আজকের শিরোনাম :

কুঁচিয়া চাষ যেভাবে অনেকের জন্য আর্শীবাদ হয়ে উঠেছে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:১৭

বাংলাদেশের মানুষ কুঁচিয়া চিনলেও মাছ হিসেবে খেতে বেশিরভাগই পছন্দ করেন না। কিন্তু বিদেশে এটি অনেক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এর জনপ্রিয়তা আছে।

কুঁইচা, কুইচ্চা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি নামে বিভিন্ন এলাকায় মাছটি পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম গড়হড়ঢ়ঃবৎঁং পঁপযরধ।

ঈল প্রজাতির, অনেকটা বাইন মাছের মত এই মাছটি সাধারণত পুকুর, হাওর, বাঁওড়, খাল বা ধানক্ষেতের তলদেশে বাস করে। অনেক সময় মাটিতে গর্ত করেও কুঁচিয়া বসবাস করে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ অপছন্দ করলেও কৃষি তথ্য সার্ভিসে বলা হয়েছে, এটি শারীরিক দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, বাতজ্বর, পাইলসসহ অনেক রোগ সারাতে মহৌষধের মতো কাজ করে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (আইইউসিএন) এর ২০০০ সালের তালিকা অনুযায়ী, এই মাছটিকে বিলুপ্তপ্রায় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারপরেও বিদেশেও এই মাছের যথেষ্ট চাহিদা থাকায় ব্যাপক হারে প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়।

তবে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেও বাণিজ্যিকভাবে কুঁচিয়ার চাষাবাদ শুরু হয়েছে।

কুঁচিয়া চাষ পাল্টে দিয়েছে পুতুল রানীর জীবন
সাধারণত বাংলাদেশে প্রকৃতি থেকেই কুঁচিয়া আহরণ করা হত। খাবার হিসাবে তেমন জনপ্রিয়তা না থাকায় হওয়ায় কোনরূপ চাষাবাদ ছাড়াই প্রচুর কুঁচিয়া মাছ পাওয়া যেত।

কিন্তু বিদেশে এই মাছের রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুঁচিয়ার চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবেই অনেকে কুঁচিয়ার চাষ করতে শুরু করেছেন। তাদের একজন দিনাজপুরের বিরামপুরের পুতুল রানী রায়।

তিনি তার বাড়ির পাশে পতিত জমিতে চৌবাচ্চা করে প্রথম ছোট আকারে কুঁচিয়ার চাষ শুরু করেন। পরে চাহিদা দেখে আকার আরও বাড়িয়েছেন।

“প্রথমে অল্প করে শুরু করেছিলাম। তারপর দেখলাম লাভ ভালই হচ্ছে। নিজেরাই খেতে পারছি আবার টাকাও আয় হচ্ছে। পরে আমি আরও কয়েকটি চৌবাচ্চা তৈরি করেছি।”

তিনি জানান, স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে তিনি প্রথমে দুইটি চৌবাচ্চা করে কুঁচিয়া চাষ শুরু করেন। সেই সঙ্গে কুঁচিয়ার খাবার হিসাবে দেয়ার জন্য পাশেই দুইটি রিং স্ল্যাবের ভেতরে কম্পোস্ট সার তৈরি করে কেঁচোর চাষাবাদও শুরু করেন।

“কুঁচিয়া তো রাক্ষুসে ধরনের মাছ, কিন্তু থাকে একেবারে মাটির নীচের দিকে। সেখানে কিছু পাইপ দিয়ে রেখেছি, ওরা সেই পাইপের মধ্যে ঢুকে থাকে। ওদের খাবারের জন্য পুকুরে তেলাপিয়া মাছ ছেড়েছি। সেগুলোর বাচ্চা হলে কুঁচিয়া খেয়ে ফেলে। তেলাপিয়া বড় হলে আমরাও খাই। এ ছাড়া খাবার হিসাবে কেঁচো দেই”, বলছিলেন তিনি।

কুঁচিয়ার খাবার হিসেবে দেয়ার জন্য তিনি কেঁচোর চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু এখন সেটাই তার আরেকটা আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে।

“গত ছয় মাসে কেঁচো আর কম্পোস্ট সার বিক্রি করেছি প্রায় এক লাখ টাকার। আর কুঁচিয়া তো আমরাও ধরে খাই। না হলে কুঁচিয়া বিক্রি হতো ২০/৩০ হাজার টাকার। আমার স্বামী চাষাবাদ করে। কিন্তু এখন আমার ইনকাম আমার স্বামীর চেয়েও বেশি,” হাসতে হাসতে বলছিলেন পুতুল রানী রায়।

কুঁচিয়া চাষের পদ্ধতি
সাধারণত চৌবাচ্চা বা বাড়িতে কংক্রিটের স্থাপনা বা ডিচ তৈরি করে কুঁচিয়ার চাষাবাদ করা হয়।

পুতুল রানী রায় জানান, তার বাড়িতে প্রথমে মাটিতে পাঁচ ফিট গর্ত করে নিচে ও চারপাশে মোটা পলিথিন বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। চাইলে এটা বাধাই করেও ফেলা যায়। কুঁচিয়া যাতে গর্ত খুড়ে চলে না যায়, তাই এই ব্যবস্থা। এ ছাড়া পানি যেতে নেমে না যায়, সেটির জন্যও এটা কাজ করে।

এরপর সেই পলিথিনের ওপর মাটির স্তর তৈরি করে দেয়া হয়। এরপর কয়েকটি মোটা পাইপ ফেলে রাখা হয়। কুঁচিয়া যেহেতু অন্ধকার পছন্দ করে, তাই তারা এসব পাইপের ভেতর ঢুকে থাকতে পারে।

এরপর পানি দিয়ে চৌবাচ্চা বা ডিচ ভর্তি করে রাখা হয়। কুঁচিয়ার খাবার হিসাবে তেলাপিয়া বা মলা মাছ জাতীয় ছোট মাছ ছেড়ে দেয়া হয়। তেলাপিয়ার বাচ্চা কুঁচিয়া খেয়ে থাকে। অনেকে মুরগির উচ্ছিষ্ট দিতে পারেন, কিন্তু তাতে পানি ময়লা হয়ে যায়।

প্রাকৃতিক উৎস থেকে মা কুঁচিয়া ধরে এসব চৌবাচ্চায় ছেড়ে দেয়া হয়। সাধারণত মে, জুন বা জুলাই মাসে এগুলো বাচ্চা ছাড়ে। এসব বাচ্চা পরের বছর জুন মাস নাগাদ বিক্রির উপযোগী হয়ে যায়।

অনেকে আবার প্রাকৃতিক উৎস থেকে ছোট কুঁচিয়া সংগ্রহ করে চৌবাচ্চায় লালনপালন করে বড় করে বিক্রি করেন।

কৃষকদের মধ্যে কুঁচিয়া চাষের চাহিদা বাড়ছে
বাংলাদেশের সরকার কয়েক বছর আগে কুঁচিয়া চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। এর মাধ্যমে কুঁচিয়া চাষে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে পল্লী দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা কুঁচিয়া চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিতে শুরু করে।

দেশের অন্তত ৩০টি জেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে কুঁচিয়ার চাষ হচ্ছে। পিকেএসএফ ২১টি জেলার ৩৩টি উপজেলায় কুঁচিয়া চাষের জন্যই ঋণ দিচ্ছে।

এসব প্রকল্পের আওতায় কয়েকশ কৃষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

এ রকম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিনাজপুরের গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলছেন, ২০১৭ সাল থেকে তারা ৩০০ পুকুর বা চৌবাচ্চার মতো তৈরি করে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন।

“প্রথম প্রথম অনেকে আগ্রহী হয়নি। পরে অন্যদের লাভ করতে দেখে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে এখানে যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে, তারা নিজেরাও কুঁচিয়া খায়। ফলে চাষ করার কারণে একদিকে যেমন তাদের একটা পছন্দের খাবার পাচ্ছে, আবার ঘরে টাকা আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে”, বলেন রবিউল ইসলাম।

এর ফলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা এই মাছের আহরণও কমে যাবে বলে তিনি আশা করছেন।

তিনি জানান, ৯ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কেউ যদি ছোট আকারেও কুঁচিয়ার চাষাবাদ করে, তাহলে বছরে অন্তত ছয় হাজার টাকা লাভ থাকবে। কুঁচিয়ার খাবার হিসাবে তেলাপোকার পোনা আর কেঁচো দেয়া হয়। ফলে একদিকে তেলাপিয়াও তারা পাবে, আবার কেঁচো বা কম্পোস্ট সার বিক্রি বাড়তি লাভ আনবে।

তিনি জানান, এখন পাইকাররা সরাসরি এসব খামারে এসে কুঁচিয়া কিনে নিয়ে ঢাকায় বিক্রি করেন। ফলে কৃষকদেরও এটি চাষে আগ্রহ বাড়ছে।

দিনাজপুরের কুচিয়ার ব্যবসায়ী বাবলু মিয়া বলছেন, “এখন বছরে দেড়শো দুইশও মণ কুঁচিয়া বিক্রি করি। কিন্তু চাহিদা আছে আরও অনেক বেশি। যদি দুই হাজার মণ কুঁচিয়াও পাওয়া যায়, তাও বিক্রি হয়ে যাবে। ঢাকার ব্যবসায়ীরা যত চায়, সবসময় তো সেই জোগানও দিতে পারি না।”

ঢাকার একজন পাইকারি বিক্রেতা ফজলু মিয়া বলছেন, “সারাদেশ থেকেই তাদের কাছে কুঁচিয়া আসে। তবে এখনো বেশিরভাগ কুঁচিয়া প্রাকৃতিক উৎস থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়। গুটিকয়েক জায়গা থেকে তারা চাষের কুঁচিয়া পান।”

বিদেশে আরও বেশি রপ্তানির সুযোগ রয়েছে
বাংলাদেশে কুঁচিয়া তেমন জনপ্রিয় মাছ না হলেও অনেক দেশে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার।

বাংলাদেশ থেকে প্রধানত চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং, কানাডা, কুয়েত, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান ও মিয়ানমারে কুঁচিয়া রপ্তানি হয়ে থাকে।

এই রপ্তানি চাহিদা বেশিরভাগের জোগান আসে প্রাকৃতিক উৎস থেকে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০১৯-২০২০ সালে জ্যান্ত ও শুকনো মিলিয়ে মোট কুঁচিয়া রপ্তানি হয়েছে এক কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ডলারের বেশি। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে চীনে, এক কোটি ডলারের ওপরে।

বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিলড ফুড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহবুবুল আলম বলছেন, “বিশ্বে কুঁচিয়া এবং কাঁকড়ার যে চাহিদা আছে, সব তো আমরা দিতে পারছি না। জোগান পাওয়া গেলে আমরা যত রপ্তানি করি, এর চেয়েও বেশি রপ্তানি করা সম্ভব।”

তিনি জানান, করোনাভাইরাসের কারণে আপাতত চীনসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার রপ্তানি বাড়বে বলে তিনি আশা করছেন।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ