আজকের শিরোনাম :

রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যাওয়ার নেপথ্যে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২১, ১৫:৪৮

শুক্রবার বিকেলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার ওলে গুনার সোলশার যখন বিশৃঙ্খলার মধ্যেই জুমে সংবাদ সম্মেলনে বসেন, ততক্ষণে তিনি জেনে গেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই ফিরছেন।

যতই রোনালদোর ম্যানচেস্টার সিটি যাওয়ার জোরালো গুঞ্জন থাকুক না কেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার রাতেই বিশ্বাস করা শুরু করে পাঁচবারের ব্যালন ডি অর জয়ী ফুটবলারের গন্তব্য ইতিহাদ (ম্যানচেস্টার সিটির স্টেডিয়াম) থেকে চার মাইল দূরের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্টেডিয়াম) দিকেই সরে আসছে।

শেষ ধাক্কাটা আসে পরের দিন সকালে, যখন ইউনাইটেডের কিংবদন্তি চরিত্র স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন জড়িয়ে পড়েন গোটা ঘটনা প্রবাহে।

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের সঙ্গে রোনালদোর সম্পর্ক দৃঢ়। ২০০৯ সালেই স্পেনের রেয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান রোনালদো কিন্তু এই স্কটিশকে এখনো ‘দ্য বস’ বলেই সম্বোধন করেন। ইউনাইটেডে ফিরলে নায়কের মর্যাদা পাবেন, এই কথা বলে তিনি রোনালদোকে বোঝান। বিপরীত কিছু ঘটে গেলে সেটি ক্লাবটির জন্য দুর্নামই বয়ে নিয়ে আসতো, হয়তো ২০১৩ সালে ফার্গুসনের দায়িত্ব ছাড়ার পর ইউনাইটেডের যে বিবর্ণ অবস্থা তাকে আরও বিবর্ণ করে তুলত।

ফার্গুসনের পরে যোগ দেন রিও ফার্দিনান্দ ও প্যাট্রিক এভরা, যারা রোনালদোর ইউনাইটেড সতীর্থ ছিলেন।

এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ড্যারেন ফ্লেচার এবং রোনালদোর জাতীয় দলের সতীর্থ ব্রুনো ফার্নান্দেজের নামও চলে আসে।

ম্যান ইউনাইটেড ও রোনালদো চুক্তিতে একমত হওয়ার পর ব্রুনো টুইটারে নিজেকে ‘এজেন্ট’ বলে মজা করেন।

সোলশার সংবাদমাধ্যমে কথা বলার আগেই রোনালদোর জুভেন্টাস ছাড়া নিশ্চিত করেন ইতালিয়ান ক্লাবটির কোচ ম্যাক্স অ্যালেগ্রি।

সোলশারও জানতেন সেটি, কিন্তু মুখে বলেননি কারণ পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার আগে কিছুই বলা যাবে না। তবুও টেলিগ্রাফের সাংবাদিক চেষ্টা চালিয়ে যান, তৃতীয়বারের মতো প্রশ্নটি করেন তিনি, যদি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারের একজনকে সই করানোর সুযোগ থাকে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কি এই সুযোগ ছেড়ে দেবে?

সোলশার ক্যামেরার দিকে তাকান এবং ঠিক ততটুকু বলেন যতটুকু ইঙ্গিত যথেষ্ট যারা ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল- যদিও বিশ্বের অনেকেই এর আসল গুরুত্ব ধরতে পারেননি, কেউ কেউ বৃহস্পতিবারই জানতেন যে রোনালদো ইউনাইটেডে আসছে।

সোলশার বলেন, ‘আমি ভাবিনি রোনালদো জুভেন্টাস ছাড়বে, অনেকেই ধারণা করছিল বটে। আমাদের ভালো যোগাযোগ আছে, আমি জানি ব্রুনো রোনালদোর সাথে নিয়মিত কথা বলে। রোনালদো জানে আমরা তার সম্পর্কে কেমন অনুভব করি। যদি সে জুভেন্টাস ছেড়ে অন্য কোথাও যায় তবে সে জানে যে আমরা আছি।’

ততক্ষণে জুভেন্টাসের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পৌঁছে গেছে, ১৫ মিলিয়ন ইউরো এবং সঙ্গে আনুষঙ্গিক ৮ মিলিয়ন ইউরোর ট্রান্সফার ডিল।

তিন ঘণ্টার মধ্যে ইউনাইটেড রোনালদোকে দলে নিয়ে আার বিষয়টি নিশ্চিত করে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিজেদের ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো
ফার্গুসন পরবর্তী ইউনাইটেড যেসব বড় ফুটবলারকে দলে নিয়ে আসার লক্ষ্য ঠিক করে তাদের মধ্যে ছিলেন গ্যারেথ বেল, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরা।

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে রোনালদোর ফেরার গুঞ্জন বাজারে বেশ চলেছেও, কখনো চুক্তি নিয়ে দর কষাকষির খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু ইউনাইটেডের হয়ে ২৯২ ম্যাচে ১১৮ গোলদাতা, তিনটি প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগজয়ী রোনালদো যে আসলেই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফিরবেন সেটি মনে হয়নি কখনো।

জুভেন্টাসে রোনালদোর অশান্ত সময়ের খবর ইউনাইটেড রাখছিল। জুভেন্টাসও অর্থনৈতিকভাবে খারাপ সময় কাটাচ্ছে।

এখনো জুভেন্টাসের সঙ্গে সুপার লিগ প্রজেক্ট নিয়ে দ্বন্দ্ব মেটেনি, যেই প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ইউনাইটেডসহ পাঁচ ইংলিশ ক্লাব সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে।

রোনালদোর দীর্ঘদিনের এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেসের সঙ্গে যোগাযোগের পথ সবসময়ই খোলা ছিল।

কিন্তু রোনালদোর পিএসজি যাওয়ার খবর যখন বাজারে রটে, তখনও ইউনাইটেডের নাম আসেনি এবং সোলশারও মনে করেন রোনালদো চুক্তির মেয়াদ শেষ করেই তুরিন ছাড়বেন।

ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে রোনালদোর নাম জড়ানোর পর ইউনাইটেডের টনক নড়ে।

বৃহস্পতিবার রাতে এমন খবর আসে হয় ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে বা হচ্ছে। ভালো ভালো সূত্রের খবর অনুযায়ী ম্যানচেস্টার সিটির আগ্রহ ছিল ভালোই, কিন্তু তারা বুঝতে পারছিল না পুরো ব্যাপারটা কীভাবে কী হবে, কারণ সিটির কাউকে বিক্রি করা প্রয়োজন ছিল, যা বর্তমান বাজারে এত সহজ কাজ না।

ঠিক সেই সময় দৃশ্যপটে আসে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

অনেক বড় ফুটবল ক্লাবই তাদের দলবদলের বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয় না, আবার অনেকে দিয়ে থাকে।

ইউনাইটেডের জন্য রোনালদোর ফিরে আসাটা নিকট অতীতের সাফল্যমণ্ডিত সময়ে সাথে একটা সংযোগ ঘটানোর মতো।

জোসে মরিনিয়োর বিদায়ের পর, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সোলশার দায়িত্ব পান ইউনাইটেডে সাংস্কৃতিক সংস্কার করার এবং তার কাছে রোনালদোর আগের সময়ের ইউনাইটেডের চেয়ে ভালো উদাহরণ নেই।

২০০৬ থেকে ২০০৯ সালে ক্লাবকে দুই হাত ভরে দিয়েছেন এই ফুটবল জিনিয়াস। কিন্তু এই দলবদল বর্তমানের কথাই বলবে।

যেসব কারণে ৩৬ বছর বয়সেও লিওনেল মেসির সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারদের একজন মনে করা হয়, তার অনেক কিছুই এখনো রোনালদোর মধ্যে বিদ্যমান। গত মৌসুমেই ইতালিয়ান লিগে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে জিতেছেন তিনি ২৯ গোল দিয়ে।

রোনালদোর শারীরিক সক্ষমতা এবং পেশাদার মনোভাবের কারণেই মনে করা হচ্ছে তিনি দুই বছরের চুক্তিযোগ্য। মঙ্গলবারের মধ্যে এসব বিষয় নিশ্চিত করা হবে।

ইউনাইটেড মনে করছে বিশ্বমানের তারকা সই করা এবং কৈশোর পার করা প্রতিভাধর ফুটবলারদের যে মিশেল ক্লাবে আছে সেখানে রোনালদো যথাযথ একটি নাম। প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে তরুণ স্কোয়াডের একটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের।

এই দলবদলের মৌসুমেই রাফায়েল ভারান ও জ্যাডন স্যাঞ্চোকে দলে টেনেছে ইউনাইটেড, যা প্রমাণ করে ক্লাবটি বিশ্বসেরা ফুটবলারদের দলে নিতে এখনো সক্ষম।

কয়দিন পরেই দায়িত্ব ছাড়তে যাওয়া নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান এড উডওয়ার্ড বড় নাম দলে এনেছে, যারা সোলশারের জন্য খুশিমনে খেলবেন, যাকে দুর্মুখো সমালোচকেরা ‘শারীরিক শিক্ষার 

কাভানিকে নিয়ে প্রশ্ন
করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব পড়েছে ক্লাবের অর্থনীতিতে, ফলে ইউনাইটেডের প্রায় ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতি হয়েছে। ইউনাইটেডও সতর্ক করোনাভাইরাসের চলমান প্রভাব সম্পর্কে।

নতুন মৌসুমের শুরুতেই ডিন হেন্ডারসনের সঙ্গে চুক্তির পরে এর একেবারে হাতেনাতে প্রমাণও পেয়েছে ইউনাইটেড। তবে বিপরীতমুখী প্রভাবও আছে।

আগামী মাসে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব আছে, ইতোমধ্যে ইউনাইটেড স্ট্রাইকার এডিনসন কাভানি প্রিমিয়ার লিগের নতুন নিয়ম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

যুক্তরাজ্যের তালিকায় কোভিড সংক্রমণ বেশি যেসব দেশে সেসব দেশ থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে কোনো ফুটবলারকে ১০ দিনের কোয়ারেন্টিনের নিয়ম করে দেয়া হয়েছে, এই শর্ত মানতে গেলে অনেক ফুটবলার দেশের হয়ে খেলতে পারবেন না।

ইউনাইটেড স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা কাভানিকে বিক্রি করতে বা চুক্তি বাতিল করতে আগ্রহী নয়, মে মাসেই ৩৪ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের সঙ্গে নতুন এক বছরের চুক্তি করেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

তবে রোনালদোর উপস্থিতি এখন ইউনাইটেডকে আরও নমনীয় হওয়ার সুযোগ করে দেবে, বিশেষত যারা নিজ দেশের হয়ে খেলতে চান তারা তাদের ইচ্ছার গুরুত্ব পাবে ক্লাবে।

তবে তাতেও আরেকটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, রোনালদো কোন নাম্বারের জার্সি পরবেন।

রোনালদোর সঙ্গে ৭ নম্বর জার্সিটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, ভক্তরা তাকে এ জন্য সিআর-সেভেন (ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো- সাত) বলেও ডাকে। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সাত নম্বর জার্সিটি পরেন কাভানি।

এখন কাভানি যদি চানও রোনালদোকে তার ৭ নম্বর জার্সিটি দিয়ে দিতে, তাতেও হয়তো শেষ রক্ষা হবে না। কারণ প্রিমিয়ার লিগের নিয়মে আছে, মৌসুম শুরুর পর কোনো খেলোয়ার অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না ঘটলে জার্সির নম্বর বদল করতে পারবেন না।

এতে করে অবশ্য কাভানির সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্কের ক্ষতেও মলম হিসেবে কাজ করতে পারে। এর আগে একটি সোশাল মিডিয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় কাভানিকে, ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের এ সিদ্ধান্ত কাভানির কাছে বৈষম্যমূলক মনে হয়েছিল।

রোনালদোর বাড়ি ফেরা
পর্তুগালেই রোনালদো তার মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন করবেন। এর পর বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের দুটি ম্যাচ খেলবেন।

মঙ্গলবার ৭ সেপ্টেম্বর আজারবাইজারে সঙ্গে ম্যাচটি শেষ করে দ্বিতীয়বারের মতো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে অভিষেক করার প্রস্তুতি নেবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

১১ সেপ্টেম্বর নিউক্যাসলের সঙ্গেই মাঠে নামার সম্ভাবনা আছে রোনালদোর। শেষবার নিউক্যাসলের মুখোমুখি যেবার হয়েছিলেন, হ্যাটট্রিক করেন রোনালদো। ছয়টি গোল দেয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

সত্যি বলতে ৩৬ বছর বয়সী এই সুপারস্টারের ‘ঘরে ফেরা’ ভালো কি মন্দ সেটা বিচার হবে মাঠের খেলা দিয়েই- কিন্তু রোনালদোকে সই করানোর পর যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য এটা ইতোমধ্যে বিজয়।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ