আজকের শিরোনাম :

মার্কিন রক্ষীদের গুলি যেভাবে কেড়ে নিয়েছিল ইরাকি কিশোরের জীবন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৫৫

প্রাণোচ্ছ্বল ইরাকি কিশোর আলি কিনানি, বাবার সাথে বেড়াতে যাবে বলে বায়না ধরার সময় ভাবতেই পারেনি সেই ছিল তার শেষ যাত্রা। ভাবতে পারেননি তার পিতাও।

মোহামেদ কিনানির সর্বকনিষ্ঠ আদরের ছেলে আলি কিনানি। বাবার কাছে যখন যা আবদার করেছে, তা পেয়েছে। কিন্তু মোহামেদ স্বপ্নেও ভাবেননি এক সন্ধ্যায় ছেলের আবদার রাখার এমন চরম মূল্য দিতে হবে তাকে। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে সন্তান হারানোর শোক বয়ে বেড়াচ্ছেন বাগদাদের বাসিন্দা মোহামেদ কিনানি। বিবিসিকে বলেছেন তার জীবনের সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের দিনটির কথা।

ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। আমেরিকার একটি বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তা রক্ষীরা বাগদাদে বেসামরিক নিরাপরাধ মানুষের ওপর আচমকা গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল ১৪ জন ইরাকিকে, যার মধ্যে ছিল নয় বছরের কিশোর আলি কিনানি। আহত হয়েছিল আরও বিশ জন।

মার্কিন রক্ষীদের দাবি ছিল বিদ্রোহীরা আমেরিকান গাড়ি বহরের ওপর হামলা করলে তবেই তারা গুলি চালায়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা এবং ইরাকি কর্মকর্তারা আমেরিকানদের ওই দাবি প্রত্যাখান করেছিল। আমেরিকার আদালতেও ওই রক্ষীরা শেষ পর্যন্ত দোষী প্রমাণিত হয়েছিল।

ইরাকি নেতা সাদ্দাম হুসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমেরিকান সৈন্যরা তখন ইরাকের দখল নিয়েছে। দেশটিতে আমেরিকানদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে বেসরকারি মালিকানাধীন বিশাল এক মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থা ব্ল্যাকওয়াটার।

সংস্থাটির বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা রক্ষী তখন ইরাকে মোতায়েন। আর ইরাকি সেনাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বও নিয়েছে এই বিদেশি কোম্পানি। মোহামেদ কিনানি বলছিলেন আলি ছিল ঐ বয়সের আর পাঁচটা ছেলের মতই। তবে দারুণ বাবা-ভক্ত।

"আমার কাছে আলি ছিল আলাদা। সে ছিল আমার খুব আদরের । ভাইদের কাছ থেকে কোন কিছু চাইতে হলেই সে আগে আমার কথা বলতো। ওর মনে হতো আমার বিশেষ একটা ক্ষমতা আছে। আমার নাম করলেই ও যার কাছে যেটা চায়, সেটা পেয়ে যাবে। আমি যেন ওর জীবনে সবকিছুর জন্য সবুজ সঙ্কেত!"

মোহামেদের বুকে সবসময় ছেলেকে হারানোর যন্ত্রণা। তার প্রতিটা কথায় সেই যন্ত্রণা আর দুঃখের ছাপ।

"আমি জানি সে এখন আল্লাহর কাছে সুখে আছে। কিন্তু আমার বুক তো ভেঙে গেছে। সেখানে সবসময় রক্ত ঝরছে। তাকে আমি হারিয়েছি," কাঁদতে কাঁদতে বিবিসিকে বলছিলেন মি. কিনানি।

মোহামেদ বলছিলেন ঘটনার মাত্র চার বছর আগেও তিনি এবং তার মত বহু ইরাকি পরিবারের জীবন ছিল খুবই অন্যরকম। তিনি বলেন ২০০৩ সালে যখন আমেরিকান সৈন্য ইরাকে যায়, অনেকের মত তিনিও কিন্তু এক অর্থে খুশিই হয়েছিলেন।

"ভেবেছিলাম সাদ্দাম হোসেনের শাসনের শেষ হবে। আমাদের দেশে তো সম্পদের অভাব ছিল না। একটা দেশের ধনী হবার জন্য যা থাকা দরকার আমাদের সবই ছিল। আমরা ভেবেছিলাম আমেরিকা ইরাকের দখল নেবার পর দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে। তারা কিন্তু এমনটাই বলেছিল, আমরাও সেটা বিশ্বাস করেছিলাম।"

মোহামেদ বলেন, পরবর্তী বছরগুলোতে যখন জাতিগত দাঙ্গা বেড়ে গেল, এমনকী তখনও তারা ভেবেছিলেন, দেশ হয়ত ক্রমশ একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাবে।

আমেরিকা ইরাকের দখল নেবার পরের কয়েক বছরে কয়েক লক্ষ আমেরিকান সৈন্য সেখানে পাঠানো হয়। সৈন্যদের পাশাপাশি সেখানে পাঠানো হয় কয়েক হাজার নিরাপত্তা কর্মীকে। তারা সরকারি সেনা বাহিনীর অংশ ছিল না। কিন্তু আমেরিকানরা তাদের ওপর খুব বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।

২০০৭ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর বাগদাদের রাস্তায় মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়ি বহরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়েছিল ব্ল্যাকওয়াটার কোম্পানির নিরাপত্তা কর্মীদের।

বাগদাদের অন্য প্রান্তে মোহামেদ তখন বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।

"আমি বের হচ্ছি দেখে আলি দৌড়ে এল আমার গাড়ির কাছে। বলল আমার সাথে যাবে। আমি বললাম- না বাবা, ঘরে যাও। দেখলাম ওর মন খারাপ হয়ে গেছে। আমিও বললাম- আচ্ছা - আচ্ছা ঠিক আছে- এসো। ও খুশি হয়ে গেলো। আমি গাড়ি ছেড়ে দিলাম," বলছিলেন মোহামেদ।

ওরা প্রথমে মোহামেদের বোনের বাসায় গেলেন। সেখান থেকে বিশ মিনিটের পথ। বোন আর তার বাচ্চাদের গাড়িতে তুলে তারা রওনা হলেন শহরের কেন্দ্রে। কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরা শহরের গ্রিন জোনের কাছেই ব্যস্ত এলাকা নিসর স্কোয়ারের দিকে।

ওই গ্রিন জোনের ভেতরেই মার্কিন দূতাবাস। সেখানে অল্প দূরত্বে একটার পর একটা অনেকগুলো পুলিশ ও সেনা ফাঁড়ি বসানো- নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। সেখানে ওদের গাড়ি থামানো হল।

অনেক গাড়ি তখন সেখানে আটকে আছে। হঠাৎ শোনা গেল একটা শব্দ- যেন কেউ বন্দুকের গুলি ছুঁড়ছে।

"আমার বোন জিজ্ঞেস করল কীসের আওয়াজ?'' মোহামেদ বললেন। "আমি বললাম - কী জানি -জানি না। তবে এটা খুব নিরাপদ এলাকা। ভেবো না। এখানে তো কোন গোলমাল দেখছি না!"

মোহামেদ বোঝেননি সামনে কী হচ্ছে। সামনে সেনা বাহিনীর বেশ কয়েকটা গাড়ি রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। মোহামেদ ধরে নিয়েছিলেন ওগুলো আমেরিকান সৈন্যদের গাড়ি। কিন্তু সেগুলো ছিল ব্ল্যাকওয়াটার নিরাপত্তা রক্ষীদের গাড়ির কনভয়, যার মধ্যে ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

এদিকে রাস্তায় তখন গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে। সাধারণ গাড়িগুলো এগোতে পারছে না। একটা গাড়ি পেছনে ব্যাক করতে গিয়ে আরেকটা গাড়িকে ধাক্কা মারল, শুরু হল বচসা। একজন ইরাকি পুলিশ তাদের ঝগড়া থামাতে এগিয়ে এলেন। মোহামেদ বলছেন এরপরই দৃশ্যপট বদলে গেল।

"ওই কনভয়ের সাথে যে নিরাপত্তা রক্ষীরা ছিল, তারা এগিয়ে এল, পুলিশ তাদের বোঝানোর চেষ্টা করল যে কিছু হয়নি। গাড়ির ধাক্কা লাগা নিয়ে একটা সামান্য বচসা বেঁধেছে। কিন্তু সাথে সাথে কনভয়ের দুজন কর্মী হঠাৎ আচমকা গুলি চালাতে শুরু করল। কেউ কিছু বোঝার আগেই তারা এক নাগাড়ে গুলি চালাতে লাগল।"

"কেউ কোথাও নড়েনি। সবাই যে যার জায়গায়। তার মাঝেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসতে লাগল। গোটা নিসর স্কোয়ার একটা নরকের চেহারা নিল। আমি গাড়ির ভেতরেই ছিলাম। এর মধ্যে সামনের গাড়িটা পেছনে ব্যাক করতে শুরু করল। যাবে কোথায়? একটা চরম বিশৃঙ্খলা- কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি চিন্তা-শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম,... মনে হচ্ছিল এখুনি মরে যাবো," বলছিলেন মোহামেদ।

মোহামেদ গাড়িতে তার পাশের সিটে বসা তার বোনকে আড়াল করতে তার ওপর ঝুঁকে পড়লেন- বোনকে রক্ষা করতে। কিন্তু তিনি বললেন পেছনে বাচ্চাদের বাঁচাতে - তাদের আড়াল করতে তিনি কিছুই করতে পারেননি।

এরপর গুলি যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল, তেমনি আচমকাই থেমে গেল। মোহামেদ বললেন, তার বুলেটে-বিধ্বস্ত গাড়ি থেকে তিনি ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলেন। শুনতে পেলেন পেছনের সিট থেকে একটা ক্ষীণ কণ্ঠ।

"আমার ভাগ্নে বলল আলির গায়ে গুলি লেগেছে। আমি পেছন ফিরে তাকালাম। গাড়ির পেছনের দরজাটা খুললাম। দেখলাম আলির মাথায় গুলি লেগেছে। দরোজা বন্ধ করে দিলাম। পাগলের মত চেঁচাতে লাগলাম আমার ছেলেটাকে ওরা মেরে ফেলেছে। ওকে ওরা মেরে ফেলেছে!"

মোহামেদের গাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেই কোনমতে গাড়ি চালিয়ে তিনি কাছেই একটা হাসপাতালে যেতে পেরেছিলেন।

"গাড়ির পেছনের দরজা খুলে আমার ছেলেটাকে কোলে তুলে নিলাম। আমি তাকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। ডাক্তারের কাছে গেলাম- তরুণ ডাক্তার। তাকে বললাম- প্লিজ -প্লিজ আমার ছেলেকে বাঁচান। তিনি বললেন - আমার আর কিছুই করার নেই।"

আমেরিকান রক্ষীদের গুলি চালানোর ওই ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল ইরাকের মানুষ। ইরাকে মার্কিন সেনা উপস্থিতিতে দেশটিতে তখন ইতোমধ্যেই একটা ক্ষোভ জন্ম নিয়েছিল। তাতে ইন্ধন জোগাল এই ঘটনা। ইরাকের সরকার দেশটিতে ব্ল্যাকওয়াটার সংস্থার কাজের লাইসেন্স বাতিল করে দিল।

তিনজন ইরাকি ট্রাফিক পুলিশ যারা গুলির ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাদের এবং হতাহতের পরিবারের সদস্যদের সাথে ২০০৮ সালে কথা বলেন আমেরিকার কেন্দ্রীয় কৌঁসুলিরা

ব্ল্যাকওয়াটার যুক্তি দেখিয়েছিল, বিদ্রোহীদের হামলা ঠেকাতে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল।

কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা বারবার বলেছে এই অভিযোগ অসত্য। সেখানে কোন বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি। কোন বিদ্রোহী আমেরিকান দূতাবাসের কনভয় আক্রমণ করেনি।

পরে মার্কিন আদালতেও ব্ল্যাকওয়াটারের ওই যুক্তি খারিজ হয়ে যায়। সংস্থার চারজন নিরাপত্তা কর্মী যারা গুলি চালানোর ঘটনায় জড়িত ছিল তাদের চার বছর করে জেল হয়।

মামলায় উঠে আসে ওই সংস্থার নিরাপত্তা রক্ষীরা কীভাবে স্নাইপার বন্দুক, মেশিনগান এবং গ্রেনেড উৎক্ষেপক থেকে বিনা প্ররোচনায় গোলাগুলি চালিয়েছিল।

ইরাকি হতাহতের আত্মীয়-স্বজনদের বেশ কয়েকজনকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সাক্ষী দেবার জন্য। সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন মোহামেদ কিনানিও।

আদালতের কাঠগড়ায় তার ছেলের হত্যাকারীদের প্রথম দেখেছিলেন তিনি। "হত্যাকারীদের দেখে আমার মনের ভেতর বারবার একটা প্রশ্নই উঠছিল- কেন? কেন? কেন?"

আদালত মোহামেদকে তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার অনুমতি দিয়েছিল। তার ওই ''কেন''র জবাব তিনি পাননি। তার বক্তব্য শেষে ব্ল্যাকওয়াটারের আইনজীবী শুধু তার কাছে গিয়ে বলেছিলেন - "সরি- দু:খিত।"

মোহামেদ আদালতের নিয়ম অমান্য করে চিৎকার করে উঠেছিলেন, "অবশ্যই তোমাদের দুঃখিত হওয়া উচিত!"

ওই ঘটনার দীর্ঘ ১৩ বছর পর বিবিসির মাইক ল্যানচিনকে মোহামেদ বলছিলেন, একেক সময় তার মনে হয়, "কেন তিনি বেঁচে আছেন - কার জন্য?"

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ