বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
ডাকাতদের মধ্যে অহিংসা প্রচার করতেন যে গায়িকা
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২১, ১১:৩২
তিনি ছিলেন অতি অভিজাত এক পার্সি পরিবারের মেয়ে। মুম্বাই শহরের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত এলাকায় ছিল তাদের পারিবারিক বাসভবন । গান গাইতেন তিনি বন্ধু আর পরিবারের লোকেরা তাকে বলতেন বুল বা কোকিলকণ্ঠী।
তার নাম খুরশেদবেন নওরোজি। যদিও আজকের ভারতে অনেকেই তার কথা ভুলে গেছে, কিন্তু তার জন্ম হয়েছিল সে যুগের এক অত্যন্ত নামকরা পরিবারে।
খুরশেদবেনের পিতামহ হচ্ছেন দাদাভাই নওরোজি- ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জাতীয়তাবাদী নেতা, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য হওয়া প্রথম ভারতীয় ।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর অন্যতম রাজনৈতিক গুরু ছিলেন এই দাদাভাই নওরোজি।
এহেন ব্যক্তিত্বের নাতনি খুরশেদবেন ছিলেন ১৯২০ ও ৩০-এর দশকের এক প্রতিষ্ঠিত গায়িকা- আবার অন্যদিকে ডাকাতদের মধ্যে অহিংসা প্রচার করে বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য গ্রেফতার হয়েও আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।
এই খুরশেদবেন নওরোজিকে নিয়ে সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন ইতিহাসবিদ দিনিয়ার প্যাটেল।
লেখক রামচন্দ্র গুহ একবার বলেছিলেন, ভারতে জীবনী রচনার জগৎটা একটা শূন্য আলমারির মতো। মনে করা হচ্ছে, রামচন্দ্র গুহর কিছু ছাত্র ও সহকর্মীর লেখা বইয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করার মত কিছু ব্যতিক্রমী চরিত্র উঠে আসবে।
কোকিলকণ্ঠী গায়িকা
খুরশেদবেন নওরোজির জন্ম ১৮৯৪ সালে বোম্বে বা আজকের মুম্বাইতে। পশ্চিমা ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীতে বিশেষত অপেরায় যে গায়িকারা গান করেন তাদের বলা হয় সোপ্রানো। খুরশেদবেনও ছিলেন তেমনি একজন সোপ্রানো। ভারতেও খুরশেদবেন তার একক গানের অনুষ্ঠান করেছিলেন, তাতে তিনি ফরাসি, স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান ভাষায় গান গেয়েছিলেন। ১৯২০-এর দশকে খুরশেদবেন নওরোজি প্যারিস যান সঙ্গীতে শিক্ষা গ্রহণ করতে। তবে ইউরোপে গিয়ে তার নিজেকে সাংস্কৃতিকভাবে দলছুট মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার সেই মানসিক অবস্থা কেটে গেল ইউরোপে আসা আরেক ভিনদেশীর সাথে পরিচয়ের পর- যার নাম ইভা পামার সিকেলিয়ানোস। সিকেলিয়ানোস ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের এক অভিজাত পরিবার থেকে আসা, তবে তিনি বাস করছিলেন এথেন্সে। সেখানে ক্লাসিকাল গ্রিক সংস্কৃতির পুনরুত্থানের অন্যতম স্থপতি ছিলেন তিনি। খুরশেদবেন ও ইভা সিকেলিয়ানোসের মধ্যে অনেক আলোচনা হলো গ্রিক ও ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য নিয়ে। এরই ফসল হিসেবে- তারা এথেন্সে অ-পশ্চিমা সঙ্গীতের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। খুরশেদবেন এক পর্যায়ে প্যারিসের সঙ্গীত জগৎ ত্যাগ করে যেন নতুন করে বিকশিত হলেন গ্রিসের মাটিতে। তিনি সে সময় ভারতীয় শাড়ি পরতেন, করতেন ভারতীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। খুরশেদবেন গ্রিসকে বলতেন ‘মাদার গ্রিস’- কিন্তু এক পর্যায়ে এ দেশই তাকে ‘মাদার ইন্ডিয়া’র দিকে তার মনোযোগ ফেরাতে সহায়তা করলো। সিকেলিয়ানোসের জীবনীকার আর্টেমিস লিওনটিস বলেছিলেন, খুরশেদবেন ভারত নিয়ে কথা বলতেন এবং বলতেন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যে আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন তাতে যোগ দেবার কথা। প্রাচীন গ্রিসের ঐতিহ্য নিয়ে ডেলফিক ফেস্টিভ্যাল নামে একটি উৎসবের পরিকল্পনা করেছিলেন সিকেলিয়ানোস। তাতে তিনি খুরশেদবেনের সাহায্য চাইলেন, কিন্তু সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে খুরশেদবেন মুম্বাই ফিরে এলেন। গান্ধীর আশ্রমে
মুম্বাই ফিরে কিছুকালের মধ্যেই গুজরাটে গান্ধীর সবরমতী আশ্রমে চলে গেলেন খুরশেদবেন। তিনি গান্ধীকে উদ্বুদ্ধ করলেন, যেন তিনি জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ আরো সম্প্রসারিত করেন। একটি সংবাদপত্রে খুরশেদবেন বললেন, গান্ধীর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারীদের এক মহা-জাগরণ ঘটতে পারে, এবং ‘এই যে উত্তম সূচনা ঘটেছে সেই কাজে নারীরা থামবে না।’ খুরশেদবেনের এই কাজ তাকে নিয়ে গেল ব্রিটিশ ভারতের এক অপ্রত্যাশিত অংশে- তা হলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বা এনডব্লিউএফপি । এই ভূখন্ডটি এখন পাকিস্তানের অংশ- যার নাম খাইবার-পাখতুনখোয়া। এটি একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল মানসিকতার এলাকা। তা ছাড়া এখানে সবসময়ই লেগে থাকতো উপজাতীয় কোন্দল এবং ডাকাতি। খুরশেদবেন মুম্বাইয়ের যে অংশে বেড়ে উঠেছিলেন- তা থেকে এই জায়গাটি যেন শত যোজন দূরে। হয়তো এই দূরত্বই খুরশেদবেনকে আকৃষ্ট করেছিল। কীভাবে তিনি প্রথমবারের মতো সেই প্রত্যন্ত সীমান্ত প্রদেশে গিয়েছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায়না। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের প্রথম দিকে, এনডব্লিউএফপি-র রাজনীতিতে এই অভিজাত পার্সি মহিলা ছিলেন একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। পাশতুনদের মধ্যে অহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা ছিলেন খান আবদুল গাফফার খান। গান্ধীর সাথে তার রাজনৈতিক দর্শনের মিলের জন্য আবদুল গাফফার খানকে ডাকা হতো 'সীমান্ত গান্ধী' বলে। খুরশেদবেনের সাথে বন্ধুত্ব ছিল খান আবদুল গাফফার খানের। যখনই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ খুরশেদবেনের ওপরে ক্ষিপ্ত হতো, তখনই তিনি হাসিমুখে কারাবরণ করতেন। ‘কারাগারের মাছি আর আমি- পরস্পরকে উষ্ণ রাখি’- পেশাওয়ারের কারাগার থেকে একবার গান্ধীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন খুরশেদবেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সমস্যা
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যতই সময় কাটাতে লাগলেন খুরশেদবেন, ততই তিনি একটি জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জকে আরো বেশি করে বুঝতে পারছিলেন। গান্ধী তাকে উৎসাহিত করেছিলেন যেন তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের পক্ষে সমর্থন গড়ে তোলেন। দেখা গেল, ওই এলাকায় এটা এক অসম্ভব ব্যাপার। কারণ সেখানকার স্থানীয় হিন্দুরা সব সময় মুসলিম ডাকাতদের আতংকের মধ্যে ছিলেন। এই ডাকাতরা নিকটবর্তী ওয়াজিরিস্তনে অভিযান চালিয়ে লোকজনকে অপহরণ করতো। ব্রিটিশ ও ভারতীয় পুলিশ- উভয়েই তাদের ভয় পেতো। কিন্তু এই ডাকাতদের জন্য সৃষ্টি হলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। ডাকাতদের মধ্যে অহিংসার বাণী প্রচার
খুরশেদবেন ভাবলেন, এ সমস্যার সমাধান একটাই। তাকে ডাকাতদের কাছাকাছি যেতে হবে, তাদের এ পেশা ত্যাগ করতে উৎসাহিত করতে হবে, এবং তাদের গান্ধীর মতাদর্শ গ্রহণ করাতে হবে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কংগ্রেসে খুরশেদবেনের সহযোগীরা ছিলেন সবাই পুরুষ। তারা এই প্রস্তাব শুনে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদ সত্বেও ১৯৪০ সালের শেষ দিকে সেই বিরান প্রত্যন্ত এলাকায় এক দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করলেন খুরশেদবেন। পথে তিনি স্থানীয় লোকজনের সাথে কথাবার্তা বললেন, বৈঠক করলেন। কথা বললেন গ্রামের নারীদের সাথে, তাদের বোঝালেন যে ডাকাতি কত খারাপ কাজ। এভাবে ডাকাতি পেশার বিরুদ্ধে ডাকাতদেরই মা-মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি। ডাকাতরা বুঝতে পারছিল না যে কীভাবে এই মহিলার মোকাবিলা করবে, কারণ খুরশেদবেন একেবারের তাদের ঘরের ভেতরে রাস্তা করে নিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ এ কাজ করার জন্য অনুতাপও প্রকাশ করলো, তবে সবাই নয়। খুরশেদবেন গান্ধীকে এক চিঠিতে লিখেছেন, তাকে লক্ষ্য করে গুলিও ছোঁড়া হয়েছিল। তার গায়ের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গিয়ে বালুতে বিদ্ধ হয়েছিল সেই বুলেট। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সেই চেষ্টায় ফল হয়েছিল। ১৯৪০-এর ডিসেম্বর নাগাদ অপহরণের সংখ্যা কমে গেল। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেল। এতদিন যারা তার বৈরী ছিল, সেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষও এখন খুরশেদবেনের প্রশংসা করতে লাগল। তবে একটা চ্যালেঞ্জ রয়েই গেল। ওয়াজিরিস্তান ছিল এমন একটা জায়গা যেখানে ব্রিটিশ পুলিশও যেতে সাহস পেতো না। এখানেই অপহরণ করে এনে রাখা হয়েছিল একদল হিন্দুকে । খুরশেদবেন ঠিক করলেন তিনি সেখানে যাবেন, যদিও তিনি জানতেন তিনি প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিচ্ছেন। আর যদি তিনি একা ধরা পড়েন, তাহলে ডাকাতরা দাবি করবে মুক্তিপণ। আর তা না দিলে তারা একটা আঙুল বা কান কেটে রেখে দেবে - গান্ধীকে বলেছিলেন, খুরশেদবেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত অপহরণকারীদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি খুরশেদবেন। ওয়াজিরিস্তান সীমান্ত পার হবার আগেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে থাকতে হয় তাকে। ব্রিটিশ রাজের জন্য মুম্বাইয়ের এই অভিজাত নারী ছিলেন এতটাই বিপজ্জনক। এর পর খুরশেদবেনের আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ফেরা হয়নি। ১৯৪৭ সালের আগস্টে বেদনাহত হৃদয়ে খুরশেদবেন দেখলেন, ওই এলাকাটি অবিভক্ত ভারতের বাইরে চলে গেল। ভারতের স্বাধীনতার কয়েক মাস পর গান্ধীও নিহত হলেন। এর পরে খুরশেদবেনের জীবন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি বিভিন্ন সরকারি কমিশনের হয়ে কাজ করেছিলেন, এমনকি গান গাইতেও শুরু করেছিলেন আবার। তিনি মারা যান খুব সম্ভবত ১৯৬৬ সালে। এক অর্থে হয়তো খুরশেদবেনের জীবন খুব অনন্য কিছু নয়। হয়তো ভারতে এমন হাজার হাজার জীবনের কাহিনি এখনো বলা হয়নি। হয়তো এগুলো চাপা পড়ে আছে ভারতের বিক্ষিপ্ত পোকায় কাটা সংগ্রহশালাগুলোতে। তাদের গল্প অপেক্ষা করছে একজন কথকের জন্য। হয়তো ভারতের সেই সব নারীদের জন্য এ কথা আরো বেশি সত্য- যারা খুরশেদবেনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহযোগী ছিলেন। ভারতীয়দের জীবনীর ‘শূন্য আলমারি’তে তাদের জন্য অনেক জায়গা খালি পড়ে আছে। এবিএন/সাদিক/জসিম
খুরশেদবেন নওরোজির জন্ম ১৮৯৪ সালে বোম্বে বা আজকের মুম্বাইতে। পশ্চিমা ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীতে বিশেষত অপেরায় যে গায়িকারা গান করেন তাদের বলা হয় সোপ্রানো। খুরশেদবেনও ছিলেন তেমনি একজন সোপ্রানো। ভারতেও খুরশেদবেন তার একক গানের অনুষ্ঠান করেছিলেন, তাতে তিনি ফরাসি, স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান ভাষায় গান গেয়েছিলেন। ১৯২০-এর দশকে খুরশেদবেন নওরোজি প্যারিস যান সঙ্গীতে শিক্ষা গ্রহণ করতে। তবে ইউরোপে গিয়ে তার নিজেকে সাংস্কৃতিকভাবে দলছুট মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার সেই মানসিক অবস্থা কেটে গেল ইউরোপে আসা আরেক ভিনদেশীর সাথে পরিচয়ের পর- যার নাম ইভা পামার সিকেলিয়ানোস। সিকেলিয়ানোস ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের এক অভিজাত পরিবার থেকে আসা, তবে তিনি বাস করছিলেন এথেন্সে। সেখানে ক্লাসিকাল গ্রিক সংস্কৃতির পুনরুত্থানের অন্যতম স্থপতি ছিলেন তিনি। খুরশেদবেন ও ইভা সিকেলিয়ানোসের মধ্যে অনেক আলোচনা হলো গ্রিক ও ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য নিয়ে। এরই ফসল হিসেবে- তারা এথেন্সে অ-পশ্চিমা সঙ্গীতের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। খুরশেদবেন এক পর্যায়ে প্যারিসের সঙ্গীত জগৎ ত্যাগ করে যেন নতুন করে বিকশিত হলেন গ্রিসের মাটিতে। তিনি সে সময় ভারতীয় শাড়ি পরতেন, করতেন ভারতীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। খুরশেদবেন গ্রিসকে বলতেন ‘মাদার গ্রিস’- কিন্তু এক পর্যায়ে এ দেশই তাকে ‘মাদার ইন্ডিয়া’র দিকে তার মনোযোগ ফেরাতে সহায়তা করলো। সিকেলিয়ানোসের জীবনীকার আর্টেমিস লিওনটিস বলেছিলেন, খুরশেদবেন ভারত নিয়ে কথা বলতেন এবং বলতেন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যে আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন তাতে যোগ দেবার কথা। প্রাচীন গ্রিসের ঐতিহ্য নিয়ে ডেলফিক ফেস্টিভ্যাল নামে একটি উৎসবের পরিকল্পনা করেছিলেন সিকেলিয়ানোস। তাতে তিনি খুরশেদবেনের সাহায্য চাইলেন, কিন্তু সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে খুরশেদবেন মুম্বাই ফিরে এলেন। গান্ধীর আশ্রমে
মুম্বাই ফিরে কিছুকালের মধ্যেই গুজরাটে গান্ধীর সবরমতী আশ্রমে চলে গেলেন খুরশেদবেন। তিনি গান্ধীকে উদ্বুদ্ধ করলেন, যেন তিনি জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ আরো সম্প্রসারিত করেন। একটি সংবাদপত্রে খুরশেদবেন বললেন, গান্ধীর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারীদের এক মহা-জাগরণ ঘটতে পারে, এবং ‘এই যে উত্তম সূচনা ঘটেছে সেই কাজে নারীরা থামবে না।’ খুরশেদবেনের এই কাজ তাকে নিয়ে গেল ব্রিটিশ ভারতের এক অপ্রত্যাশিত অংশে- তা হলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বা এনডব্লিউএফপি । এই ভূখন্ডটি এখন পাকিস্তানের অংশ- যার নাম খাইবার-পাখতুনখোয়া। এটি একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল মানসিকতার এলাকা। তা ছাড়া এখানে সবসময়ই লেগে থাকতো উপজাতীয় কোন্দল এবং ডাকাতি। খুরশেদবেন মুম্বাইয়ের যে অংশে বেড়ে উঠেছিলেন- তা থেকে এই জায়গাটি যেন শত যোজন দূরে। হয়তো এই দূরত্বই খুরশেদবেনকে আকৃষ্ট করেছিল। কীভাবে তিনি প্রথমবারের মতো সেই প্রত্যন্ত সীমান্ত প্রদেশে গিয়েছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায়না। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের প্রথম দিকে, এনডব্লিউএফপি-র রাজনীতিতে এই অভিজাত পার্সি মহিলা ছিলেন একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। পাশতুনদের মধ্যে অহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা ছিলেন খান আবদুল গাফফার খান। গান্ধীর সাথে তার রাজনৈতিক দর্শনের মিলের জন্য আবদুল গাফফার খানকে ডাকা হতো 'সীমান্ত গান্ধী' বলে। খুরশেদবেনের সাথে বন্ধুত্ব ছিল খান আবদুল গাফফার খানের। যখনই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ খুরশেদবেনের ওপরে ক্ষিপ্ত হতো, তখনই তিনি হাসিমুখে কারাবরণ করতেন। ‘কারাগারের মাছি আর আমি- পরস্পরকে উষ্ণ রাখি’- পেশাওয়ারের কারাগার থেকে একবার গান্ধীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন খুরশেদবেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সমস্যা
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যতই সময় কাটাতে লাগলেন খুরশেদবেন, ততই তিনি একটি জটিল রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জকে আরো বেশি করে বুঝতে পারছিলেন। গান্ধী তাকে উৎসাহিত করেছিলেন যেন তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের পক্ষে সমর্থন গড়ে তোলেন। দেখা গেল, ওই এলাকায় এটা এক অসম্ভব ব্যাপার। কারণ সেখানকার স্থানীয় হিন্দুরা সব সময় মুসলিম ডাকাতদের আতংকের মধ্যে ছিলেন। এই ডাকাতরা নিকটবর্তী ওয়াজিরিস্তনে অভিযান চালিয়ে লোকজনকে অপহরণ করতো। ব্রিটিশ ও ভারতীয় পুলিশ- উভয়েই তাদের ভয় পেতো। কিন্তু এই ডাকাতদের জন্য সৃষ্টি হলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। ডাকাতদের মধ্যে অহিংসার বাণী প্রচার
খুরশেদবেন ভাবলেন, এ সমস্যার সমাধান একটাই। তাকে ডাকাতদের কাছাকাছি যেতে হবে, তাদের এ পেশা ত্যাগ করতে উৎসাহিত করতে হবে, এবং তাদের গান্ধীর মতাদর্শ গ্রহণ করাতে হবে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কংগ্রেসে খুরশেদবেনের সহযোগীরা ছিলেন সবাই পুরুষ। তারা এই প্রস্তাব শুনে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদ সত্বেও ১৯৪০ সালের শেষ দিকে সেই বিরান প্রত্যন্ত এলাকায় এক দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করলেন খুরশেদবেন। পথে তিনি স্থানীয় লোকজনের সাথে কথাবার্তা বললেন, বৈঠক করলেন। কথা বললেন গ্রামের নারীদের সাথে, তাদের বোঝালেন যে ডাকাতি কত খারাপ কাজ। এভাবে ডাকাতি পেশার বিরুদ্ধে ডাকাতদেরই মা-মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি। ডাকাতরা বুঝতে পারছিল না যে কীভাবে এই মহিলার মোকাবিলা করবে, কারণ খুরশেদবেন একেবারের তাদের ঘরের ভেতরে রাস্তা করে নিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ এ কাজ করার জন্য অনুতাপও প্রকাশ করলো, তবে সবাই নয়। খুরশেদবেন গান্ধীকে এক চিঠিতে লিখেছেন, তাকে লক্ষ্য করে গুলিও ছোঁড়া হয়েছিল। তার গায়ের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গিয়ে বালুতে বিদ্ধ হয়েছিল সেই বুলেট। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সেই চেষ্টায় ফল হয়েছিল। ১৯৪০-এর ডিসেম্বর নাগাদ অপহরণের সংখ্যা কমে গেল। হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেল। এতদিন যারা তার বৈরী ছিল, সেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষও এখন খুরশেদবেনের প্রশংসা করতে লাগল। তবে একটা চ্যালেঞ্জ রয়েই গেল। ওয়াজিরিস্তান ছিল এমন একটা জায়গা যেখানে ব্রিটিশ পুলিশও যেতে সাহস পেতো না। এখানেই অপহরণ করে এনে রাখা হয়েছিল একদল হিন্দুকে । খুরশেদবেন ঠিক করলেন তিনি সেখানে যাবেন, যদিও তিনি জানতেন তিনি প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিচ্ছেন। আর যদি তিনি একা ধরা পড়েন, তাহলে ডাকাতরা দাবি করবে মুক্তিপণ। আর তা না দিলে তারা একটা আঙুল বা কান কেটে রেখে দেবে - গান্ধীকে বলেছিলেন, খুরশেদবেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত অপহরণকারীদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি খুরশেদবেন। ওয়াজিরিস্তান সীমান্ত পার হবার আগেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে থাকতে হয় তাকে। ব্রিটিশ রাজের জন্য মুম্বাইয়ের এই অভিজাত নারী ছিলেন এতটাই বিপজ্জনক। এর পর খুরশেদবেনের আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ফেরা হয়নি। ১৯৪৭ সালের আগস্টে বেদনাহত হৃদয়ে খুরশেদবেন দেখলেন, ওই এলাকাটি অবিভক্ত ভারতের বাইরে চলে গেল। ভারতের স্বাধীনতার কয়েক মাস পর গান্ধীও নিহত হলেন। এর পরে খুরশেদবেনের জীবন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি বিভিন্ন সরকারি কমিশনের হয়ে কাজ করেছিলেন, এমনকি গান গাইতেও শুরু করেছিলেন আবার। তিনি মারা যান খুব সম্ভবত ১৯৬৬ সালে। এক অর্থে হয়তো খুরশেদবেনের জীবন খুব অনন্য কিছু নয়। হয়তো ভারতে এমন হাজার হাজার জীবনের কাহিনি এখনো বলা হয়নি। হয়তো এগুলো চাপা পড়ে আছে ভারতের বিক্ষিপ্ত পোকায় কাটা সংগ্রহশালাগুলোতে। তাদের গল্প অপেক্ষা করছে একজন কথকের জন্য। হয়তো ভারতের সেই সব নারীদের জন্য এ কথা আরো বেশি সত্য- যারা খুরশেদবেনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহযোগী ছিলেন। ভারতীয়দের জীবনীর ‘শূন্য আলমারি’তে তাদের জন্য অনেক জায়গা খালি পড়ে আছে। এবিএন/সাদিক/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ