আজকের শিরোনাম :

সুদানের সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার সিদ্ধান্ত হলো যেভাবে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২০, ২১:২৫

সুদান হচ্ছে আরব লীগের পঞ্চম সদস্য রাষ্ট্র, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে। গত শুক্রবার যেদিন এই সিদ্ধান্তের কথা জানা গেল, ঠিক সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন, তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসে মদতদাতা দেশগুলোর তালিকা থেকে সুদানের নাম বাদ দিচ্ছেন। এর ফলে এখন সুদানে মার্কিন সাহায্য এবং বিনিয়োগের পথ খুলে গেল।

প্রেসিডেন্ট শুক্রবার যখন এই ঘোষণা দেন, তখন আরও জানিয়েছিলেন, পাঁচটি আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে চায়।

এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা ঘোষণা করেছিল। গত ২৬ বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে এই দুটি দেশ প্রথম এরকম কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সুদান এখন ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, "এটি পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ।"

সুদান এবং ইসরায়েল এক সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে একটি বিবৃতি দিয়েছে এ বিষয়ে। এতে জানানো হয়েছে, দুই দেশের প্রতিনিধিদল সামনের সপ্তাহগুলোতে এ নিয়ে বৈঠকে বসবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, "নেতৃবৃন্দ সুদান এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং দুই দেশের মধ্যে বৈরিতার অবসান ঘটাতে একমত হয়েছেন।"

মাত্র কয়েক মাস আগেও আরব বিশ্বে ইসরায়েল ছিল অনেকটা এক ঘরে। মাত্র দুটি দেশ, মিশর এবং জর্ডানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল। এই দুটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে যথাক্রমে ১৯৭৯ এবং ১৯৯৪ সালে। দুটি চুক্তির ক্ষেত্রেই মধ্যস্থতা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

তবে ১৯৯৯ সালে মৌরিতানিয়াও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্ত দশ বছর পর তারা আবার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে।

একের পর এক আরব দেশ যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে, তাতে ফিলিস্তিনিরা ক্ষুব্ধ। ফিলিস্তিনি নেতারা এর নিন্দা করেছেন। তারা মনে করছেন, এসব দেশ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আরব দেশগুলোর ঐতিহাসিক অবস্থানে দুটি শর্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে যেসব এলাকা দখল করেছে সেগুলো ছেড়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। এই দুটি শর্ত পূরণ হলেই কেবল তারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, তিনি এই নতুন চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনিদের পক্ষ হয়ে অন্য কারও কথা বলার অধিকার নেই। অন্যদিকে হামাস বলেছে, এটি একটি ''রাজনৈতিক পাপ''।

যেভাবে এই সমঝোতার কথা ঘোষণা করা হয়

রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসে মদত দেয়া দেশের তালিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সুদানের নাম বাদ দেয় শুক্রবার। এর কিছুক্ষণ পর হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের ডাকা হয়। সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তখন টেলিফোনে কথা বলছেন সুদান এবং ইসরায়েলের নেতাদের সঙ্গে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এই চুক্তি ''শান্তির লক্ষ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এবং এক নতুন যুগের শুরু''।

সুদানের প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামদক তার দেশের নাম সন্ত্রাসবাদী দেশের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সুদান এমন এক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যেটি তার দেশের সবচেয়ে বেশি কল্যাণে আসবে।

এই দুই দেশের নেতার সঙ্গে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কথা বলছিলেন, তখন তিনি মন্তব্য করেন, " আপনাদের কি মনে হয় ঘুমকাতুরে জো এই কাজটি করতে পারতেন? আমার মনে হয় না।"

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনকে ''স্লিপি জো'' বা ঘুমকাতুরে জো বলে ডেকে থাকেন।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, "মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি, শান্তির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যে কারও সাহায্যকে আমরা স্বাগত জানাই।"

সামনের সপ্তাহের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সুদান এবং ইসরায়েলের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনাটিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির জন্য আরেকটি সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিবিসির সংবদদাতারা বলছেন, এরকম একটা সময়ে যে এই ঘোষণা আসলে, ব্যাপারটা মোটেই কাকতালীয় নয়। মিস্টার ট্রাম্পের ইসরায়েলপন্থী নীতি যুক্তরাষ্ট্রে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান ভোটারদের বেশ আকৃষ্ট করবে বলে মনে করা হয়। তার ভোট ব্যাংকের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ তারা।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেদিন আরও জানিয়েছিলেন, সৌদি আরব সহ আরও পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা বিবেচনা করছে।

প্রেসিডেন্টের একজন সহকারী জাড ডিয়ার বলেছেন, "সুদানের সঙ্গে এই শান্তি চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির লক্ষ্যে আরেকটি বড় পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে আরও একটি দেশ 'আব্রাহাম চুক্তিতে' যোগ দিল।"

ইসরায়েলের সঙ্গে ইউএই এবং বাহরাইন যে চুক্তি করেছে সেটি 'আব্রাহাম চুক্তি' নামে পরিচিত।

এদিকে ইসরায়েল জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউএই-র কাছে উচ্চমানের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা সেটির বিরোধিতা করবে না। ইসরায়েলের সঙ্গে ইউএই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর যুক্তরাষ্ট্র ইউএই-র কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি করতে রাজী হয়।

তবে ইসরায়েল বলেছিল, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর তুলনায় তারা সামরিকভাবে এগিয়ে থাকতে চায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে সাহায্য করতে রাজি হয়।

সুদান কেন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজী হলো

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই সুদানের সঙ্গে ইসরায়েলের খুবই বৈরি সম্পর্ক। এই সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকেই ১৯৬৭ সালে আরব লীগ কঠোরভাষায় ঘোষণা করেছিল, "ইসরায়েলের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে কোন শান্তি নয়। ইসরায়েলকে কোন স্বীকৃতি নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়।"

১৯৪৮ এবং ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হয়, তাতে সুদান লড়াই করেছিল। তারা ফিলিস্তিনি গেরিলা গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল। কয়েক বছর আগে সুদান গাজার ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর কাছে ইরানের অস্ত্র পাঠিয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়। এর পর ইসরায়েল এই কথিত চালানের ওপর হামলা চালায়।

সুদানে আসলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি একদম পাল্টে গেছে গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মুখে দীর্ঘদিনের একনায়ক ওমর আল-বাশিরের পতন ঘটার পর। তার জায়গায় এখন সুদানের শাসনভার ন্যস্ত হয়েছে অন্তর্র্বতীকালীন এক সামরিক-বেসমারিক কাউন্সিলের ওপর। সুদানের প্রকৃত ক্ষমতা এখনো জেনারেলদের হাতে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে। কারণ এর বিনিময়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র সুদানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নয়, তাহলে দেশটিতে অর্থনৈতিক সাহায্যের পথ খুলে যাবে, যেটা সুদানের এখন খুব দরকার।

তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সুদানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

বিবিসির সিনিয়র আফ্রিকা সংবাদদাতা অ্যান সয় বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপের মুখে সুদান অনেক বেশি ছাড় দিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রের তালিকা থেকে নাম কাটানোর জন্য সুদান যেন খুব বেশি উদগ্রীব ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র এ সপ্তাহেই জানিয়েছিল, তিনি তখনই সুদানের নাম এই তালিকা থেকে বাদ দেবেন, যখন আফ্রিকায় মার্কিন দূতাবাসগুলিতে সন্ত্রাসী হামলার ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ সুদান পরিশোধ করবে।

১৯৯৮ সালে কেনিয়া এবং তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে এসব হামলা চালিয়েছিল আল-কায়েদা। তখন আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেন সুদানে বসবাস করছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের এই শর্তের পর সুদান এই অর্থ একটি তহবিলে জমা দিয়েছে। এই তহবিল থেকে সন্ত্রাসী হামলার শিকার মানুষদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা।

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ