আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

ভুট্টো যেভাবে পাকিস্তানে ক্ষমতার ভাগ চেয়েছিলেন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:৫২

উনিশশ একাত্তর সালের জানুয়ারিতে লারকানায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর জমিদারিতে যে হাঁস শিকারের আয়োজন করা হয়েছিল সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। অপারেশন সার্চ লাইটের ধারণা তৈরি হয় সেখানেই।কিন্তু তার আগে থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ফাটল বাড়তে থাকে।

উনিশশ সত্তরের নির্বাচনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল। সাতই ডিসেম্বর জাতীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের সুবাদে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে শুধু পূর্ব পাকিস্তানে অদ্বিতীয় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল।

ঐ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬২টি আসনের মধ্যে দুটি ছাড়া সব আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৮টি আসনের মধ্যে ৮১টি আসন পায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি (পিপিপি)।

আওয়ামী লীগ এবং পিপিপি পাকিস্তানের দুই অংশের দুটি গরিষ্ঠ দল, কিন্তু অন্য অংশে একটি আসনেও জিততে পারেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির ২৩ বছর পর একমাত্র ও সর্বশেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কার্যত তৎকালীন পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘোষিত হয়।

কিন্তু ঐ নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক-বেসামরিক এস্টাব্লিশমেন্টের জন্য একটা বজ্রপাতের মতো। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তারা যেসব তথ্য পাচ্ছিল, তাতে তারা ধরে নিয়েছিল নির্বাচনে কোন একটি দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না।

আর এ নিয়ে সংসদে অচলাবস্থা তৈরি হলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু রয়ে যাবে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে। আর তেমনটা যাতে ঘটে সেজন্য তারা পর্দার অন্তরাল থেকে কাজও করে যাচ্ছিল।

সে সময় ঢাকায় বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান পদে কাজ করছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক ‘হাও পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ বইতে লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে আমি নুরুল আমীন এবং খাজা খয়েরুদ্দিনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিলাম। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল দুটি : এক, ‘ইসলাম-পসন্দ’ দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ো তোলা এবং দুই, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির কবল থেকে পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিকে রক্ষা করা।”

এতে তারা কিছুটা সফলও হয়। প্রায় ৮০টি আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত করার পর রাও ফরমান আলী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঐ উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

এর পর তিনি লিখছেন, নির্বাচনের পর শেখ মুজিবের সাথে যখন তার সাক্ষাৎ হয়, তিনি তখন আওয়ামী লীগ বিরোধিতার জন্য রাও ফরমানকে অভিযুক্ত করেন। সে সময় এক চাতুর্যপূর্ণ জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আপনাকে সাহায্য করার জন্যই এটা করা হয়েছিল। কারণ বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেলে আপনি চরমপন্থিদের ক্রীড়নকে পরিণত হবেন!”

এই নির্বাচন বিশেষভাবে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভুট্টোর জন্য। আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারে তার উত্থান। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র, শ্রমিক এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তিনি তার নবগঠিত দল পিপিপির পতাকা তলে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন।

সে সময় বালোচ এবং পাখতুন জাতীয়তাবাদীরা পাকিস্তানের ‘একক ইউনিট’ ব্যবস্থার অবসান দাবি করছিলেন।

ভুট্টো নিজে সিন্ধী। কিন্তু দেশের সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত পাঞ্জাবী সেনা-বেসামরিক শাসকগোষ্ঠীর হাতে। তাই জেনারেল পীরজাদা, ওমর এবং গুল হাসানের মতো সে সময়কার গুরুত্বপূর্ণ সেনা অধিনায়কদের সাথে তিনি সখ্যতা গড়ে তুলছিলেন।

আইয়ুব মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর তার ব্যাপারে জেনারেলদের যেসব সন্দেহ ছিল, তিনি তা দূর করতে পেরেছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর পিপিপি'র রাজনৈতিক স্লোগানটি রচনা করেছিলেন বাঙালি কমিউনিস্ট নেতা জালালুদ্দিন আব্দুর রহিম : “ইসলাম আমাদের ধর্ম, গণতন্ত্র আমাদের রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র আমাদের অর্থনীতি: জনগণই ক্ষমতার মালিক।’’

তার ব্যাপারে সামরিক-বেসামরিক শাসক শ্রেণির সন্দেহ ভুট্টো দূর করতে পেরেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কণ্ঠস্বর এবং ‘দেশপ্রেমের প্রতীক’।

কিন্তু ’৭০-এর নির্বাচন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে কাঁটা হয়ে দেখা দেয়।

জি ডব্লিউ চৌধুরী ছিলেন সে সময়কার কেন্দ্র সরকারের যোগাযোগ বিষয়ক মন্ত্রী। তার বই ‘দ্য লাস্ট ডেজ অফ ইউনাইটেড পাকিস্তান’-এ তিনি লিখেছেন, ১৯৭০-এর ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি- এই দুই মাসে ভুট্টো যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন তার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাকে যদি দুটো ‘পি’ অর্থাৎ ‘পাওয়ার অথবা পাকিস্তান’র মধ্যে কোন একটিকে বেছে নিতে বলা হলে তিনি পাওয়ার অর্থাৎ ক্ষমতাকেই বেছে নেবেন। সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলেও তাতে কিছু আসে যায় না।

সে সময় ভুট্টো বলেছিলেন, ‘তার দলের সমর্থনকে বাদ দিয়ে কোন সংবিধান রচনা কিংবা কেন্দ্রে কোন সরকার গঠন করা যাবে না।’

তার গণতান্ত্রিক ছদ্মবেশকে পরিত্যাগ করে তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই বড় কথা নয়।”

তেসরা মার্চ ঢাকায় নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের বৈঠকের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি এতটাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন যে তিনি এমনকি তার নিজের দলের এমএনএ সদস্যদের প্রতি হুমকি দিয়ে বলেন, কেউ ঢাকায় গেলে তার ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়া হবে।

সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাঈদা হামিদ ভুট্টোর রাজনৈতিক জীবনীমূলক বই ‘বর্ন টু বি হ্যাংগড’-এ জানিয়েছেন, তার হুমকিতে পিপিপির অন্য সংসদ সদস্যরা ভীত হলেও একজন এমএনএ- আহমেদ রাজা খান কাসুরি তাকে উপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তার ফল ভোগও তাকে করতে হয়েছিল। ভুট্টো যখন প্রধানমন্ত্রী তখন ১৯৭৪ সালে কাসুরিকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঐ হামলায় কাসুরির বাবা নবাব মোহাম্মদ আহমেদ খান কাসুরি নিহত হন।

পরে থানায় মামলা করার সময় রাজা খান কাসুরি বলেছিলেন ঐ হত্যা প্রচেষ্টায় যে গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল তা ব্যবহার করতো ভুট্টোর নিয়ন্ত্রণাধীন আধাসামরিক বাহিনী ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্স।

এদিকে, চাপ শেখ মুজিবের ওপরও ছিল। নির্বাচনের অভূতপূর্ব ফলাফল আওয়ামী লীগের মধ্যে স্বাধীনতাকামীদের আস্থা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ছয় দফার ম্যানিফেস্টো থেকে একচুল সরে দাঁড়ানোর কোন উপায় ছিল না। দলের মধ্যে ছাত্র সমর্থক এবং দলের বাইরে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির পাঁচ-দফা দাবি শেখ মুজিবের অবস্থানকে অনড় করে তুলেছিল।

ওদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী চাইছিল গরিষ্ঠ দলের নেতা এবং ‘ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে মুজিব যেন পশ্চিম পাকিস্তানে যান এবং সংবিধান রচনা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে সামরিক সরকারের জারি করা ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ বা এলএফও’র আওতায় সমঝোতার জন্য ভুট্টোর সাথে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু তিনি তা করতে রাজি ছিলেন না। কারণ আওয়ামী লীগ মনে করছিল, গরিষ্ঠ দল হিসেবে সংবিধান রচনার অধিকার তার এবং সেই সংবিধানে ছয়-দফার প্রতিফলন থাকতে হবে।

“এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের পর অনেকেই সন্দেহ করতে থাকেন যে শেখ মুজিব হয়তো অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে আগ্রহী নন,” জি ডাব্লিউ চৌধুরী লিখছেন, “আর তার প্রতি আরও সদয় মতামত হচ্ছে তিনি দেখাতে চাইছিলেন যে এরপর ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থাকবে ঢাকায়, রাওয়ালপিন্ডিতে নয়।”

ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকেই ঢাকায় যেতে হয়েছিল।

কিন্তু তার আগেই শেখ মুজিব এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যেটা ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সবাইকেই একেবারে চমকে দিয়েছিলেন।

তেসরা জানুয়ারি তিনি রমনা রেসকোর্সে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ছয়-দফার প্রতি গণরায়কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের সব এমএনএকে দিয়ে শপথ বাক্য পাঠ করান। এমএনএ’রা প্রতিজ্ঞা করেন যে দেশের সংবিধান রচনার সময় তারা কোনমতেই ছয়-দফাকে বিসর্জন দেবেন না।

নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের মধ্যে প্রথম বৈঠকটি হয় ১২ই জানুয়ারি। তেরই জানুয়ারি দ্বিতীয় দফার বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যখন ঢাকা ত্যাগ করছিলেন তখন তিনি সাংবাদিকদের জানান যে বৈঠকে জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ইয়াহিয়া খান বলেন, “এই প্রশ্ন তাকে (শেখ মুজিব) জিজ্ঞেস করুন। তিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। তিনি যখন দায়িত্ব নেবেন, তখন আমি থাকব না। তিনি শিগগিরই সরকার গঠন করছেন।”

উনশিশ একাত্তরের পুরো সময়টিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন মেজর সিদ্দিক সালিক। তার স্মৃতিকথা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’-এ তিনি লিখেছেন, ইয়াহিয়া খানের ঐ মন্তব্য শুনে “সেখানে উপস্থিত এক বাঙালী সাংবাদিক আমাকে বললেন আসল কথাটা হলো: আমি থাকবো না। কারণ নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাকে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখতে আওয়ামী লীগ রাজি হয়নি, যদি না তিনি আওয়ামী লীগের তৈরি শাসনতন্ত্রের খসড়াটি অনুমোদন না করেন।”

ওদিকে, ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন। তিনি জানতেন যে তিনি অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারছেন না। এমনকি এক ভাষণে তিনি ভাগাভাগি করে দেশ চালানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বলে সে সময় লাহোরের এক পত্রিকার শিরোনাম ছিল: “উধার তুম, ইধার হাম।” (তুমি ও দিকটায়, আমি এ দিকটায় [শাসন করবো]।

পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলরা যখন ছয়-দফা থেকে শেখ মুজিবকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলো তখন শুরু হলো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের আরেক অধ্যায়।

ঢাকা থেকে ফিরে করাচীতে একদিন থেকেই ইয়াহিয়া খান ছুটে গেলেন লারকানায়, সিন্ধু প্রদেশে ভুট্টোর পৈত্রিক জমিদারিতে। উদ্দেশ্য: হাঁস শিকার করা।

জি ডাব্লিউ চৌধুরী লিখছেন, শেখ মুজিবকে নিয়ে ইয়াহিয়ার হতাশার পুরো সুযোগ নিলেন ভুট্টো। লারকানা সফরে প্রেসিডেন্টের সঙ্গী ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, শেখ মুজিবকে যার অপছন্দের কথা কারও জানতে বাকি ছিল না। সাথে ছিলেন প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল এস.জি.এম পীরজাদা, সামরিক সরকারে ভুট্টোর সবচেয়ে কাছের লোক। সেখানে আরও হাজির ছিলেন পাঞ্জাব আর সিন্ধের দুই পিপিপি নেতা- গোলাম মুস্তাফা খার এবং মমতাজ ভুট্টো।

‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে রাও ফরমান আলী লিখছেন, ভুট্টোর তত্ত্বকেই সেখানে গ্রহণ করা হয়। তত্ত্বটি ছিল: জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের ‘আনুগত্য পরীক্ষা’ করবেন। শেখ মুজিব যদি ঐ স্থগিতাদেশ মেনে নেন, তাহলে তিনি ‘অনুগত পাকিস্তানী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। আর মেনে না নিলে প্রমাণ হবে তিনি পাকিস্তানের প্রতি ‘অনুগত নন।’ তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও বুঝতে পেরেছিলেন যে লারকানায় হাঁস শিকারের আড়ালে অন্য কিছু ঘটছে।

মূলত এই পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা এবং শেখ মুজিব সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী-মোহাজির সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতা-লোভী মহল মনস্থির করে ফেলে।

পিটার সিসন এবং লিও রোজ তাদের লেখা ‘ওয়ার অ্যান্ড সিসেশন : পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্যা ক্রিয়েশন অফ বাংলাদেশ’ বইতে সে সময়কার পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর মনোভাবকে ব্যাখ্যা করছেন এভাবে: “সামরিক বাহিনীর ছিল দু'ধরনের উদ্বেগ। প্রথমত, কার্যকর ক্ষমতাবান একটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত, সামরিক বাজেটকে অক্ষত রাখা এবং নিয়োগ, পোস্টিং, প্রমোশন ইত্যাদিকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রেখে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখা।”

সে কারণে এক যুগব্যাপী আইয়ুব শাসনের সুবিধাভোগী জেনারেলরা এমনিতেই কোন গ্যারান্টি ছাড়া বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে আগ্রহী ছিলেন না। আর শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে নিয়ে তাদের সন্দেহের আগুনে ক্রমাগত ঘি ঢালছিলেন ভুট্টো।

এর পর থেকেই যা চলেছিল তা হলো অবাধ্য শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার প্রস্তুতি। সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক সমঝোতার প্রহসনও চলতে থাকে।

পরিকল্পনা মত ইয়াহিয়া খান পরে ৩রা মার্চ ঢাকায় নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনটি স্থগিত ঘোষণা করেন। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান।

হাসান আসকারি রিজভী তার ‘দ্য মিলিটারি অ্যান্ড পলিটিক্স ইন পাকিস্তান’ বইতে মন্তব্য করেছেন, “মূলত, ২রা মার্চ, ১৯৭১ থেকে প্রমাণিত হয় যে অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণা একটি বিভ্রম মাত্র। শেখ মুজিব পরিণত হন পূর্ব পাকিস্তানের কার্যত শাসকে।” তার প্রকাশ ঘটে ৭ই মার্চের অবিষ্মরণীয় ভাষণে।

লারকানার ড্রিঘ লেকে হাঁস শিকারের পাশাপাশি কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের ধারণাটা সেখানেই রাজনৈতিক ও সামরিক অনুমোদন পেয়েছিল। গোড়ার দিকে যে অভিযানের নাম ছিল ‘ব্লিৎজ’, পরে সেটাকে আরও পরিবর্ধন করে নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এর স্বাদ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পেয়েছিলেন ২৫শে মার্চের রাতে।

সেই রাতে ঢাকাতেই ছিলেন ভুট্টো। তার নিজের লেখাতেই তিনি জানিয়েছেন, হোটেলের জানালা দিয়ে সারারাত ধরে তিনি ঢাকার সেই আগুন দেখেছেন।

সকালে তিনি তড়িঘড়ি করে ঢাকা ছাড়েন এবং করাচীতে গিয়ে মন্তব্য করেন: “থ্যাংক গড, পাকিস্তান হ্যাজ বিন সেভড”, অর্থাৎ “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে।”

কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা।

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ