টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা
‘আমরা ক্ষমতায় না এলে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি থমকে যাবে’
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:৪৮
দরোজায় কড়া নাড়ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এই ব্যস্ততার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে বাংলাদেশ সফরে থাকা ভারতীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সময় দিয়েছেন। ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে টানা দুই মেয়াদে গত ১০ বছর ক্ষমতা থাকার অভিজ্ঞতা, সাফল্য, অর্জন, আগমী পরিকল্পনা এবং বিরোধীদের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতীয় সাংবাদিকদের এই আলাপন নিয়ে শনিবার (২২ ডিসেম্বর) ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখান থেকে নির্বাচিত অংশ পাঠকের জন্য।
আশা ও অর্জন
জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আবারও সরকার গঠনের আশাবাদ জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, , আমি আশা করি আবার সরকার গঠন করতে পারবো। আমরা কিছু ভাল কাজ করেছি। বেশ কিছু বড় প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পথে। আমি বিশ্বাস করি, আমি ক্ষমতায় ফিরলে তাতে বাংলাদেশের উত্থানে সুবিধা হবে। এখন আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭.৮৬ ভাগ। তবে আমরা মুদ্রাস্ফীতি শতকরা ৫ ভাগের সামান্য বেশিতে ধরে রাখতে সফল হয়েছি। এটা একটা অর্জন। তিনি বলেন, পদ্মাসেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প আছে, যা আমরা সম্পন্ন করতে চাই। এ জন্য বিশ্বব্যাংক আমাদেরকে ঋণ বাতিল করে দেয়ার পর এ প্রকল্প নিজেরাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হলে তা থেকে জাতীয় প্রবৃদ্ধি শতকরা ১.২ ভাগ যোগ হবে।
তিনি বলেন, উন্নয়নে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শত, সরকারের ধারাবাহিকতা। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র সাড়ে তিন বছর পর আমার বাবাকে সপরিবারে করা হয়েছিল। দেশে ১৯টি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। সামরিক শাসন ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করা হয়েছে। গত ১০ বছর ধরে আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছি। আমরা দারিদ্র্য হ্রাস করেছি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি, এখন আমরা সবার জন্য পুষ্টি ও উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ করছি। আমরা জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী ও দেশের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করতে চাই আমরা ২০২১ সালে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না ফিরলে আমি মনে করি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি থমকে যাবে।
নির্বাচন ও প্রতিপক্ষ
সংবিধান অনুসরনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাকে রাজনৈতিক সাফল্য উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি এটি রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে বিবেচনা করি। আমি সব রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলেছি এবং তাদের আশ্বাস দিয়েছি যে, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠ হবে। একটা কথা আমি আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি, সংবিধান ঠিক রেখেই আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু গতবার তারা (বিএনপি) আমার কথা শোনে নি। তারা ভেবেছিল, নির্বাচন থামিয়ে দিতে পারবে। জনগণ তাদের প্রত্যাখান করে।
তিনি বলেন, গত নির্বাচনে তারা যা করেছে তা ছিল ভয়াবহ। তারা হাতবোমা ছুড়েছে। ৩৯০০ টি গাড়ি পুড়িয়েছে। আগুনে পুড়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আমি জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি। হ্যাঁ, তারা ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে। তাদের এই ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম আমি স্বাগত জানিয়েছে। তারা আমাকে লিখেছিল যে, আমার সঙ্গে বসতে চায়। আমি তাতে সাড়া দেই। বেশ কিছ দাবি তারা তুলে ধরে, সেগুলো মেনে নিয়েছি।
বিরোধীদের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা জানেন মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় বিএনপির সঙ্গে যুক্ত আছে জামায়াতে ইসলামী। আমি বিশ্বাস করি না যে, মানুষ তাদের আদর্শকে গ্রহণ করবে। কিন্তু তাদের (বিরোধীদের) রয়েছে জোট। তারা মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্য করেছে, আমার মনে হচ্ছে, তারা পুরো জাতিকে বাণিজ্যে তুলতে চায়। এভাবেই তারা সব করতে চায়। আমাদের দিক থেকে বলব, নির্বাচনের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করবো।
প্রচারণা কৌশল
নিবাচনের আগে ৩০০ টি সংসদীয় আসনে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয় জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, নির্বাচনের আগে সব জায়গায় শারীরিকভাবে উপস্থিত হওয়া আমার পক্ষে মোটেও নয়। তাই শারীরিক প্রচারাভিযানের পাশাপাশি আমি ভিডিও কনফারেন্স করছি। আমি শেষ নির্বাচনেও এটি করেছি। আমাদের নেটওয়ার্ক আগের চেয়ে ভালো হওয়ায় ভিডিও কনফারেন্সে দেশের সবস্থানেই যুক্ত হওয়া যায়।
তিনি বলেন, কাজ করলে ভুল হবেই। তাই আমি আমার যে কোনো ভুলের জন্য ভোটারদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। আমরা একটি বড় দল,ফলে দলের সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব না। জনগণের সব চাওয়াও পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য আমাদের সময় প্রয়োজন। মানুষের জন্য কাজ করি, আমি তাদের সুন্দর জীবন উপহার দিতে চাই। আমি এই দরিদ্র দেশটিকে একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে চাই। এটা আমার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল। আমরা আশা করি, আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো।
তিস্তা চুক্তি
শেখ হাসিনা বলেন, ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলের সম্মতি প্রয়োজন হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু এটাই আপনাদেরকে জনগণের জন্য কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। সম্ভবত তিস্তা চুক্তি করতে অসমর্থ হওয়ায় তাদের (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) কিছু কারণ আছে। আমাদের ভূপ্রকৃতিই এমন। এখন আমাদের নদীগুলো আমরাই ড্রেজিং করার পরিকল্পনা নিয়েছি, যাতে বেশি পানি ধরে রাখা যায়। (ভারতের) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি পরামর্শ দিয়েছি যে, তাদেরও তাদের নদী খননে একই রকম কাজ করা উচিত। আমাদের যৌথ নদী কমিশন যেহেতু এরই মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে, তাই আমাদের অভিন্ন নদীগুলো একসঙ্গে ড্রেজিং করা যেতে পারে।
সার্ক
সার্ক প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আশপাশ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার মূল্য। কিন্তু আমরা কিছু রিজার্ভেশন আছে। আমাদের মেয়াদে তারা (পাকিস্তান) সন্ত্রাসকে উত্তেজিত করার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করার চেষ্টা করেছিল। আপনি এখন পাকিস্তানের অবস্থা দেখতে পারেন। আমাদের এমন কোন উপায় খুঁজে বের করতে হবে যে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
সন্ত্রাসবাদ
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসীদের কোন দেশে কোন ধর্ম নেই। আমিও আমার সন্ত্রাসবাদের শিকার, যখন তারা আমার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছিল। আমি ফিরে আসার পর, আমার সন্ত্রাসীদের দ্বারা আমার জীবনের অনেক প্রচেষ্টা করা হয়েছে। দেশ জঙ্গিবাদের আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদকে কখনো প্রশ্রয় দেব না।আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অনুমতি দেব না। কারণ আমরা জানি যে যদি আমরা এই অনুমতি দিই, আমাদের দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি বিশ্বাস করি যে শান্তি ছাড়া কোন অগ্রগতি হতে পারে না।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয়
বাংলাদেশের মানুষ অতীত ভুলে যায়নি উল্লেখ করে শেখ হাসিন বলেন,১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের জনগণকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছিল ভারত। এ জন্য এখনও আমরা কৃতজ্ঞ। আর মানবিক দিক থেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করেছি আমরা। মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো বিবাদ চাই না। তবে আমরা তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছি। তাদেরকে (রোহিঙ্গা) ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। কিন্তু আমরা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে বলেছি তাদেরকে। রোহিঙ্গারা চিরদিন (বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে) থাকতে পারে না। তাদেরকে অপব্যবহার করা হতে পারে। মিয়ানমারকে সমর্থন করছে ভারত ও চীন। এক্ষেত্রে আমরা আর একটু সাহায্য চাই ভারতের কাছে।
আত্মবিশ্বাস
আওয়ামী লীগের সভাপতি জানান, তিনি মনে করেন তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেশের জনগণ অব্যাহত দেখতে চায়। সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায়। এ দেশের সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আগামী নির্বাচনে তার দল জনগণের ভোটে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে এবং দেশের সেবা করার সুযোগ পাবে।
এবিএন/মমিন/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ