আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাও ব্রেক্সিট নিয়ে সংকটে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৩২

ব্রেক্সিট নিয়ে যে চরম অনিশ্চয়তা চলছে, তার ফলে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাও এখন চরম উদ্বেগে। তাদের ব্যবসার ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অনেকে ব্রিটেন থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইউরোপে।

ব্রিটেনের সবচেয়ে সফল বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একজন ইকবাল আহমেদ। ব্রিটেনে তিনি সবচেয়ে বেশি চিংড়ি আমদানি করেন, আবার একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি রফতানি করেন। তাকে এ জন্য ‘কিং অব প্রন’ বলেও ডাকা হয়। ইকবাল আহমেদের আত্মজীবনী গ্রন্থের শিরোনামও ‘কিং প্রন- ড্রিমিং বিগ অ্যান্ড মেকিং ইট হ্যাপেন।’ সানডে টাইমস ব্রিটেনের শীর্ষ ধনীদের যে তালিকা করে, একবার সেই তালিকায়ও তার নাম উঠেছিল।

ইকবাল আহমেদের সীমার্ক গ্রুপের ব্যবসা এখন বিস্তৃত ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশে। কিন্তু ব্রেক্সিটকে ঘিরে ৩ বছর ধরে যে অনিশ্চয়তা, সে কারণে এখন তিনি ব্রিটেন থেকে তার ব্যবসার একটা বড় অংশ নিয়ে যাচ্ছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

তিনি বলেন, ‘ব্রেক্সিটের প্রথম ধাক্কাতেই আমরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কারণ পাউন্ডের দাম একদম পড়ে গেল। তার পর এখন তো চলছে অনিশ্চয়তা। ইউরোপে আমাদের যারা কাস্টমার, তারা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমরা ওদের মালামাল সরবরাহ করতে পারবো। আমরা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি যে আমরা পারবো, কিন্তু তার পরও ওরা উদ্বিগ্ন।’

ইকবাল আহমেদ তার সী ফুড এবং অন্যান্য ব্যবসা পরিচালনা করেন ম্যানচেস্টার থেকে। ব্রেক্সিট নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার পর তিনি তার ব্যবসা আর সম্প্রসারণ করতে পারছেন না। কারণ তাকে এখন বেশি নজর দিতে হচ্ছে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার দিকে।

তিনি বলেন, ‘গত ৩ বছরে আমাদের কোনো এক্সপানশন হয়নি, ব্যবসায় যেটা আমাদের ন্যাচারালি হয়। কীভাবে আমরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখব, সেটাই আমাদের সবসময় চিন্তা ছিল।’

এই অনিশ্চয়তা কাটাতে শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ম্যানচেস্টার থেকে তিনি তার ব্যবসার কিছু অংশ ইউরোপে নিয়ে যাবেন।

ইউরোপের সঙ্গে আমার সী ফুডের যে ব্যবসা, গত দুই মাসে সেটা আমি নিয়ে গেছি জার্মানি, বেলজিয়াম এবং পোল্যান্ডে। সেখানে আমরা নতুনভাবে সব কিছু সেট-আপ করেছি। ব্যবসার মূল ম্যানেজমেন্ট আমি ম্যানচেস্টারেই রাখছি। কিন্তু ইউরোপে আমরা যে পণ্য বিক্রি করি, সেটা এখন আমরা ইউরোপেই প্রক্রিয়াকরণ করব। এটা করার পরই এখন গ্রাহকরা আমাদের ওপর কিছুটা আস্থা ফিরে পেয়েছেন। গত তিন মাসে আমরা এটা করতে পেরেছি।

কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্রিটেন এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বলছেন তিনি।

‘আমার এখানে যে ২০০ মানুষের চাকরি ছিল, তাদের ১০০ জনের চাকরি চলে যাবে। কারণ ডিস্ট্রিবিউশন, অর্ডার পিকিং, ট্রান্সপোর্ট, এগুলো আর এখানে এত দরকার হবে না। এখন এটা আমরা করব বার্লিনে, ব্রাসেলসে, সেখানেই নতুন কর্মসংস্থান হবে।’

কিন্তু ব্রেক্সিট নিয়ে যে অনিশ্চয়তা, তাতে ব্রিটেন যে একেবারেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, সেটাও তো বলা যাচ্ছে না। যদি সেটা না হয়, তখন তিনি কী করবেন?

‘এখন যদি আবার ব্রিটেন ইইউ-তে থেকেও যায়, আমরা কিন্তু ইউরোপের ব্যবসা ইউরোপেই রেখে দেব। শুধু আমি না, আমার মতো আরও যারা ইউরোপে রফতানি করে, সবাই সবার ব্যবস্থা করে ফেলেছে।’

ইকবাল আহমেদ এই অবস্থার জন্য দোষারোপ করছেন রাজনীতিকদের।

‘রাজনীতিকদের ব্যর্থতা এটা। কিছু রাজনীতিকের ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং আকাক্সক্ষার কারণে আমরা সবাই আজ ভুক্তভোগী।’

‘মেড ইন ইংল্যান্ড’
মামুন চৌধুরী আরেকজন সফল ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তার ব্যবসার সাফল্যের মূলে রয়েছে ‘মেড ইন ইংল্যান্ড’ ব্র্যান্ডিং।

ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী ফ্যাশনের নানা রকম কোট তৈরি করে তা রফতানি করে তার কোম্পানি ‘লন্ডন ট্রাডিশন’। মানুষ তাদের পণ্য কেনে এ কারণেই যে, এগুলো ইংল্যান্ডে তৈরি।

ব্রেক্সিট নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে তিনি যে ইকবাল আহমেদের মতো তার ব্যবসা অন্য কোথাও সরিয়ে নেবেন সেই সুযোগ নেই। কারণ তা হলে ‘মেড ইন ইংল্যান্ডে’র ট্যাগ তিনি আর ব্যবহার করতে পারবেন না।

তিনি বলেন, ‘যদি ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কোনো চুক্তি ছাড়া বেরিয়ে যায়, তা হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের মতো যারা মেড ইন ইংল্যান্ড ব্র্যান্ড নিয়ে ব্যবসা করে তারা।’

মামুন চৌধুরী তার কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। আবার রফতানিও করেন মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এশিয়ার কিছু দেশে। ব্রেক্সিট নিয়ে অনিশ্চয়তা তার ব্যবসাকে সংকটে ফেলে দিয়েছে।

‘এখন ব্রিটেন যদি বেরিয়ে যায়, আমাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কাঁচামাল আমদানি করলে হয়তো শুল্ক দিতে হবে, বা আরও নানা সমস্যা হবে। হয়তো জিনিসপত্র আনতে দেরি হবে। আবার যখন রপ্তানি করবো, তখন আমার প্রোডাক্টের দামও একটু বেশি পড়বে, কারণ এখন পাউন্ডের মূল্য পড়ে গেছে ইউরোর তুলনায়।’

মামুন চৌধুরী বলছেন, তিনি শুধু যে ইউরোপের সঙ্গেই ব্যবসা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়বেন তা নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে অন্য দেশের সঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রেও তিনি সংকটে পড়বেন।

যেমন জাপানে আমি রফতানি করি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছে গত ফেব্রুয়ারীতে, এটা করার জন্য গত ৬ বছর ধরে ইইউ এবং জাপান কাজ করছিল। এই চুক্তির ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুল্ক ছাড়াই জাপানে পণ্য রফতানি করা যায়। অথচ আগে দশ শতাংশের বেশি হারে শুল্ক দিতে হতো। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার কারণে এই সুবিধাটা এখন আমি পাই জাপানে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে। কিন্তু যখন আমরা কোন চুক্তি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসবো, তখন এই সুবিধা আর পাবো না।

ব্রেক্সিট নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে মামুন চৌধুরির রফতানি কমে গেছে প্রায় পনের শতাংশ।

‘এ বছর যত ট্রেড শো তে আমরা গিয়েছি, তার সব ক’টাতেই লোক এসেছে কম। সবার প্রশ্ন একটাই, ব্রেক্সিটের পর আমরা কী করবো? আমাদের পরিকল্পনা কী? যেহেতু কাস্টমারদের আমরা সঠিক জবাব দিতে পারি নাই, তাই আমাদের কাস্টমাররাও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। আমাদের অর্ডার কমে যাচ্ছে।’
খবর বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ