আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশে এলপিজির দাম প্রতি মাসেই কেন সমন্বয় করা হয়

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:০৬

গৃহস্থালিতে গ্যাসের সংযোগ সীমিত করে আনায় এখন অনেকেই ঝুঁকেছেন এলপিজি গ্যাস ব্যবহারে। লিকুফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস কিংবা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস যা এলপিজি নামে পরিচিত সেটির দাম নির্ধারণ নিয়ে সোমবার আবারো গণ শুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি।

ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির মূল্য হার পরিবর্তনের জন্য অনুষ্ঠিত ওই গণ শুনানিতে বেসরকারি এলপিজি মজুতকরণ ও বোতলজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়।

এদিকে এনিয়ে বেশ কয়েক বার এই গ্যাসের দাম নির্ধারণ নিয়ে গণ শুনানি হলো। এছাড়া প্রায় প্রতিমাসেই এই পণ্যটির দাম সমন্বয় করা হয়ে থাকে। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম এতো ঘন ঘন কেন পরিবর্তন করা হয়?

‘খুব লস হয়ে যাচ্ছে’

বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে রান্নার কাজে এটি সরকারি গ্যাস সংযোগের বিকল্প হয়ে উঠছে।
 
রাজধানী ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড এলাকার বাসিন্দা সুলতানা দোয়েল। তিনি জানান, গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে সিলিন্ডারের মাধ্যমে রান্নার কাজে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছেন তিনি।

রাজধানীতে নতুন করে গড়ে ওঠা বহুতল আবাসিক ভবনগুলোতে নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ থাকার কারণে এই গ্যাসই এখন তার সংসারের অন্যতম অনুষঙ্গ।

তবে চার জনের পরিবারের রান্নার চাহিদা পূরণ করতে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার দরকার হয়। দুটি সিলিন্ডার মিলিয়ে মোট ৪৫ লিটার গ্যাস কিনতে তার খরচ পড়ে প্রায় ৪ হাজার টাকার মতো।
 
সুলতানা দোয়েল বলেন, ‘টেনে হিঁচড়ে প্রায় দেড় মাস যায় আমার এই গ্যাসে।’

তিনি বলেন, সরকারি গ্যাস সংযোগ পেলে যেখানে প্রতি দুই মাসে ২ হাজার টাকা বিল দিতে হয়, সেখানে তাকে দেড় মাসেই দিতে হয় ৪ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, ‘এটা খুব লস হয়ে যাচ্ছে। তবে বাধ্য করে ব্যবহার করতে হচ্ছে।’

ভোক্তাদের এমন অভিযোগের পরই ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাব এর করা মামলার পর ২০২০ সাল থেকে এলপিজির দাম নির্ধারণ শুরু হয়।

প্রতিষ্ঠানটির জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, এলপিজির ব্যবসায়ীরা দাম নির্ধারণের জন্য বিইআরসিতে আবেদন না করার কারণে দীর্ঘদিন এই পণ্যটির কোন দাম নির্ধারণ হয়নি।

গত বছর আদালতের নির্দেশনার পর এই পণ্যটির দাম নির্ধারণে গণ শুনানি হয়। সর্বশেষ গত এপ্রিলে একটি গণ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে তখন যে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল সেটি এলপিজি ব্যবসায়ীরা কার্যকর না করায় ভোক্তা অধিকারের পক্ষে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ আপত্তি তোলে।

যার ফলে অগাস্টে আবারো গণ শুনানির তারিখ নির্ধারিত হলেও সেটি কোভিড ও হাইকোর্টের আদেশের কারণে পিছিয়ে যায়।
 
গণ শুনানি ও দাম সমন্বয় কী?

বাংলাদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সহকারী পরিচালক শাহাদত হোসেন বলেন, গণ শুনানি এবং দাম সমন্বয়ের বিষয়টি একটু ভিন্ন।প্রতিমাসেই এলপিজির দাম সমন্বয় করা হয়। আর গণ শুনানি হয় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।

এছাড়া প্রতিমাসে দাম সমন্বয়ের বিষয়ে হোসেন বলেন, এলপিজি এমন একটি পণ্য যেটি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আর এ কারণেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম উঠা-নামা করলে সে হিসেবে বাংলাদেশেও পণ্যটির দাম সমন্বয় করা হয়। এটি বিইআরসি করে থাকে।

আর গণ শুনানিতে এলপিজির মজুদ ও বোতলজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স রয়েছে এমন ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের প্রতিনিধিরা থাকেন।

সেখানে দুই পক্ষের যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি-দুটোই আমলে নিয়ে মাঝামাঝি একটি দাম নির্ধারণ করা হয়। এই কাজটিও করে থাকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।

এর মধ্যে এলপিজির দাম বৃদ্ধি নয় বরং বেসরকারি এলপিজির মজুদ ও বোতলজাত করার চার্জ, পরিবহণ খরচ, বিতরণ খরচ, রিটেইলার চার্জ ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়।

দাম কেন ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়?

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ার কারণে দেশে এলপিজি একটি আমদানি-নির্ভর পণ্য। তিনি বলেন, অপরিশোধিত তেল শোধনাগারে নিয়ে পরিশোধনের পর তেলের পাশাপাশি প্রায় ১০টি পণ্য বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে বেরিয়ে আসে। এলপি গ্যাস তার মধ্যে একটি।
 
যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে যখনই তেল বা এ জাতীয় পণ্যের দাম উঠানামা করে তখনই এ সম্পর্কিত পণ্যের দামও উঠানামা করে। তিনি বলেন, এ ধরণের পণ্যের কোন সুনির্দিষ্ট দাম থাকে না। একদিন এমনকি ঘণ্টার পার্থক্যের কারণেও দাম পরিবর্তিত হয়ে যায়।

আর এ কারণেই এলপিজির দামও ঘন ঘন পরিবর্তন হয়। তার মতে, দামের এমন ওঠানামা সহ্য করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করার নেই।

তিনি বলেন, এর আগে এলপি গ্যাসের দাম কোন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না থাকার কারণে এ বিষয়ে তেমন একটা নজরে আসেনি। যার কারণে এই প্রভাবের সাথে বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশি একটা পরিচিত নয়। তবে বিশ্বের অন্য শহরগুলোতে এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ডা. ইজাজ হোসেন বলেন, সরকার যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ এলপিজি আমদানি করে বাফার স্টক বা মজুদ করতে পারতো যাতে এগুলো দাম বাড়ার সময়টাতে ব্যবহার করা যেতো তাহলে এই দাম সমন্বয়ের বিষয়টি কিছুটা স্থিতিশীল করা সম্ভব। তবে এই সময় কখনোই তিন মাসের বেশি হওয়া সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনেক সময় সৌদি আরবের আরামকো কর্তৃপক্ষও মাস ভিত্তিক দাম বেধে দিয়ে থাকে যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে দাম সমন্বয় করা হয়।

ভোক্তাদের উপর কী প্রভাব পড়ছে?

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সমন্বয় করে গ্যাসের যে দাম নির্ধারণ করে তা কখনোই তেমন কার্যকর হতে দেখা যায় না। ফলে সেটি ভোক্তাদের উপর কী প্রভাব ফেলে তাও বোঝা যায় না।

সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ টন এলপিজি বাংলাদেশে আমদানি করা হয়।

আলম বলেন, আর এই আমদানির জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়, ভোক্তাদেরকে তার প্রায় ১০ গুণ টাকা দিয়ে এলপিজি কিনতে হয়। বাংলাদেশে ভোক্তাদের সিলিন্ডার প্রতি কমপক্ষে ১০০ টাকা করে বেশি দিতে হয়।
 
এ বিষয়ে সোমবার গণ শুনানিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্যাসের যে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় সেটি কার্যকর করা সম্ভব নয় কারণ এর ফলে তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।

জাহাজ ভাড়া, পরিবহন ব্যয়, এলসি মার্জিনসহ নানা খাতে তাদের ব্যয় বাড়ার কারণে এই দাম কমানো সম্ভব হয় না। কম দামে এই সেবা দেয়া সম্ভব হবে না বলেও জানান তারা।

এদিকে, বিইআরসির নির্ধারিত দাম কার্যকর হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে কী করা হয় এমন প্রশ্নে বিইআরসির সহকারী পরিচালক শাহাদত হোসেন বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া বিইআরসির আইনগত কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে পর্যায়ক্রমে এই কমিশনটিও এটি দেখবে বলে জানান তিনি। সূত্র : বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ