আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

‘নিঃশ্বাস নিতে না পেরেই মানুষগুলো ঝাঁপ দিয়েছিল’

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৩০

বনানীর এফআর টাওয়ারে যে দিন আগুন লাগে সে দিন ভবনটির ১০ তলার একটি অফিসে কাজ করছিলেন লামিয়া ইসলাম। আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর তিনি ও তার সহকর্মীরা শুরুতে কেউই বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ পাচ্ছিলেন না।

আগুনের তীব্র তাপ ও ধোঁয়ায় অচেতন হওয়ার অবস্থা তার। এমন সময় তার চোখের সামনেই কয়েকজন, নিচে লাফিয়ে পড়েন। পায়ে আগে থেকেই আঘাত থাকায় বাঁচার আশা অনেকটা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। একপর্যায়ে বাথরুমের জানালা ভেঙে পাশের ভবনে পার হন তিনিসহ তার অন্তত ২০ সহকর্মী।

সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তের কথাই জানান তিনি। ‘আমি প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আগুনের কালো ধোয়ায় চারদিক পুরো অন্ধকার হয়েছিল। আর ওই ধোঁয়াটায় শরীর মুখ গলা জ্বলতে শুরু করে। নিঃশ্বাস নিতে না পারাটা যে কি কষ্টের। নিঃশ্বাস নিতে না পেরেই মানুষগুলো ঝাঁপ দিয়েছিল। পরে আমাদের কয়েকজন কলিগ বাথরুমের জানালা ভাঙতে থাকে। তার পর সেটার ভেতর দিয়ে আমরা পাশের ভবনে যাই। দুটা ভবনের মাঝখানে কয়েক হাত ফাঁকা ছিল। কিন্তু ওই সময়টায় আসলে মাথা কাজ করে না। জীবন বাঁচানটাই মুখ্য হয়ে যায়।’

অভিযোগ নানা অব্যবস্থাপনার
জানালার কাচ ভাঙতে গিয়ে হাতে জখম হয়েছিল লামিয়া ইসলামের সহকর্মী আরিফুর রহমানের। তবে এর চাইতেও গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারই পরিচিত বেশ কয়েকজন। ভবনটির নানা অব্যবস্থাপনার কারণে এতোগুলো মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

‘এখানে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আজ করছি। কিন্তু এ পর্যন্ত আমাদের কেউ কখনো বলে নেই যে আগুন লাগলে কী করব। কোথায় যাব। এই ভবনে কোন ফায়ার অ্যালার্মই নাই। তাহলে মানুষ বুঝবে কীভাবে। ভবনের ফায়ার এক্সিট সিঁড়িটাও ছিল মেইন সিঁড়িটার পেছনে। যেখানে আগুনের ধোঁয়ার কারণে কেউ যেতে পারছিল না। আবার অনেক ফ্লোরে এই এক্সিট সিঁড়িটাই বন্ধ ছিল।’

কখনো আগুন নেভানোর মহড়া হয়নি
গত সাড়ে ৩ বছর এই ভবনের নবম তলায় কাজ করে আসছেন এম এম কামাল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কখনো অগ্নিনির্বাপক মহড়া চালাতে বা নিরাপত্তা কর্মীদের দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রশিক্ষণ নিতে দেখেননি। ফায়ার ডোর কোথায় সে বিষয়েও কোনো ধারণা ছিল না তার।

কামাল বলেন, ‘আমাদের ফায়ার এক্সিট ডোরের দিকটায় নামাজ পড়ার ঘর করা। আমরা জানতাম না এক্সিট সিঁড়িটা এই দিকটায়। কেউ আমাদের কখনো কিছু জানায়ও নি। প্রতিটা ফ্লোরেই ফায়ার এক্সিটিংগুইশার ছিল। কিন্তু প্রশিক্ষণ না থাকায় কেউই জানতো না এটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। তারা লাখ লাখ টাকা ভাড়া নেবে। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার জন্য কিছু করবে না।’

গণশুনানিতে কী হয়েছে?
বৃহস্পতিবারের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিজের এমন নানা অভিজ্ঞতার খবর জানাতে বেঁচে ফেরা এমন অনেকেই ভিড় করেছিলেন এফ আর টাওয়ারের কাছে বনানী থানা পুলিশের অস্থায়ী কন্ট্রোল রুমে আয়োজিত এক গণশুনানিতে।

ঘটনা তদন্তে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছয় সদস্যের কমিটি, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের নয় সদস্যের কমিটি, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ এই গণশুনানির আয়োজন করে।

মূলত প্রত্যক্ষদর্শীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তারা বোঝার চেষ্টা করেছেন কি কারণে এই আগুন লাগতে পারে, এবং পরিস্থিতি এতোটা ভয়াবহ রূপ নেয়ার কারণগুলো কি কি।

সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চলা ওই শুনানি শেষে তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন যে ৮তলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে। তবে তারা এ ব্যাপারে তারা এখনো নিশ্চিত নন।

কমিটির সদস্য কাজী নাহিদ রসুল জানান, প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে তারা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন যে অগ্নিকাণ্ডের উৎস কি হতে পারে। কোন পক্ষের ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল কী ছিল না, সে বিষয়েও অনুসন্ধান চলছে।

রসুল বলেন, ‘সবার শুনানির ভিত্তিতে আমরা জানার চেষ্টা করছি যে কেন এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে আমাদের পরবর্তী করণীয় কি হতে পারে। কেন বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে সেগুলো আমরা অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি।’

এদিকে নতুন করে আবারও কাজ ফিরতে শুরু করেছেন লামিয়া ইসলাম ও তার সহকর্মীরা।

স্বাভাবিক জীবন শুরু করলেও কবে নাগাদ সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলে স্বাভাবিক হতে পারবেন সেটা তার জানা নেই। তার কাছে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসাটাই সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ