আজকের শিরোনাম :

লিবিয়ায় রাশিয়ার প্রাইভেট বাহিনীর গোপন তৎপরতা ফাঁস

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২১, ১০:৫২

রাশিয়ার একটি গোপন প্রাইভেট বাহিনী লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে কত ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে তা বিবিসির এক নতুন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এই প্রাইভেট বাহিনীর সঙ্গে অনেক যুদ্ধাপরাধ ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কও ফাঁস হয়েছে বিবিসির ওই অনুসন্ধানে।

রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদের এই গোষ্ঠীটির নাম ওয়াগনার গ্রুপ। তাদের একজন যোদ্ধা একটি স্যামসাং ট্যাবলেট ফেলে রেখে গিয়েছিল। এই ট্যাবলেট থেকে পাওয়া তথ্যে লিবিয়ায় গ্রুপটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও তাদের যোদ্ধাদের চিহ্নিত করা যায় এমন সাংকেতিক নামও ফাঁস হয়ে গেছে।

এই গ্রুপটি যেসব অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের চেষ্টা করছিল তার একটি ক্রয় তালিকাও বিবিসির হাতে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এসব সরঞ্জাম একমাত্র রাশিয়ার সামরিক বাহিনীই সরবরাহ করতে পারে। তবে রাশিয়া ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছে।

ওয়াগনার গ্রুপকে প্রথম চিহ্নিত করা হয়েছিল ২০১৪ সালে ইউক্রেনে। সেখানে তারা পূর্ব ইউক্রেনে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিচ্ছিল। তবে এর বাইরে সিরিয়া, মোজাম্বিক, সুদান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকেও তারা বিভিন্ন তৎপরতায় জড়িত ছিল।

২০১৯ সালের এপ্রিলে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের লিবিয়ায় দেখা যায়। সেখানে তারা লিবিয়ার বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। হাফতারের বাহিনী তখন রাজধানী ত্রিপলিতে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছিল। ২০২০ সালের অক্টোবরে এক যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাতের অবসান হয়।

ওয়াগনার গ্রুপ খুবই কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে তাদের তৎপরতা চালায়। তবে বিবিসি এই গ্রুপের দুজন সাবেক যোদ্ধার সঙ্গে কথা বলেছে। কোন ধরনের লোকজন এই গ্রুপে যোগ দেয় এবং সেখানে কোনো নিয়ম-নীতির বালাই নেই- সেটা তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন।

একজন সাবেক যোদ্ধা স্বীকার করেছেন, এই গ্রুপটি বন্দীদের হত্যা করে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার ভাষায়, ‘একটা বাড়তি মুখের খাবার কে যোগাতে চায়?’

এই অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বিবিসির আরবি ও রাশিয়ান ভাষা বিভাগ যৌথভাবে যে টিভি ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেছে, সেটির নাম, ‘হাফতার’স রাশিয়ান মার্সেনারিজ : ইনসাইড ওয়াগনার গ্রুপ।’

তাদের অনুসন্ধানে গ্রুপটির সন্দেহজনক যুদ্ধাপরাধ ও ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক মানুষ হত্যার প্রমাণও ফাঁস হয়েছে।

লিবিয়ার একটি গ্রামের একজন জানিয়েছেন, তার আত্মীয়দের যখন হত্যা করা হচ্ছিল, তখন কীভাবে তিনি মৃতের ভান করে পড়েছিলেন। তার দেওয়া সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিবিসির টিম একজন সন্দেহভাজন খুনিকে চিহ্নিত করেছে।

লিবিয়ার একজন সরকারি সৈন্য আরেকটি সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তার এক সহযোদ্ধা ও বন্ধু ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু তার পেটে দুবার গুলি করা হয়। ওই সৈনিকটি তার বন্ধুকে আর দেখেননি। একই সময়ে নিয়ে যাওয়া আরও তিন সৈনিকের কোনো খোঁজও পাওয়া যায়নি।

স্যামসাং কম্পিউটার ট্যাবলেট থেকে ফাঁস হওয়া তথ্যে আরও দেখা যাচ্ছে, এই ভাড়াটে সেনারা লিবিয়ায় বেসামরিক এলাকায় মাইন বা বোমা পোঁতা ও হত্যার জন্য ফাঁদ পাতার মতো তৎপরতায়ও জড়িত। কোন চিহ্ন না রেখে স্থল মাইন পোঁতা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

স্যামসাং ট্যাবলেট থেকে যা ফাঁস হলো

২০২০ সালের বসন্তে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা দক্ষিণ ত্রিপলির এলাকা থেকে পিছু হটে। তখন একজন অচেনা ওয়াগনার যোদ্ধা এই স্যামসাং ট্যাবলেটটি সেখানে ফেলে গিয়েছিল। ওই ট্যাবলেটে রুশ ভাষায় যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু ম্যাপ ছিল। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ওয়াগনার গ্রুপ লিবিয়ার সংঘাতে ভালোভাবেই জড়িত ছিল। তারা সেখানে কী ধরনের তৎপরতা চালাত সেটারও অনেক ধারণা পাওয়া যায় এসব ম্যাপ থেকে।

স্যামসাং ট্যাবলেটটিতে অনেক ড্রোন ফুটেজও পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে অনেক ওয়াগনার যোদ্ধার সাংকেতিক নাম। বিবিসি অন্তত একজন যোদ্ধাকে এই সাংকেতিক নামের ভিত্তিতে চিহ্নিত করতে পেরেছে। এই ট্যাবলেটটি এখন একটি নিরাপদ স্থানে আছে।

‘শপিং লিস্ট’

২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারির ১০ পৃষ্ঠার একটি ডকুমেন্টও বিবিসির হাতে এসেছে। এটি আসলে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র এবং সরঞ্জামের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা। লিবিয়ার একটি গোয়েন্দা সূত্র বিবিসিকে এই তালিকাটি দিয়েছে। এটি সম্ভবত ওয়াগনার গ্রুপের কোনো এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

এই গ্রুপটির অপারেশনে কারা তহবিল যোগাচ্ছে, কারা তাদের সমর্থন দিচ্ছে- দলিলটিতে তার অনেক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ‘সামরিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য’ কী কী সরঞ্জাম দরকার, তার তালিকা আছে এতে। এসবের মধ্য ট্যাংক, শত শত কালাশনিকভ রাইফেল ও অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেমের কথা উল্লেখ আছে।

একজন সামরিক বিশ্লেষক বিবিসিকে জানিয়েছেন, এর মধ্যে কিছু সরঞ্জাম কেবলমাত্র রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব। আরেকজন বিশেষজ্ঞ, যিনি ওয়াগনার গ্রুপের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন তিনি বলছেন, এই তালিকা দেখে মনে হয়, এর সঙ্গে দিমিত্রি উতকিনের সম্পর্ক আছে।

দিমিত্রি উতকিন একজন সাবেক রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনিই ওয়াগনার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। রুশ ইন্টেলিজেন্সে কাজ করার সময় তার যে ‘কল সাইন’ বা ছদ্মনাম ছিল, সেই নামেই ওয়াগনার গ্রুপের নামকরণ করা হয়েছে। বিবিসি দিমিত্রি উতকিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এই তালিকা বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এতে ‘ইভরো পোলিস’ এবং ‘জেনারেল ডিরেক্টর’ শব্দের ব্যবহার দেখে বোঝা যায়, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ বিশাল ধনী এক ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের সম্পর্ক আছে ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে ইভরো পোলিসের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা বলেছিল, এই রুশ কোম্পানিকে সিরিয়ার কিছু তেলক্ষেত্র পাহারা দেওয়ার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল। এসব তেলক্ষেত্রের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রিগোঝিনের হাতে।

কিছু পশ্চিমা সাংবাদিকও তাদের অনুসন্ধানে ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে প্রিগোঝিনের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। তবে তিনি সবসময় ইভরো পোলিস ও ওয়াগনারের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেন।

তার একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের সঙ্গে ইভরো পোলিস ও ওয়াগনারের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রিগোঝিন মন্তব্য করেছেন, তিনি লিবিয়ায় রাশিয়ানরা কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, এমন কোন কথা শোনেননি। ‘আমি নিশ্চিত, এটা ডাহা মিথ্যে অভিযোগ।’

রাশিয়ার পররাষ্ট্র দফতর বিবিসিকে বলেছে, ‘লিবিয়ায় সংকটের একটা রাজনৈতিক সমাধান ও সেখানে যুদ্ধবিরতির জন্য তাদের সাধ্যমত চেষ্টা চালাচ্ছে।’

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, লিবিয়ায় ওয়াগনারের তৎপরতা সম্পর্কে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে ‘বানানো তথ্য’ দিয়ে তৈরি করা। এর আসল উদ্দেশ্য লিবিয়ায় রাশিয়ার নীতিকে বানচাল করা।’

ওয়াগনার কী? সাবেক যোদ্ধারা যা বলল

আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াগনার বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কমপক্ষে ১০ হাজার লোক অন্তত একবার হলেও ওয়াগনারের জন্য কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ২০১৪ সালে উত্তর ইউক্রেনে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাশাপাশি প্রথম তাদের লড়াই করতে দেখা যায়, সেই প্রথম এই গ্রুপের কথা জানা গিয়েছিল।

ধারণা করা হয়, লিবিয়ায় ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জেনারেল খালিফা হাফতারের পক্ষে ওয়াগনারের প্রায় এক হাজার যোদ্ধা লড়াই করেছে। 

রাশিয়ায় বিবিসি ওয়াগনারের এক সাবেক যোদ্ধাকে জিজ্ঞেস করেছিল কীভাবে এই গ্রুপটি তাদের কাজকর্ম চালায়। তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘এটি এমন একটি সাংগঠনিক কাঠামো, যার কাজ হলো রাশিয়ার সীমান্তের বাইরে রাশিয়ার স্বার্থ বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করা।’

তিনি আরও জানিয়েছেন, যারা ওয়াগনারে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে তারা হয় যুদ্ধ করা পেশাদার সৈনিক, অথবা কাজ খুঁজছে এমন লোক, অথবা এমন কিছু ‘রোমান্টিক’ মানুষ, যারা দেশের সেবা করতে চায়।

ওয়াগনারের আরেকজন সাবেক যোদ্ধা জানিয়েছেন, সেখানে কাজ করার কোনো সুস্পষ্ট ‘আচরণবিধি’ নেই। যদি কোনো ধরা পড়া বন্দী সেরকম কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে না পারে, অথবা ‘দাস’ হিসেবে কাজ করতে না পারে, তখন তার পরিণতি কী হবে, সেটা ‘বলার অপেক্ষা রাখে না।’

আন্দ্রে চুপ্রিগিন একজন বিশেষজ্ঞ, কাজ করেন রাশিয়া ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিলের সঙ্গে। তিনি বলছেন, এই গ্রুপের ব্যাপারে রাশিয়ার সরকারের অবস্থানটা হচ্ছে- ‘তাদেরকে এই কাজে যুক্ত হতে দেওয়া যাক এবং দেখা যাক এর ফল কী দাঁড়ায়। যদি এটা ভালোভাবে কাজ করে, তাহলে আমরা এটাকে আমাদের সুবিধার জন্য কাজে লাগাতে পারব। আর যদি এটার ফল খারাপ হয়, তাহলে এটার সঙ্গে তো আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’

লিবিয়া : এক দশকের অস্থিরতা

২০১১ সালে গাদ্দাফির পতন : লিবিয়ায় কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির চার দশকেরও বেশি দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটেছিল আরব বসন্তের গণঅভ্যুত্থানে। তিনি পালাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ধরা পড়ে যান। পরে তাকে হত্যা করা হয়।

দেশটি ভাগ হয়ে যায় : ২০১৪ সালের পর লিবিয়ার পূর্বে এবং পশ্চিমে দুটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে।

২০১৯ সালের এপ্রিলে ত্রিপলির দিকে অভিযান : জেনারেল হাফতার, যিনি লিবিয়ার পূর্ব অংশের বাহিনীর নেতা, তিনি তার বাহিনী নিয়ে ত্রিপলির দিকে অগ্রসর হন। ত্রিপলি ছিল জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এই সংঘাতে দুই পক্ষই বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির কাছ থেকে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন পায়। যদিও লিবিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ছিল।

২০২০ সালের অক্টোবরে যুদ্ধবিরতি : এরপর ২০২১ সালের শুরুতে একটি নতুন জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠিত হয় এবং শপথ নেয়। ডিসেম্বরে তাদের একটি নির্বাচন করার কথা। বিদেশি বাহিনী এবং ভাড়াটে সেনাদের লিবিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু হাজার হাজার সেনা এখনো লিবিয়ায় রয়ে গেছে। 
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ