আজকের শিরোনাম :

অজগর যে কারণে লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২১, ১৫:৩৮

প্রাণীবিদরা বলছেন, অজগর লোকালয়ের কাছাকাছি থাকা প্রজাতির সাপ নয়। কিন্তু গত এক মাসে লোকালয়ে বেরিয়ে আসা অন্তত ছয়টি বিরাটাকায় অজগর ধরা পড়েছে। সবগুলোকেই উদ্ধার করা হয়েছে কৃষক বা খামারিদের পেতে রাখা জালে আটকে পড়া অবস্থায় এবং পরে সেগুলোকে উম্মুক্ত বনভূমিতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার তারতাপাড়া গ্রামের কৃষক হাফিজুর রহমান জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে তার বীজতলায় গিয়ে বিস্ময় আর ভয়ের সঙ্গে দেখতে পান, বীজতলা ঢাকার জালে আটকে আছে বিশাল এক অজগর।

তিনি কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আগেই ভয় পেয়ে সাপটিকে পেটাতে শুরু করেন তার সাথে থাকা আরেকজন। কিন্তু অনেকক্ষণ আটকে থেকে সাপটিও তখন প্রায় নির্জীব হয়ে আছে।

এদিকে, তাদের চিৎকারে মুহূর্তে লোকজন জমে যায়। তাদের মধ্য থেকেই একজন বলেন না মেরে বনবিভাগে খবর দিতে।

তিনি বলছিলেন, “এত বড় অজগর জীবনে দেখি নাই, কোথা থেকে এলো বুঝতে পারছিলাম না। বিপদ না ঘটায় ফেলে এই চিন্তায় ছিলাম সর্বক্ষণ।”

এক পর্যায়ে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পরে পুলিশের সাহায্যে অজগরটিকে শেরপুর বনবিভাগের মাধ্যমে শেরপুর মধুটিলা বনাঞ্চলে উন্মুক্ত করা হয়।

জামালপুরের এই ঘটনাটির মতো বাংলাদেশে গত এক মাসে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নরিসংদী ও চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলায় লোকালয়ে বেরিয়ে এসে অন্তত ছয়টি অজগর ধরা পড়েছে।

এদের দৈর্ঘ্য ছিল আট ফুট থেকে এগার ফুটের মধ্যে। সবগুলোকেই অবশ্যই জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন অভয়ারণ্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পর প্রশ্ন ওঠে, তাহলে অজগর সাপগুলো লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে কেন?

অজগর বা পাইথন
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সাপ। বাংলাপিডিয়া অজগর সম্পর্কে বলছে, এটি সার্পেন্টস বর্গের অন্তর্গত নির্বিষ সাপ। অন্য যে কোনো সাপের তুলনায় অজগর দীর্ঘ হয়। এর আঁশ মসৃণ। অজগরের দাঁত অত্যন্ত শক্তিশালী, কিন্তু কোনো বিষদাঁত নেই। গ্রিবা স্পষ্ট, মস্তক প্রশস্ত এবং তুন্ড দীর্ঘ। অজগরের চোয়ালের পেশীগুলো খুবই নমনীয়।

অজগর বড় প্রাণী খায়, মানে ইঁদুর থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত গিলে খেতে পারে। মৃত প্রাণী খায় না অজগর।

লোকালয়ে ধরা পড়া অধিকাংশ অজগর পাওয়া গেছে হাঁস-মুরগির খামারে, না হয় মাছের ঘের বা পুকুরে।

তবে অজগরের পছন্দের খাবারের তালিকায় রয়েছে ইঁদুর, খরগোশ, ছাগল, ভেড়া, শিয়াল এবং হরিণের মতো প্রাণী। খাওয়ার আগে অজগর তার শিকার পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে।

দেশে কি অজগরের সংখ্যা বেড়েছে?
প্রাণীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অজগরের নয়টি প্রজাতি আছে। তবে, বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের অজগর সাপ বেশি দেখা যায়।

একটি বার্মিজ পাইথন, এটি স্থানীয়ভাবে ময়াল নামেও পরিচিত।

আরেকটি রেটিকুলেটেড পাইথন, এই দ্বিতীয় ধরনটিকে গোলবাহার বা জালি অজগরও বলা হয়।

জামালপুরে ধরা পড়া সাপটি ময়াল জাতের অজগর বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

লোকালয়ে অজগরের বেরিয়ে আসার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি শোনা গেছে। এ কারণে বাংলাদেশে অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা এমন একটি ধারণা রয়েছে অনেকের মনে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাপতত্ত্ব বিষয়ে পড়ান এবং গবেষণা করেন অধ্যাপক ফরিদ আহসান। তিনি বলছিলেন, অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে দেশে, তবে এ সংক্রান্ত পরিষ্কার কোনো হিসাব প্রাণীবিদদের কাছে নেই।

তবে, অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক আহসান।

তিনি বলেছেন, “সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের কাছে কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে এটা বলতে পারি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অজগরের প্রাকৃতিক প্রজনন বেড়েছে।”

২০২১ সালের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অজগরের ছোট ছোট বাচ্চা পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা যায় এখানে প্রাকৃতিক প্রজনন ঘটেছে।

তিনি বলেন, “দেশের অনেক জায়গাতেই এমনটা ঘটেছে। এর অর্থ হচ্ছে, তারা আশ্রয় পাচ্ছে বলেই প্রাকৃতিক প্রজনন ঘটতে পারছে।”

তিনি বলেছেন, “এর বাইরে আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। আগে সাপ দেখতে পেলেই মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলত, কিন্তু এখন তা করে না। আক্রান্ত না হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ সেটা বন বিভাগের কাছে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হস্তান্তর করে দেয়। অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।”

তবে অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক প্রাণীবিদের।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনিরুল এইচ খান বলছেন, “সংখ্যা বাড়েনি অজগরের, কারণ তাদের আবাস বা হ্যাবিটাটের সংখ্যা বা পরিমান তো বাড়েনি। বরং তারা লোকালয়ে আসছে এবং ধরা পড়ছে বলে সেটা মানুষ জানছে। তাতে করে মনে হচ্ছে যে সংখ্যা হয়ত বেড়েছে।”

লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে কেন?
অজগর সাধারণত উপদ্রবহীন পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে, যে কারণে তারা লোকালয় থেকে দূরে জঙ্গলের গভীরে থাকে।

বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, অধিকাংশ অজগর কিছুটা বৃক্ষবাসী। তবে নদী, হাওর কিংবা ঝিলের কাছেও এদের দেখা যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহসান বলছেন, যে কোন বন্যপ্রাণীর আবাস ঝুঁকির মুখে থাকলে এবং খাবারের সংকট হলে তারা লোকালয়ে বেরিয়ে আসে।

অজগরের ক্ষেত্রেও আবাস সংকোচনের ফলে তাদের খাবার সংকট হচ্ছে। ফলে তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে খাবারের খোঁজে আসছে।

“এ পরিক্রমায় অনেক সময়ই তারা লোকালয়ে ঢুকে পড়ে আর বের হতে পারে না।”

এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে পাহাড় বা ঘণ জঙ্গল আছে, সেসব জায়গায় এপ্রিল-জুন এ সময়ে পাহাড়ে অনেক সময় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

অধ্যাপক আহসান বলছেন, ওই সময় আগুনের কারণে বা প্রচন্ড গরমে সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় অজগর বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।

এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনিরুল এইচ খান মনে করেন, বর্ষাকালে নিচু এলাকা ডুবে যাওয়ায় বা স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ার কারণে তুলনামূলক উঁচু জায়গায় চলে আসে অজগর।

আবার বন্যায় ভেসেও অনেক সময় তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে আসে।

এ ছাড়া অজগরের প্রজননরে সময় শুরু হয় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে। ফলে এই সময়ে তাদের লোকালয়ে বা প্রকাশ্য স্থানে কম দেখা যায়।

অজগর নিয়ে কয়েকটি মজার কিন্তু দরকারী তথ্য
* আক্রান্ত না হলে অজগর মানুষকে আঘাত করে না।

* নিজের শিকারকে অজগর শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মারে

* শিকারের আকার অনুযায়ী অজগরের হজমের সময় নির্ধারিত হয়, কোনো কোনো শিকার হজম করতে কয়েক মাস সময়ও লাগতে পারে

* অজগর সাপ একসাথে ৩০টির বেশি ডিম পাড়তে পারে

* ডোরা কাটা অজগর ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ