আজকের শিরোনাম :

বায়ু দূষণ কমানো গেলে কীভাবে উপকৃত হবে বাংলাদেশ?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:৩৭

বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার একটি গ্রাম কল্যাণপুরের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত, যে গ্রামটিতে বিদ্যুৎ এসেছে কিছুদিন আগে।

এই গ্রামের একজন বাসিন্দা মোঃ হারুন অর রশিদ বলছেন, পাঁচ বছর আগেও যেখানে তাদের গ্রামের বাতাস অনেকটা পরিষ্কার বলে মনে হতো, সেখানে কয়েক বছর আগে আশেপাশে কয়েকটি ইটভাটা তৈরি হওয়ার পর থেকে যেন বাতাস অনেকটা বদলে গেছে।

তিনি বলছেন, আশেপাশে ইটের ভাটা হওয়ার পর ভাটাওয়ালারা মাটি কিনে নিয়ে যাচ্ছে, আবার তারা যে ইট পোড়ায় তাতে কালো ধোঁয়া বের হয়।

"এসব ভাটায় সারাক্ষণ ইঞ্জিনের গাড়ি যাতায়াত করে, সেগুলো থেকেও সারাক্ষণ ধোঁয়া বের হয়, শব্দ হয়। আমাদের গ্রামের বাতাসটা যেন মনে হয় আগের চেয়ে ভারী হয়ে যাচ্ছে।"

তিনি জানান, গ্রামের মানুষের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার কষ্ট বা কাশি বাড়ার মতো সমস্যাও দেখা যাচ্ছে।

শুধু গ্রামেই নয়, বায়ু দূষণের এই সমস্যা এখন সমগ্র বাংলাদেশের।

বায়ু দূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা 'স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার' তাদের প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে।

সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন না কোন ভাবে বায়ু দূষণের মধ্যে বাস করছে।

এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ কোন দূষিত এলাকায় বাস করে।

বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ আর ভারত ও চীনে মারা গেছে ১২ লাখ মানুষ।

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৭ সালের হিসাবে প্রতি ১০জনের মধ্যে একজন বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছে।

বায়ু দূষণের স্বীকার হয়ে যে দশটি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে, সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

সংস্থাটি বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানের কারণে মৃত্যুর হারের তুলনায় ২০১৭ সালে বায়ুদূষণের ফলে বেশি মানুষ মারা গেছে।

এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

বায়ু দূষণের স্বীকার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রতিটি শিশুর ৩০মাস করে আয়ু কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি, যদিও উন্নত দেশগুলোয় এই হার গড়ে পাঁচ মাসের কম।

দূষিত বাতাসের কারণে যেসব রোগ হতে পারে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া সীমার দশগুণের বেশি।

ঢাকার একজন বাসিন্দা নেওয়াজ চৌধুরী বলছেন, সবসময়ে ধোঁয়া, ধুলার ভেতর দিতে যাতায়াত করার কারণে তার মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হয়।

সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসের মধ্যে থাকলে যেসব রোগ হতে পারে, তার মধ্যে আছে -

হৃদরোগ
কাশি, নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগ
ফুসফুসের সংক্রমণ
ফুসফুসের ক্যান্সার
ডায়াবেটিস
অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্ট জনিত নানা রোগ
স্ট্রোক
চোখে ছানি পড়া
শিশু ও গর্ভবতী নারীদের সমস্যা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় বায়ুদূষণের মধ্যে কাটিয়ে দেয়, তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর।

বায়ু দূষণ কমানো গেলে কীভাবে উপকৃত হবে বাংলাদেশ?

অধ্যাপক আবদুস সালাম বলছেন, সবচেয়ে বড় যে উপকারটি হবে, বায়ু দূষণ রোধ করা গেলে সেটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সহায়তা করবে।'

স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার বলছে, বায়ু দূষণ রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়বে এক বছর তিন মাসের বেশি।

ড. সালাম বলছেন, ''মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা কমিয়ে দেবে। ফুসফুসের সমস্যা, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ অনেক রোগ কমে যাবে। ফলে তাদের নিজেদের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। ''

প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেয়ার সংখ্যা কমে যাবে, তেমনি শিশু ও মানুষের গড় আয়ু বাড়বে।

মি. সালাম বলছেন, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় ধরে বায়ু দূষণের ভেতর দিয়ে যায়, তাহলে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হবে। সেটা কাটিয়ে ওঠা যাবে।

বায়ু দূষণ কমানো গেলে মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, যার ফলে বেড়ে যাবে জিডিপিও।

যেসব কারণে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ এতো বেশি?

বায়ু দূষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম।

তিনি বলছেন, গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের দেশ হওয়ায় শীতের সময়ে হিমালয়ের পরের সব দূষণ এদিকে চলে আসে।

"কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয় আমাদের নিজেদের অনেক দূষণ।"

দূষণ রোধে কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপের অভাবে বায়ু দূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা, ঢাকার মতো বড় শহরের চারপাশে ইটভাটা, শহরের মধ্যে নানা কারখানা স্থাপন তো বায়ু দূষণের একটি কারণ।

''সেই সঙ্গে শহরের প্রচুর ধুলা এবং নির্মাণ কাজের বায়ু দূষণ হচ্ছে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়িগুলো রাস্তায় অতিরিক্ত সময় ধরে চলছে, সেগুলো অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করছে, এসবও বায়ু দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।''

তিনি বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে পরিবেশ অতিরিক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে, সেই গরম ঠাণ্ডা করার জন্য মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, আবার তাতে বায়ু দূষণ আরো বাড়ছে।

বায়ুদূষণের ফলে আমাদের শরীরে যা ঘটে

বায়ুদূষণ কীভাবে কমানো যেতে পারে?

ড. আবদুস সালাম বলছেন, বায়ু দূষণ কমাতে প্রত্যক্ষ আর অপ্রত্যক্ষ ব্যবস্থা রয়েছে।

প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাগুলো হলো রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণ বা ময়লাগুলো পুড়িয়ে ফেলার মতো নানা ব্যবস্থা।

পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা
কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া
ট্রাফিক জ্যামের সমাধান
উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা
এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করা
অপ্রত্যক্ষ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে:

প্রচুর বনায়ন করা, কারণ গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে
বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা, যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে
নির্মাণ কাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করা, যাতে সেটি দূষণের কারণ না হয়

বিশ্বজুড়ে বায়ু দূষণের চিত্র

. বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়

. পৃথিবীর ৯১ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করে যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি

. পৃথিবীর যে ২০টি শহর সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের মধ্যে আছে তার মধ্যে ভারতের ১৪টি শহর রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কানপুর শহর এ তালিকায় সবচেয়ে উপরে

. বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০জনের মধ্যে নয়জন দূষিত বায়ু গ্রহণ করে

গবেষকরা বলছেন, যেসব বয়স্ক মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম তারা সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের ঝুঁকিতে আছেন। কারণ তারা প্রায়ই ঘরের বাইরে নানা ধরণের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ