ভারতে কি টিকার মজুদ ফুরিয়ে আসছে?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২১, ২১:৩৮
ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার জন্য গত দুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সঞ্জয় কুমার এবং তার বৃদ্ধা মা। ডক্টর কুমার একজন সমাজবিজ্ঞানী, থাকেন দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদে।
"আমাদের এলাকায় তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে আমি গিয়েছি এবং তাদের সবাই বলেছে তাদের আর কোন টিকার ডোজ নেই," বলছেন তিনি।
এর মধ্যে একটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল তিনি যে এলাকায় থাকেন, তার খুব কাছেই।
সেই হাসপাতালে কাউন্টারের একজন কর্মী তাকে বললেন, "আমাদের টিকার মজুদ একেবারে শূন্য এবং আমরা এখন আর নতুন কোন বুকিং নিচ্ছি না । কারণ আমরা যখন লোকজনকে বলি যে আমাদের আর টিকার মজুদ নেই, তখন লোকজন ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়।"
ডক্টর কুমার আরেকটি হাসপাতালেও টিকার বুকিং দিতে গিয়ে ব্যর্থ হন। সেখানকার কর্মকর্তারা বলেছেন, বুধবার সন্ধ্যাতেই তাদের টিকা ফুরিয়ে গেছে। সেখানকার একজন কর্মচারী তাকে বললেন, "লোকজনকে ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।"
ভারত এখন কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ধাক্কার সঙ্গে লড়ছে। গত ১লা এপ্রিল হতে সেখানে প্রতিদিন পরীক্ষায় ৯০ হাজারের বেশি নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ছে। অন্যদিকে সরকার টিকাদান কার্যক্রম চালাতে এখন রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে। অন্তত ছটি রাজ্য বলছে, তাদের টিকার সংকট চলছে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করে যাচ্ছে, টিকার কোন ঘাটতি নেই, যথেষ্ট মজুদ আছে।
ভারতের নতুন সংক্রমণের অর্ধেকেরও বেশি ধরা পড়ছে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে। সেখানে টিকাদান কর্মসূচি একেবারে থমকে গেছে। রাজ্য সরকার বলছে, তাদের হাতে আছে আর মাত্র ১৫ লাখের মতো টিকার ডোজ, যেটা দিয়ে বড়জোর তিন দিন চলবে। রাজ্যের রাজধানী মুম্বাইয়ের এবং কোলহাপুর, সাংলি এবং সাতারা জেলার টিকাদান কেন্দ্র গুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ টোপে সাংবাদিকদের বলেছেন, "যদি তিন দিনের মধ্যে নতুন টিকা এসে না পৌঁছায়, আমাদের পুরো টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে হবে।"
তবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন বলেছেন, টিকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা একেবারেই ভিত্তিহীন। তিনি দাবি করছেন, চার কোটির বেশি টিকার ডোজ এখনো মজুদ আছে বা সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি বরং উল্টো রাজ্যগুলোকে দোষারোপ করছেন এই বলে যে, তারা তাদের টিকাদান অভিযানের দুর্বলতা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য বারেবারে ধরনের অভিযোগ করে যাচ্ছেন। মিস্টার বর্ধন মনে করেন, যেসব রাজ্য টিকার সংকট আছে বলে অভিযোগ করছে, তারা আসলে তাদের ফ্রন্ট-লাইন ওয়ার্কারদের পর্যন্ত এখনো পর্যন্ত টিকা দেয়নি।
তার এ কথা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়। কোন কোন রাজ্যে আসলেই টিকার সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব রাজ্য দ্রুত টিকা দেয়ার কাজটি করতে পেরেছিল। একথা বলছেন দিল্লি-ভিত্তিক একটি থিংক ট্যাংক, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ওম্মেন সি কুরিয়ান।
তিনি আমাকে জানালেন, এই সংকটের পেছনে হয়তো আছে অন্য কারণ। তাঁর মতে, ভারতের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা যতটুকু বলে দাবি করে, তার সঙ্গে প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতার হয়তো একটা ফারাক আছে। এই সংকটের শুরুটা হয়তো সেখান থেকে।
ভারতের টিকাদান কর্মসূচী বিশ্বের বৃহত্তম। গত ১৬ জানুয়ারি ভারতে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া শুরু হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল জুলাই মাস নাগাদ ২৫ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া। শুরুতে টিকাদান কর্মসূচি কেবলমাত্র সীমিত রাখা হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মী এবং ফ্রন্ট-লাইনের কর্মীদের জন্য । তবে এরপর ধাপে ধাপে ৬০ বা তার বেশি বয়সী, তারপর ৪৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী যাদের মধ্যে অন্য কোন অসুস্থতা আছে তাদের, এবং ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে সবার জন্য এই কর্মসূচী সম্প্রসারিত করা হয়।
ভারতে যে দুটি টিকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি কোভিশিল্ড, অন্যটি ভারতীয় কোম্পানি ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন। রোববার পর্যন্ত এই টিকার দশ কোটি ডোজ দেয়া হয়েছে।
প্রতিদিন গড়ে ৩০ লক্ষ দোষ টিকা দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও ভারত এ পর্যন্ত ৬ কোটি ৪৫ লক্ষ ডোজ টিকা বিশ্বের ৮৫টি দেশে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে কিছু টিকা উপহার হিসেবে আর কিছু বাণিজ্যিক চুক্তির অংশ হিসেবে দেয়া হয়। এই চুক্তি হয়েছিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে। আর বাকী টিকা পাঠানো হয় কোভ্যাক্স স্কিমের আওতায়, যার নেতৃত্বে আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের এক বিরাট শক্তি, তাদের সমকক্ষ কেউ নয়। ভারতের রয়েছে এক বিশাল টিকাদান কর্মসূচি এবং বিশ্বের ৬০ ভাগ টিকা ভারতে তৈরি হয়। ভারতে প্রায় আধা ডজন টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে, এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া। এটি বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ভারতে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে টিকাদান কর্মসূচি এক বিরাট এবং অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে এই টিকাদান কর্মসূচির লক্ষ্য যদি অর্জন করতে হয়, এটিকে আরো দ্রুততর করা প্রয়োজন। কিন্তু এটা ঠিক পরিষ্কার নয় ভারতের যথেষ্ট পরিমাণে টিকা আছে কিনা এবং টিকাদান কর্মসূচি আরও সম্প্রসারিত করার সক্ষমতা রাজ্যগুলোর আছে কিনা।
যে মূল প্রশ্নটা নিয়ে অনেক দিন ধরে জল্পনা চলছে, তা হলো, ভারতের আসলে টিকাদান কর্মসূচি আরো দ্রুততর করা বা তরুণদের জন্যও টিকা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ টিকার মওজুদ আছে কিনা। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন ভারত লক্ষ লক্ষ ডোজ টিকা বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে এবং ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির শোরগোল তুলে যে কাজটি করেছে সেটা সঠিক ছিল কিনা।
ভারতের টিকার মওজুদ নিয়ে বিতর্ক চলছে
ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট, যারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি করে, স্থানীয়ভাবে যেটি কোভিশিল্ড নামে পরিচিত, এ নিয়ে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছে। গত সপ্তাহে সিরাম ইন্সটিটিউট বলেছে, তাদের টিকা উৎপাদনে সক্ষমতার ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। সিরাম ইন্সটিটিউটের প্রধান আদর পুনাওয়ালা ভারতীয় টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের সমস্ত মানুষকে দেয়ার মতো টিকার ঘাটতি আছে তাদের।
সিরাম ইন্সটিটিউট বলছে তারা ভারতে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ছয় থেকে সাত কোটি টিকা সরবরাহ করছে এবং এ বছরের শুরুতে টিকার উৎপাদন শুরু হওয়ার পর প্রায় সমপরিমাণ টিকা তারা অন্যদেশগুলোতে রপ্তানি করেছে।
গত জানুয়ারিতে এই প্রতিষ্ঠানটি বিবিসিকে জানিয়েছিল, তারা তাদের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা প্রতিমাসে ১০ কোটিতে উন্নীত করতে চায়। কিন্তু এখন তারা বলছে তারা জুন মাস শেষ হওয়ার আগে হয়তো এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। কারণ গত জানুয়ারিতে পুনে শহরে তাদের একটি উৎপাদন স্থাপনায় অগ্নিকাণ্ডে যে ক্ষতি হয়েছিল সেটি ঠিক করতে তাদের সময় লাগছে।
কিন্তু ঐ অগ্নিকাণ্ডের পর মিস্টার পুনাওয়ালা বলেছিলেন যে তাদের টিকা উৎপাদনের ওপর এর কোন প্রভাব পড়বে না। তিনি আরও বলেছিলেন যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাদের কিছু বিকল্প উৎপাদন স্থাপনা তৈরি আছে।
সিরাম ইন্সটিটিউট বলছে তাদের কোম্পানির আর্থিক অবস্থার উপর যে চাপ তৈরি হয়েছে সেটাও তাদের টিকা উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। আদর পুনাওয়ালা একটি ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সরকারের কাছে ৪০ কোটি ডলার সহায়তা চাইছেন যাতে তাদের টিকাদানের স্থাপনা আরো বাড়ানো যায়। সিরাম ইন্সটিটিউট প্রতিটি টিকার ডোজ দুই ডলারে ভারত সরকারের কাছে বিক্রি করছে এবং মিস্টার পুনাওয়ালা বলছেন এই দরে তারা তাদের কোম্পানির টিকা উৎপাদন ক্ষমতা আরও বাড়াতে পারছেন না।
আদর পুনাওয়ালা ভারতের এনডিটিভিকে বলেন, "এটা আমাদের খরচের হিসেবে ছিল না, কারণ কথা ছিল আমরা অনেক বেশি রপ্তানি করবো এবং যে সমস্ত দেশে রপ্তানি করা হবে সেসব দেশ থেকে আমরা খরচটা তুলে আনবো। সেটাতো আর ঘটছে না, কাজেই এখন আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন কিছু উদ্ভাবনী পথ খুঁজতে হচ্ছে, যাতে করে আমরা ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার এই সময়টাতে সাহায্য করতে পারি।"
স্পষ্টতই ভারতের টিকার স্বল্পতা সারা পৃথিবীর উপরে একটা বিরাট প্রভাব ফেলেছে। গত মাসে ভারত সাময়িকভাবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সিরাম ইন্সটিটিউট বলছে তারা জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে তিন কোটি ডোজ রপ্তানি করেছে। এটি তাদের রপ্তানি ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক। এর ফলে এখন রপ্তানির ক্ষেত্রে তিন হতে চার কোটি ডোজ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
আদর পুনাওয়ালা ভারতের আরেকটি টিভি চ্যানেল সিএনবিসি-টিভি-এইটিনকে বলেন, "আমরা তাদেরকে বলেছিৱ, ভারতে এখন টিকার চাহিদা এত বেশি যে, আমাদেরকে এখন রপ্তানির চাইতে ভারতের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাকে বলেন, টিকা সরবরাহে দেরি হতে থাকায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের প্রতিষ্ঠানকে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে এবং ভারত সরকারও এই বিষয়টি অবগত আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের কিছু এলাকায় টিকার যে সংকট দেখা দিয়েছে তার কারণ হয়তো সরবরাহের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যা বা অসুবিধা। আর যারা টিকা তৈরি করছে তারাও আসলে সারা পৃথিবী থেকে অর্ডার নিয়ে তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত বিক্রি করে বসে আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, "সংক্রমণের হার যখন আবার বাড়তে শুরু করেছে এবং টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল সেটা কমতে শুরু করেছে, তখন টিকার চাহিদা বাড়তেই থাকবে। কাজেই আমাদের কারো ভালোভাবে পরিকল্পনা করতে হবে।"
এই মুহূর্তে অবশ্য ভারতের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই। জুন মাস নাগাদ ভারতে আরেকটি নতুন টিকা, সম্ভবত 'স্পুটনিক' অনুমোদন পাওয়ার কথা। সিরাম ইন্সটিটিউট যুক্তরাষ্ট্রের নোভাভ্যাক্সের সঙ্গে মিলে যে টিকাটি আবিষ্কার করেছে, সেটি সেপ্টেম্বরের আগে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
"কাজেই ভারতকে এখন টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। ভারতে কোভিড-১৯ এর মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে হলে ১২ কোটি বয়স্ক মানুষকে অতি দ্রুত টিকা দেয়া ছাড়া কোন পথ নেই। এটা করতে হবে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। এর সঙ্গে লাগবে একটি পরিকল্পিত প্রচারাভিযান, যাতে স্থানীয় সরকার, সিভিল সোসাইটি, ধর্মীয় নেতা- সবার সহযোগিতা লাগবে," বলছেন ওমেন সি কুরিয়েন।
এবিএন/মমিন/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ