাচী এবং ইসলামাবাদ। ইউরোপের অনেক দেশেই প্রশাসনিক রাজধানী যেখানে, সেখানে কোনো বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় না। লণ্ডন একটি ব্যতিক্রম।’

তবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, এই সুযোগ বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে। ‘বাংলাদেশের এই সুযোগ ছিল, অনেক আগে। যখন বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে আমরা বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে চিন্তা করেছিলাম। ঢাকাকে প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু এটা হয়নি, কারণ সমাজের উচ্চবর্গের মানুষ এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা এধরণের বিভাজনকে খুব সুনজরে দেখেন না। কারণ তারা একটা জায়গাতেই সবকিছু হাতের মুঠোয় পেতে চান। তারা অন্য কোন জায়গায় পুনস্থাপিত হতে চান না। একটা আর্থ-রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এখানে ছিল।’

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান প্ল্যানিং এর অধ্যাপক ড. মুসলেহউদ্দীন আহমেদ বলছেন, একজন নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে তিনি কখনই একটি শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে রাজি নন, কারণ নগরকে পুনরুজ্জীবিত করার অনেক উপায় আছে।

তিনি বলেন, ‘কিন্তু অবস্থা যদি এমন হয় একটা নগরীতে সরকারী প্রশাসন আর চালানো যাচ্ছে না, এই নগরীর সংকটগুলো উত্তরণের আর কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন হয়তো একথা ভাবতে হতে পারে।’

কিন্তু বাংলাদেশে কি নতুন আরেকটি রাজধানী শহর গড়ে তোলা সম্ভব?

কাজটা যে খুব সহজ হবে না, এটা স্বীকার করছেন সবাই।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট হবে একটা সুবিধেজনক জায়গা খুঁজে পাওয়া। বাংলাদেশ জমি বুভুক্ষার দেশ। এত বেশি জমি একসঙ্গে পাওয়া, এটা এত সহজ নয়। একটা বিমানবন্দরের জায়গা খুঁজতে গিয়েই আমরা বিভিন্ন বিড়ম্বনার শিকার হয়েছি। জমি অধিগ্রহণ করাটাই বড় সমস্যা হবে, এটার জন্য আর্থিক ব্যবস্থা লাগবে।’

ঠিক এ কারণেই একটি নতুন রাজধানী শহর গড়ে তোলার ধারণার বিরোধী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুসলেমউদ্দীন আহমেদ। ‘আমাদের দেশটা এত ছোট এবং এতবেশি শহর আমাদের আছে, নতুন শহর আসলে আমরা আরবান প্ল্যানিং এর দৃষ্টিকোণ থেকে নিরুৎসাহিত করি। বাংলাদেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ৫শ শহর আছে। সব শহরে যদি আমরা সুষম নগরায়ন করতে পারি, তাহলে আসলে ঢাকার ওপর চাপ এমনিতেই কমে যায়।’

কিন্তু নতুন রাজধানী যদি গড়তেই হয়, সেটা গড়ে তোলা অসম্ভব নয়, বলছেন তিনি। ‘টাকা থাকলে, জমি থাকলে, টেকনোলজি দিলে, কোন কিছুই অসম্ভব নয়।’

কিন্তু এটির জন্য বাংলাদেশকে কী অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে ?
একটি নতুন রাজধানী শহর গড়ে তোলার জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় করার দরকার হবে, সেটি কি আসলে অর্থনৈতিক বিচারে শেষ পর্যন্ত লাভজনক হবে?

ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলছেন, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির ক্ষেত্রে আসলে অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেখতে হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রয়োজন অনুযায়ী ঢাকাকে আর কতটা বিস্তৃত করা সম্ভব। এবং সেটা করতে না পারলে আমাদের কী ধরনের ক্ষতি হবে। এটা পরিবেশের ক্ষতি, শিক্ষার ক্ষতি, স্বাস্থ্যের মানের ক্ষতি। যাতায়তের ক্ষেত্রে ক্ষতি। অন্যান্য দূষণের ক্ষতি। এসব ক্ষতি যদি আমরা বিবেচনায় নেই, তাহলে হয়তো এই বিপুল বিনিয়োগ যথার্থ বলে দেখা যেতে পারে। আর বিনিয়োগটা তো একবারে হয় না। এটা ধারাবাহিকভাবে করা হয়।’

অন্যদিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুসলেহউদ্দীনের মত হচ্ছে, একটা নগরী যদি বসবাসের অযোগ্য হয়ে গিয়ে থাকে, সেটিকে বসবাসযোগ্য করে তোলার যে খরচ, সেটি একটি নতুন নগরী গড়ে তোলার খরচের চেয়ে অনেক কম। সেদিক থেকে নতুন নগরী সবসময়েই অর্থনৈতিক বিচারে অনেক বেশি খরচসাপেক্ষ।

কিন্তু তিনি বলছেন, রাজধানী শহর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয় একমাত্র বিবেচনা হতে পারে না। ‘আপনি একটা নতুন শহর গড়ে তুললেন, বিশ্বে অনেক দেশেই হয়েছে। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টির প্রতিফলন খুব একটা থাকবে না। কোন একটা দেশের রাজধানী হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে যদি আমরা একটা উপাদান ভাবি, নতুন শহরে নিশ্চিতভাবেই সেটা অনুপস্থিত থাকবে।’

অধ্যাপক আহমেদের মতে, এ কারণেই আসলে ঢাকা থেকে রাজধানী সরানো সহজ হবে না। ‘ঢাকার সঙ্গে আমার কালচারাল হিস্ট্রি অনেক বেশি জড়িত। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকে রাজধানী সরাতে একটা ভাবাবেগ কাজ করতে পারে।’

বিশ্বের যেসব দেশ তাদের রাজধানী শহর সরিয়েছে

ব্রাজিল : রিও ডি জানেরিও এতবেশি জনবহুল হয়ে পড়েছিল যে, ব্রাজিল ১৯৬১ সালে তাদের রাজধানী শহর সরিয়ে নেয় ব্রাসিলিয়ায়। এটি একটি পরিকল্পিত নগরী। রাজধানী হওয়ার পর এই নগরী দ্রুত বাড়তে থাকে। ব্রাজিলের রাজধানী পরিবর্তনের পরিকল্পনাটি সফল হয়েছে বলেই ধরা হয়।

নাইজেরিয়া : ১৯৯১ সালে নাইজেরিয়া তাদের রাজধানী লাগোস থেকে সরিয়ে নেয় আবুজায়। নাইজেরিয়ায় অনেক ধরণের জাতিগত বিভেদ রয়েছে। আবুজা নগরীটি এই বিভিন্ন জাতি-গোত্রের বিচারে একটি নিরপেক্ষ অঞ্চলে অবস্থিত বলে মনে করা হয়।

কাজাখাস্তান : ১৯৯৭ সালে কাজাখাস্তান তাদের রাজধানী আলমাটি থেকে সরিয়ে নেয় নুতন নগরী আস্তানায়। আলমাটিকে আর সম্প্রসারণের সুযোগ ছিল না।

মিময়ানমার : মিয়ানমারের রাজধানী ছিল রেঙ্গুন। কিন্তু ২০০৫ সালে খুব তড়িঘড়ি করে রাজধানী নিয়ে যাওয়া হয় নতুন উত্তরাঞ্চলীয় শহর নেপিডুতে। ২০০২ সাল থেকে গোপনে এই প্রশাসনিক রাজধানী গড়ে তোলা হয়। কেন মিয়ানমারের সামরিক শাসক এরকম তড়িঘড়ি করে রাজধানী সরিয়ে নেন, সেটার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ