আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম কীভাবে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক দলগুলো

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:০৩

বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক বিরাট বিপ্লব ঘটার পর এ প্রথম সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। এ নির্বাচনে মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে,তা নিয়ে কারো কোনো সংশয় নেই।

সামাজিক মাধ্যম মূলধারার গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে কিনা, সেই প্রশ্নও অনেকে তুলছেন।

এখন ব্যাপক জনপ্রিয় এ সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন কৌশল নিয়ে নেমেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে ভোটের আমেজ এখন তুঙ্গে দেশে। রাজনৈতিক দলগুলো নানা কৌশলে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করেছে।

বিশেষ করে প্রধান দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপি সামাজিক মাধ্যমকে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

দুই দল তাদের স্ব-স্ব নির্বাচনী প্রতীকের সমর্থনে বিভিন্ন ধরনের গানের অডিও এবং ভিডিও ফেসবুক এবং ইউটিউবে পোস্ট করছে। দলগুলো তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যও তুলে ধরছে। এসব নিয়ে সামাজিক মাধ্যমের সাধারণ ব্যবহারকারীরাও মেতে থাকছেন।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ফেসবুক ব্যবহার করেন। ইউটিউবও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

কলামিস্ট এবং অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট লীনা পারভিন মনে করেন, এবার নির্বাচনে সামাজিক মাধ্যম নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে। তরুণ সমাজের এবং নতুন ভোটারের একটা বড় অংশ এই জায়গায় এবং যাদের বেশিরভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারী। ফেসবুক জনমত গঠনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক-দুই ক্ষেত্রেই প্রভাব রাখছে। এবং এটা আমি বলব যে, মূলধারার গণমাধ্যমকে একটা বিশাল চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে। এই ফেসবুক নির্বাচনে মতামত গঠনের ক্ষেত্রে একটা বিশাল প্রভাব ফেলবে।

ফেসবুক, ইউটিউব এবং টুইটারসহ সামাজিক মাধ্যমে সরব উপস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ আগেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে তার পর নেমেছে।

আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে নানান ধরনের ভিডিও, ছবি এবং পোস্ট দিচ্ছে অব্যাহতভাবে।

দলটি চলচ্চিত্র এবং গানের শিল্পী ও ক্রিকেটসহ বিভিন্ন মাধ্যমের তারকাদের দিয়েও তাদের সমর্থনে ভিডিও তৈরি করে সেগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলছিলেন, তাদের দল মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণার কৌশল নিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমের অনেক ধরণেরই প্রভাব থাকে ভোটারদের ওপর। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমা বিশ্বে অনেকে বিতর্ক দেখেছি। এই মাধ্যমের ওপর আমরা কোন প্রভাব বিস্তার করতে চাই না। শুধু আমরা চাই, গুজব বা মিথ্যা তথ্য যা প্রচার হয়, তার ওপর যেন নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং আমরা সেটাকে প্রতিহত করার জন্য আমাদের প্রচারণা চালাতে একটা নির্দিষ্ট সেল তৈরি করেছি।

ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে বিএনপির প্রচারণাও চোখে পড়ার মতো। দলটি আওয়ামী লীগ সরকারের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার ব্যাপারে বেশি জোর দিয়েছে। তারা তাদের দল এবং জোটের রাজনৈতিক বক্তব্য এবং নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়গুলোও তুলে ধরছে সামাজিক মাধ্যমে।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলছিলেন, নির্বাচন এগিয়ে এলে মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে বলে তারা মনে করেন।

সে জন্য সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহারের বিষয়ে তারা জোর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশে ডিজিটাল আইন হয়েছে, কালো আইন হয়েছে। এই আইনগুলো যখন চলমান, তখন কিন্তু খুবই ভেবে চিন্তে ফেসবুক ব্যবহার করার একটা প্রশ্ন চলে আসে। বিশেষ করে বিরোধী দল বা বিরোধীমতের জন্য। আমাদের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও স্বাধীন নয়। সেই ক্ষেত্রে নির্বাচনে ফেসবুক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেক্ষেত্রে বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার, অঙ্গীকারসহ রাজনৈতিক সব বক্তব্য ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে তুলে ধরছে।’

অনেকে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের জবাবদিহির অভাবের কথা বলছেন। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং পরে ডিজিটাল আইনের মাধ্যমে বিরোধী মত দমনের অভিযোগ রয়েছে।

এরপরও সামাজিক মাধ্যম মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য কোন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে কিনা, সেই প্রশ্ন যে উঠছে।

সেখানে গবেষক এবং লেখক আফসান চৌধুরী পরিস্থিতিটাকে দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি মনে করেন,সামজিক মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তির ইচ্ছেমতো যা কিছু লেখার সুযোগ আছে।

আর এমন সুযোগের কারণে অনেক সময় রাজনীতি নিয়ে সাংঘর্ষিক পরিবেশ তৈরি হতে পারে। এই বিষয়টিকে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সামাজিক মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখেন।

‘মূলধারার গণমাধ্যম কিছুটা হলেও পরিষ্কার করে বা এডিট করে প্রকাশ করে। কিন্তু সামাজিক গণমাধ্যমের অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা যেটা- সেটা হচ্ছে যে, যা খুশি তাই বলতে পারে। এমনিতেই আমাদের দেশের রাজনীতিতো সাংঘর্ষিক। সেই পটভূমিতে সামাজিক মাধ্যম এটাকে আরও সাংঘর্ষিক করে তোলে’- বলছেন আফসান চৌধুরী।

‘অন্য যে বিষয়টা আসে। এটা ভোটারকে প্রভাবিত করবে কিনা? ভোটারের মোটামুটি একটা ভাগ ৩০ বা ৩৫, দুইটা দরের মধ্যে রয়েছে।সেখানে সরকার এবং বিরোধীদের যা ভোটার আছে, তারা কিন্তু কোন মাধ্যমেই কিছু দেখে প্রভাবিত হবে না।তাহলে সেই ২৫ বা ৩০ ভাগ যে অংশটা আছে, তারা প্রভাবিত হবে কিনা? তারা কিন্তু একটু চিন্তা করা ভোটার। তারা তথ্যের দিকে যাবে।তারা মূলধারার গণমাধ্যম পড়বে।’

মূলধারার গণমাধ্যমের অনেকেই সামাজিক মাধ্যমের বিস্তারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন। তবে তারা মনে করেন,প্রাথমিকভাবে মানুষ সামাজিক মাধ্যমের কাছে যাচ্ছে, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বা বিশ্লেষণের জন্য তারা মূলধারার কাছেই ফিরে আসে।

ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলছিলেন, দায়িত্ববোধের বিষয়টিই মূলধারার গণমাধ্যমের বড় সম্পদ। ‘মিডিয়ার ভূমিকা যদি দেখি, স্বাধীন মত প্রকাশ, ভিন্নমত প্রকাশ, একট সমাজে ভিন্ন চিন্তার প্রতিফলন, এটাতো মিডিয়ার খুব বড় কাজ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামাজিক মাধ্যমতো অনেক বেশি ব্যাপক।তো একদিক থেকে এটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে দুইটা জিনিস থাকে। একটা হচ্ছে স্বাধীনতা, আরেকটি দায়িত্ববোধ।সামাজিক মাধ্যম স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ব্যাপক একটা বিষয়। কিন্তু দায়িত্ববোধের ক্ষেত্রে তাদের চরম দূর্বলতা।’

‘মূলধারা মিডিয়ার সুবিধা হচ্ছে, আমরা স্বাধীন এবং দায়িত্বশীল।এই সমন্বয়ের কারণে পাঠাক বা দর্শকরা মূলধারার কাছেই আসবে। যেটাকে কেন্দ্র করে আমরা আমাদের জায়গায় থাকব।’

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ই ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ বেশি তোলা হয়েছে।

তবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদেরও অনেকে তাদের পোস্টে ভাষার ব্যবহার,অশ্লীল বা আক্রমণাতœক শব্দের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন।

যদিও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লীনা পারভিন মনে করেন, ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যম প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। তাঁরও প্রশ্ন আছে এই মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে।

‘যেহেতু মানুষের যাচাই বাছাই করার সুযোগ কম।আমরা কয়েকদিন আগে দেখলাম বিবিসি বা প্রথম আলোর মতো মিডিয়াগুলোর ফেইক সাইড বেরুচ্ছে।এখন একজন সাধারণ মানুষ যে গ্রামে বসে ফেসবুক দেখছে, তারপক্ষে কিন্তু বিবিসি কোনটা আসল কোনটা নকল, এটা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক যে আন্দোলনগুলো হযেছে কোটা আন্দোলন বা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সেখানেও দেখেছি কি পরিমাণ গুজব মানুষকে প্রভাবিত করেছে।

এমনকি আমরা শিক্ষিত মানুষরাও প্রভাবিত হয়েছি যে এ রকমই বোধায় হচ্ছে।কিন্তু সত্যটা অনেক পরে আমরা জানতে পেরেছি।

যারা সত্য জানতে চায়, তারা হয়তো জানতে পারছে। কিন্তু যারা সত্য বুঝতেই পারে না যে এটা মিথ্যা হতে পারে।তারা এতে প্রভাবিত হচ্ছে। নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এমন প্রভাব কিন্তু ফেলছে।’

গবেষক আফসান চৌধুরীও মনে করেন, সামাজিক গণমাধ্যম কাঠামোগতভাবেই এক পেশে। সেই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের এই সময়ে মূলধারার গণমাধ্যমের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

‘আমি যদি ভোক্তা হই, সঠিক খবরটা কোথায় পাব? তাহলে আমি মূলধারার গণমাধ্যমে যাব।আমি একপেশে না হলে মূলধারা গণমাধ্যমে যাব। মূলধারা গণমাধ্যমের খেয়াল রাখা দরকার একপেশে খবর যাতে না আসে।’

মূলধারার গণমাধ্যমও নিজেদের অনেকে পরিবর্তন করেছে। প্রিন্ট মিডিয়া এবং রেডিও-টেলিভিশন বা ইলেট্রনিক মিডিয়া, মূলধারা সব মাধ্যমই এখন অনলাইনে যেমন জোর দিচ্ছে, একইসাথে তারা সামাজিক মাধ্যমকেও ব্যবহার করছে।

মাহফুজ আনাম বলছিলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মূলধারার গণমাধ্যমও নতুন নতুন কৌশল নিয়ে এগিয়ে থাকবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

‘নির্বাচনের সময় মূলধারার গণমাধ্যম আরও বেশি দায়িত্ব হয়ে বিভিন্ন কৌশল নিয়ে অনলাইনে নিয়েছে।’

কিন্তু এখন সামাজিক মাধ্যমের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।বাংলাদেশে মানুষের প্রতিবাদ জানানো এবং সংগঠিত হওয়ার একটি বিকল্প পরিসর হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যম।

রাজনৈতিক দলগুলোও ভোটের লড়াইয়ে নিজেদের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহারের চেষ্টা যে করছে, তারাও অনেক প্রশ্ন তুলছে।

আওয়ামী লীগের মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছিলেন, সামাজিক মাধ্যমে অনেক সময়ই নেতিবাচক প্রচারণার পাশে ইতিবাচক বিষয়কে তুলে ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

দলগুলোও যে অনেক সময়ই প্রতিপক্ষের নেতিবাচক দিকগুলোই তুলে ধরে সামাজিক মাধ্যমে।সেটা কোন দলই স্বীকার করতে রাজি নয়।

বিএনপির শামা ওবায়েদ বলছিলেন, সামাজিক মাধ্যমে অনেক সময় ব্যক্তিগত পর্যায়েও আক্রমণ করা হয়।তবে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে তারা ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে তাদের দল থেকে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করছেন বলে তিনি দাবি করেন।

বড় দুটি দল ছাড়াও বামপন্থি, ইসলামপন্থিসহ সব দল এবং এমনকি নির্বাচনের প্রার্থীরা এবং তাদের সমর্থকরাও নিজেদের মতো করে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করছেন।

দলগুলো বলছে, সামাজিক মাধ্যমে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন থাকলেও এর জনপ্রিয়তার কারণে নির্বাচনে তারা কার্যকরভাবেই এই প্লাটফরমকে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ