বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
‘পঞ্জি মডেলে’ পরিচালিত ইভ্যালি ব্যর্থ হলো যেসব কারণে
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৫৫
২০১৮ সালে যখন ইভ্যালি প্রতিষ্ঠিত হয়, অল্প সময়েই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
ইভ্যালিতে মোটরসাইকেল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, পোশাক-আশাক, খাদ্য-পণ্যসহ যত ধরণের পণ্য বিক্রি হয় তার প্রায় সব কিছুর বিপরীতে ব্যাপক ছাড়, আর লোভনীয় ক্যাশব্যাক অফার যেমন ছিল, তেমনি ছিল দেশের নামি তারকাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা, টিভি চ্যানেলসহ সব গণমাধ্যমে দর্শনীয় বিজ্ঞাপনসহ দৃষ্টি আকর্ষণের সব চেষ্টাই।
কিন্তু বাংলা প্রবাদ ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’র মত নজরকাড়া অভিষেক হলেও শুরুর কিছুদিন পর থেকেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল।
কিন্তু প্রথম দিকে বড় বড় ছাড় আর বাজারমূল্যের অর্ধেক দামে পণ্য পেয়ে অনেক ক্রেতা খুশিও ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মাত্র তিন বছরে এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। তবে গ্রাহকের খুশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
প্রতিষ্ঠার তিন বছর পূরণ হওয়ার আগেই এক রকম ধসে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সাড়া জাড়ানো প্রতিষ্ঠানটি কেন ব্যর্থ হলো?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইভ্যালির ব্যবসায়িক মডেলের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন কোন মডেল বিশ্বে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলছেন, ইভ্যালি যেভাবে ব্যবসা করছিল তাকে অ্যাকাডেমিক ভাষায় পঞ্জি মডেল বলা হয়। এ মডেলে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আর গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে কিছু মানুষকে ছাড়, পুরষ্কার বা লভ্যাংশ দিয়ে মানুষের লোভ বা আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রাখা হয়। এখানে প্রতিষ্ঠানের নিজের বিনিয়োগ থাকে একেবারেই কম। পঞ্জি স্কিম কাজ করে কীভাবে?
অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলছেন, ‘ধরা যাক, আমি একটা খুব চটকদার বিজ্ঞাপন দিলাম যে এক লাখ টাকার মোটরসাইকেল পঞ্চাশ হাজার টাকায় দেব। যারা গ্রাহক তারা কিন্তু এটা চিন্তা করে না যে ১ লাখ টাকার মোটরসাইকেল কেমন করে ৫০ হাজার টাকায় দিচ্ছে। প্রথমে এ রকম আট-দশজনকে দিল, এটার একটা মাল্টিপ্লাইড এফেক্ট আছে। আমি এ রকম একটা পেলে আরও দশজনকে বলব, ওরাও অ্যাপ্লাই করবে। তো টাকার ইনফ্লোটা কিন্তু অনেক হবে। আর প্রতিষ্ঠান তো আগে অ্যাডভান্স নিয়ে নিয়েছে টাকা, অ্যাডভান্স নিয়ে এখন পাঁচ বা দশ শতাংশ লোককে সে ডেলিভারি দিচ্ছে। কিন্তু ম্যাক্সিমাম লোক ডেলিভারি পাচ্ছে না। এই টাকাগুলোই তারা বাজারে রিভলভ করছে।’ আর দশজনের খবর শুনে আরো একশজন অ্যাপ্লাই করছে, তারাও টাকা অ্যাডভান্স করছে—এই টাকা দিয়েই কোম্পানি প্রোডাক্ট কেনে এবং ডেলিভারি দেয়-বলছিলেন অধ্যাপক আহমদ। ঠিক এভাবেই ইভ্যালি ব্যবসা করছিল। অধ্যাপক মুশতাক আহমদ মনে করেন, এটাই ইভ্যালির বিজনেস মডেল। তবে তিনি বলছেন, এটা সাস্টেইনেবল বা টেকসই কোন মডেল না। পঞ্জি স্কিমে যারা ব্যবসা করে, তাদের শর্ট-রান ভিশন থাকে যে মানুষের টাকায় ব্যবসা করে অল্প সময়ে কিছু টাকা বানিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া বা অন্যভাবে মার্কেট থেকে টাকা তুলে তারা চলে যাবে। ব্যবসায়িক নিয়মনীতির বালাই নেই
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, যে কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগ সফল করতে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি ও ধরে রাখা, এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা- এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে না পারলে সে ব্যবসা ধসে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, ইভ্যালির ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক নিয়মনীতির দৃশ্যমান ঘাটতি ছিল। তিনি বলেন, ই-কমার্স ব্যবসায় যেহেতু বিক্রেতা এবং গ্রাহকের সামনাসামনি দেখা হয় না, সে কারণে এখানে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আস্থা এগুলোই মূল ভিত্তি। তিনি বলেন, “ইভ্যালি এবং এর মত দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা হচ্ছে, সাধারণত পণ্যের মান ঠিক রাখা, সময়মত ডেলিভারি দেয়া এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে পণ্য যদি পছন্দ না হয় বা ত্রুটি থাকে, তাহলে সেটি ফেরত দেয়া—সেগুলোর ব্যবস্থা থাকতে হয়। আরেকটি হচ্ছে টাকা দেয়ার পর পণ্য ডেলিভারি না দেয়া, সেটা প্রতিকারও থাকতে হবে। এগুলো ইভ্যালিতে দেখা যায়নি। ফলে ব্যবসার যে সাধারণ নীতিমালা ও জবাবদিহিতা জনিত নৈতিকতা সেগুলো এখানে মানা হচ্ছিল না।” ইভ্যালিতে অর্ডার করা পণ্য সময়মত না পেলে কিংবা একেবারেই না পেলে গ্রাহক কোথায় অভিযোগ করবে- তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু অ্যামাজনের মতো বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্ডার করা পণ্য সময় মত না পেলে, কবে আসবে সেটি জানানোর এবং অভিযোগ জানাবার জন্য কার্যকর যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকে। বকেয়া ফেরতের কী ব্যবস্থা হবে?
ধারাবাহিক এসব ব্যর্থতার ফলে গ্রাহক এবং মার্চেন্ট অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে সরবারহ দেয়া হবে---উভয়ের কাছে ব্যাপক দেনা হয়েছে ইভ্যালির। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আগস্ট মাসে ইভ্যালি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি হিসাব দিয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ১৫ই জুলাই পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ৩১১ কোটি টাকা। আর মার্চেন্ট অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে সরবারহ করার কথা তাদের কাছে দেনা ২০৫ কোটি টাকা। এমন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের দুইজন শীর্ষ নির্বাহী গ্রেপ্তার হওয়ায় গ্রাহক ও মার্চেন্টরা নিজেদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। মো. রাসেল এবং তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের গ্রেপ্তারের পর ধানমণ্ডিতে ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তা সত্ত্বেও গ্রাহক ও মার্চেন্টদের একটি অংশ প্রায় প্রতিদিনই ইভ্যালি অফিসের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করছেন। বিক্ষোভকারীরা মো. রাসেলের মুক্তি চান। তারা মনে করছেন কোম্পানির শীর্ষ ব্যক্তিরা কারাগারে থাকলে তারা অর্থ ফেরত পাবেন না। কিন্তু গ্রাহক বা মার্চেন্ট তাদের অর্থ ফেরত কবে পাবেন, আদৌ পাবেন কি না- সে বিষয়ে এখনো কোন বক্তব্য আসেনি ইভ্যালি কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে। বুধবার ঢাকায় বাণিজ্যমন্ত্রী ইভ্যালি ইস্যুতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সেখানেও এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য আসেনি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখন ইভ্যালির দায়িত্ব নিতে না চাইলেও, মূলত তাদের উদাসীনতার সুযোগ নিয়েই এ ধরনের আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক আহমদ বলছেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযোগ হঠাৎ করে ওঠেনি, গত এক/দেড় বছর ধরেই নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি ঠিক সময়ে ব্যবসার ধরণ ও লেনদেনের পদ্ধতির দিকে নজর দিত তা হলে অসঙ্গতির মাত্রা বড় হতো না তিনি বলেন, “গভর্নমেন্টের আরো আগেই চিহ্নিত করা দরকার ছিল কোনটা পঞ্জি স্কিম। তখন গভর্নমেন্ট কিছু ব্যবস্থা নিতে পারবে, কিছু রেগুলেশন অ্যাপ্লাই করতে পারবে। যেমন এই ডিসকাউন্ট কোথা থেকে দিচ্ছ, তোমার লস কোথা থেকে তুমি বের করে আনবে সেটা জানাতে হবে।” তিনি বলেন, “দেখেন এমএলএম স্কিম বন্ধ করেছে সরকার, কিন্তু দেশে বিভিন্ন নামে এসব চলছেও। মানে হচ্ছে নজরদারির অভাবে হচ্ছে সেসব।” নীতিমালা নেই, নীতিমালা আছে
বাংলাদেশে প্রায় এক যুগ ধরে ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটছে। কিন্তু ই-কমার্স পরিচালনার কোনো নীতিমালাও ছিল না দেশে। জুলাই মাসের শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০২০ নামে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করে, যাতে ডেলিভারি পাবার পর মূল্য পরিশোধ এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেলিভারি না পেলে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সে সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও সর্বোচ্চ একজন গ্রাহক ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারবে। সে অভিযোগ মীমাংসা না হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বড় কোন শাস্তি বা লাইসেন্স বাতিলের মত ব্যাপার ঘটবে না। এখন ইভ্যালি নিয়ে এত কাণ্ডের পর সরকার বলছে, ই-কমার্স খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও প্রতারণা ঠেকাতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ইভ্যালির বকেয়া অর্থ পরিশোধের দায় সরকার নিতে পারবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি টাকা ফেরত দিতে পারবে কি-না, সে ব্যাপারে সরকার ইভ্যালির সাথে কথা বলবে। তিনি বলেন, “সরকার তো দায় গ্রহীতা না যে ওই টাকা সরকার দেবে। এটা তো একটা ব্যবসা, যারা দিয়েছে তারা ব্যবসা করে নিয়েছে। তবে ফর্জারি হলে সেটা আমরা দেখব। ইভ্যালি বা এরকম প্রতিষ্ঠানগুলোর কী সম্পদ আছে সেটা দেখে আমাদের কমিটি ঠিক করবে যে তাদের কোন প্রপার্টি আছে কি না, আর তা দিয়ে কতটা কী করা যায়।” বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ইভ্যালির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এরপর অর্থ ফেরত দেবার জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে। তবে অর্থ ফেরত নিয়ে সিদ্ধান্ত যাই হোক অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের জন্য ইভ্যলির ব্যর্থতা একটি বড় ধাক্কা। কারণ গ্রাহকের আস্থায় এক ধরনের সংকট যে দেখা দিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর তা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যবসায়ীদের যেমন নিয়মের মধ্যে ব্যবসা করতে হবে, তেমনি সরকারকে সব সময়ই নজরদারি বহাল রাখতে হবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য। এবিএন/সাদিক/জসিম
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইভ্যালির ব্যবসায়িক মডেলের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন কোন মডেল বিশ্বে দীর্ঘ মেয়াদে সফল হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলছেন, ইভ্যালি যেভাবে ব্যবসা করছিল তাকে অ্যাকাডেমিক ভাষায় পঞ্জি মডেল বলা হয়। এ মডেলে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আর গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে কিছু মানুষকে ছাড়, পুরষ্কার বা লভ্যাংশ দিয়ে মানুষের লোভ বা আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রাখা হয়। এখানে প্রতিষ্ঠানের নিজের বিনিয়োগ থাকে একেবারেই কম। পঞ্জি স্কিম কাজ করে কীভাবে?
অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলছেন, ‘ধরা যাক, আমি একটা খুব চটকদার বিজ্ঞাপন দিলাম যে এক লাখ টাকার মোটরসাইকেল পঞ্চাশ হাজার টাকায় দেব। যারা গ্রাহক তারা কিন্তু এটা চিন্তা করে না যে ১ লাখ টাকার মোটরসাইকেল কেমন করে ৫০ হাজার টাকায় দিচ্ছে। প্রথমে এ রকম আট-দশজনকে দিল, এটার একটা মাল্টিপ্লাইড এফেক্ট আছে। আমি এ রকম একটা পেলে আরও দশজনকে বলব, ওরাও অ্যাপ্লাই করবে। তো টাকার ইনফ্লোটা কিন্তু অনেক হবে। আর প্রতিষ্ঠান তো আগে অ্যাডভান্স নিয়ে নিয়েছে টাকা, অ্যাডভান্স নিয়ে এখন পাঁচ বা দশ শতাংশ লোককে সে ডেলিভারি দিচ্ছে। কিন্তু ম্যাক্সিমাম লোক ডেলিভারি পাচ্ছে না। এই টাকাগুলোই তারা বাজারে রিভলভ করছে।’ আর দশজনের খবর শুনে আরো একশজন অ্যাপ্লাই করছে, তারাও টাকা অ্যাডভান্স করছে—এই টাকা দিয়েই কোম্পানি প্রোডাক্ট কেনে এবং ডেলিভারি দেয়-বলছিলেন অধ্যাপক আহমদ। ঠিক এভাবেই ইভ্যালি ব্যবসা করছিল। অধ্যাপক মুশতাক আহমদ মনে করেন, এটাই ইভ্যালির বিজনেস মডেল। তবে তিনি বলছেন, এটা সাস্টেইনেবল বা টেকসই কোন মডেল না। পঞ্জি স্কিমে যারা ব্যবসা করে, তাদের শর্ট-রান ভিশন থাকে যে মানুষের টাকায় ব্যবসা করে অল্প সময়ে কিছু টাকা বানিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া বা অন্যভাবে মার্কেট থেকে টাকা তুলে তারা চলে যাবে। ব্যবসায়িক নিয়মনীতির বালাই নেই
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, যে কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগ সফল করতে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি ও ধরে রাখা, এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা- এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে না পারলে সে ব্যবসা ধসে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, ইভ্যালির ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক নিয়মনীতির দৃশ্যমান ঘাটতি ছিল। তিনি বলেন, ই-কমার্স ব্যবসায় যেহেতু বিক্রেতা এবং গ্রাহকের সামনাসামনি দেখা হয় না, সে কারণে এখানে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আস্থা এগুলোই মূল ভিত্তি। তিনি বলেন, “ইভ্যালি এবং এর মত দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা হচ্ছে, সাধারণত পণ্যের মান ঠিক রাখা, সময়মত ডেলিভারি দেয়া এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে পণ্য যদি পছন্দ না হয় বা ত্রুটি থাকে, তাহলে সেটি ফেরত দেয়া—সেগুলোর ব্যবস্থা থাকতে হয়। আরেকটি হচ্ছে টাকা দেয়ার পর পণ্য ডেলিভারি না দেয়া, সেটা প্রতিকারও থাকতে হবে। এগুলো ইভ্যালিতে দেখা যায়নি। ফলে ব্যবসার যে সাধারণ নীতিমালা ও জবাবদিহিতা জনিত নৈতিকতা সেগুলো এখানে মানা হচ্ছিল না।” ইভ্যালিতে অর্ডার করা পণ্য সময়মত না পেলে কিংবা একেবারেই না পেলে গ্রাহক কোথায় অভিযোগ করবে- তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু অ্যামাজনের মতো বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্ডার করা পণ্য সময় মত না পেলে, কবে আসবে সেটি জানানোর এবং অভিযোগ জানাবার জন্য কার্যকর যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকে। বকেয়া ফেরতের কী ব্যবস্থা হবে?
ধারাবাহিক এসব ব্যর্থতার ফলে গ্রাহক এবং মার্চেন্ট অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে সরবারহ দেয়া হবে---উভয়ের কাছে ব্যাপক দেনা হয়েছে ইভ্যালির। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আগস্ট মাসে ইভ্যালি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি হিসাব দিয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ১৫ই জুলাই পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ৩১১ কোটি টাকা। আর মার্চেন্ট অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে সরবারহ করার কথা তাদের কাছে দেনা ২০৫ কোটি টাকা। এমন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের দুইজন শীর্ষ নির্বাহী গ্রেপ্তার হওয়ায় গ্রাহক ও মার্চেন্টরা নিজেদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। মো. রাসেল এবং তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের গ্রেপ্তারের পর ধানমণ্ডিতে ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তা সত্ত্বেও গ্রাহক ও মার্চেন্টদের একটি অংশ প্রায় প্রতিদিনই ইভ্যালি অফিসের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করছেন। বিক্ষোভকারীরা মো. রাসেলের মুক্তি চান। তারা মনে করছেন কোম্পানির শীর্ষ ব্যক্তিরা কারাগারে থাকলে তারা অর্থ ফেরত পাবেন না। কিন্তু গ্রাহক বা মার্চেন্ট তাদের অর্থ ফেরত কবে পাবেন, আদৌ পাবেন কি না- সে বিষয়ে এখনো কোন বক্তব্য আসেনি ইভ্যালি কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে। বুধবার ঢাকায় বাণিজ্যমন্ত্রী ইভ্যালি ইস্যুতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সেখানেও এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য আসেনি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখন ইভ্যালির দায়িত্ব নিতে না চাইলেও, মূলত তাদের উদাসীনতার সুযোগ নিয়েই এ ধরনের আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক আহমদ বলছেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযোগ হঠাৎ করে ওঠেনি, গত এক/দেড় বছর ধরেই নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি ঠিক সময়ে ব্যবসার ধরণ ও লেনদেনের পদ্ধতির দিকে নজর দিত তা হলে অসঙ্গতির মাত্রা বড় হতো না তিনি বলেন, “গভর্নমেন্টের আরো আগেই চিহ্নিত করা দরকার ছিল কোনটা পঞ্জি স্কিম। তখন গভর্নমেন্ট কিছু ব্যবস্থা নিতে পারবে, কিছু রেগুলেশন অ্যাপ্লাই করতে পারবে। যেমন এই ডিসকাউন্ট কোথা থেকে দিচ্ছ, তোমার লস কোথা থেকে তুমি বের করে আনবে সেটা জানাতে হবে।” তিনি বলেন, “দেখেন এমএলএম স্কিম বন্ধ করেছে সরকার, কিন্তু দেশে বিভিন্ন নামে এসব চলছেও। মানে হচ্ছে নজরদারির অভাবে হচ্ছে সেসব।” নীতিমালা নেই, নীতিমালা আছে
বাংলাদেশে প্রায় এক যুগ ধরে ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটছে। কিন্তু ই-কমার্স পরিচালনার কোনো নীতিমালাও ছিল না দেশে। জুলাই মাসের শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০২০ নামে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করে, যাতে ডেলিভারি পাবার পর মূল্য পরিশোধ এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেলিভারি না পেলে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সে সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও সর্বোচ্চ একজন গ্রাহক ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারবে। সে অভিযোগ মীমাংসা না হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বড় কোন শাস্তি বা লাইসেন্স বাতিলের মত ব্যাপার ঘটবে না। এখন ইভ্যালি নিয়ে এত কাণ্ডের পর সরকার বলছে, ই-কমার্স খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও প্রতারণা ঠেকাতে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ইভ্যালির বকেয়া অর্থ পরিশোধের দায় সরকার নিতে পারবে না। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি টাকা ফেরত দিতে পারবে কি-না, সে ব্যাপারে সরকার ইভ্যালির সাথে কথা বলবে। তিনি বলেন, “সরকার তো দায় গ্রহীতা না যে ওই টাকা সরকার দেবে। এটা তো একটা ব্যবসা, যারা দিয়েছে তারা ব্যবসা করে নিয়েছে। তবে ফর্জারি হলে সেটা আমরা দেখব। ইভ্যালি বা এরকম প্রতিষ্ঠানগুলোর কী সম্পদ আছে সেটা দেখে আমাদের কমিটি ঠিক করবে যে তাদের কোন প্রপার্টি আছে কি না, আর তা দিয়ে কতটা কী করা যায়।” বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ইভ্যালির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এরপর অর্থ ফেরত দেবার জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে। তবে অর্থ ফেরত নিয়ে সিদ্ধান্ত যাই হোক অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের জন্য ইভ্যলির ব্যর্থতা একটি বড় ধাক্কা। কারণ গ্রাহকের আস্থায় এক ধরনের সংকট যে দেখা দিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর তা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যবসায়ীদের যেমন নিয়মের মধ্যে ব্যবসা করতে হবে, তেমনি সরকারকে সব সময়ই নজরদারি বহাল রাখতে হবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য। এবিএন/সাদিক/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ