আজকের শিরোনাম :

বিএনপির গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারা বাদ দেয়া নির্বাচনী আইন ও নৈতিকতাবিরোধী

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০১৮, ২০:৫৩ | আপডেট : ১৩ জুলাই ২০১৮, ২২:৫৬

ঢাকা, ১৩ জুলাই, এবিনিউজ : বিএনপির দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারা বাদ দেয়া শুধুমাত্র সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়- এটি সম্পূর্ণ নৈতিকতাবিরোধী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিএনপি কৌশলগত কারণেই এমনটি করেছে এবং তড়িঘড়ি করেই এ সংশোধন এনেছে যা নিয়ম বহির্ভূতও।

তারা বলছেন, গঠনতন্ত্র সংশোধন হওয়া উচিৎ দলের প্রয়োজনে; ব্যক্তির স্বার্থে নয়। আর দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়- এমন অবস্থানও কোনো দলের কাছ থেকে কাম্য হতে পারে না।

বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর ‘দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে’ জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক’ সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল তার অন্যতম। কিন্তু বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারা বিলুপ্ত করায় দুর্নীতিতে দণ্ডিত ব্যক্তির দলের কমিটিতে সদস্য হতে বাধা থাকছে না।

এ বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর একটি মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম মনে করেন, “বিএনপির একটা ভয় ছিল; যদি দুর্নীতির দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের শাস্তি হয়, তাহলে তার সদস্য পদও থাকবে না; নির্বাচনও করতে পারবেন না।”

তার মতে নেতৃত্ব ধরে রাখতেই বিএনপি গঠনতন্ত্রে ওই সংশোধনী এনেছে। আর এই সংশোধনীকে সাংঘর্ষিক বলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে তাদের দলীয় নেতৃত্বের সঙ্কট ও সাংগঠনিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলের যে অবস্থান তার সঙ্গে গঠনতন্ত্রের এ পরিবর্তন সাংঘর্ষিক।”

তড়িঘড়ি সংশোধন

জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। সেই সঙ্গে তার ছেলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পাঁচ আসামিকে দেওয়া হয়েছে ১০ বছর করে কারাদণ্ড।

বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জরুরি অবস্থার সময় এ মামলা দায়ের করেছিল দুদক।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারক বলেছেন, সরকারি তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করে খালেদা জিয়াসহ জিয়া আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন।

ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা হওয়ায় আইন অনুযায়ী খালেদা জিয়া এখন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য। তবে হাই কোর্ট তার আপিল গ্রহণ করলে বিচারিক আদালতের ওই রায় স্থগিত হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে বিএনপিনেত্রীর সামনে।

কিন্তু খালেদা জিয়ার জন্য আরও একটি বিপদ ছিল দলীয় গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারায়। সেখানে বলা ছিল, দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির কোনো পর্যায়ের কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন।

সেই বিপদ এড়াতে রায়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ২৮ জানুয়ারি বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়। অবশ্য সেখানে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির কাউন্সিলে এসব সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।

আট পৃষ্ঠার ওই সংশোধনী প্রস্তবের বিষয়ে দলীয় চেয়ারপারসন ও কাউন্সিল অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে খালেদা জিয়া ইসিতে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, “উপরোক্ত সংশোধনীগুলো কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হলে কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমোদন করে। একই সঙ্গে কাউন্সিলের গৃহীত সংশোধনী অনুযায়ী অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদগুলোর ক্রমিকের অনিবার্য পরিবর্তন, ভাষা ও ছাপার ভুলগুলো সংশোধন করার প্রস্তাবও কাউন্সিলের অনুমোদিত হয়।”

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণার ১০ দিন আগে ৭ নম্বর ধারা বাদ দিয়ে বিএনপি দলীয় গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেয়।

এ ৭ ধারায় বলা ছিল, দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি বিএনপির কোনো পর্যায়ের কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হবেন।

এ থেকে দলীয় প্রধানকে বাঁচাতেই বিএনপি কৌশলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে বলে মত বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, এ সংশোধনী দুর্নীতি নিয়ে দলটির অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অবশ্য গঠনতন্ত্রের ৩-এ ‘সদস্য পদ লাভের যোগ্যতা’ ও ‘সদস্য পদ লাভের অযোগ্যতা’ ধারাটি বলবৎ আছে। তাতে বলা হয়- বাংলাদেশের আইনানুগ নাগরিক নন, এমন কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য হতে পারবেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতায়, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার বিরোধী, গোপন সশস্ত্র রাজনীতিতে বিশ্বাসী, সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সমাজবিরোধী ও গণবিরোধী কোনো ব্যক্তিকে সদস্য পদ দেয়া হবে না।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, ‘৩ নাম্বার ধারার নির্দেশনাই দলের যেকোনো কমিটির সদস্য ও সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্যতা হিসেবে ধরে নেয়া হবে।’

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলো কিনা তা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখন তাদেরই হাতে-বলছেন বিশ্লেষকরা।

তবে বিএনপির দাবি, ২০১৬ সালে ১৯ মার্চ দলের কাউন্সিলেই গঠনতন্ত্রে এসব সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অথচ ইসিতে এই গঠনতন্ত্র জমা দেওয়ার সময় সাত ধারা বহালই ছিলো।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের অনুযায়ী, নিবন্ধিত হওয়ার সময়ই দলীয় গঠনতন্ত্র জমা দিতে হয়। আর সংশোধন করা হলেও তা নির্বাচন কমিশনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হল কি না, তা দেখা ইসির দায়িত্ব।

বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্রে যে পরিবর্তন এনেছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, “আমরাতো তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করব না। তারা গঠনতন্ত্র সংশোধন করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে।” ওই সংশোধনী নীতিসিদ্ধ হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করেননি সিইসি।

তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করছেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রের সপ্তম ধারা বিলোপের উদ্দেশ্য কেবল একজন ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা। গঠনতন্ত্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়। কিন্তু এ পরিবর্তনটা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হয়নি; হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক।

আর ইডব্লিউজির পরিচালক আব্দুল আলীম মনে করেন, দলকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা-ই হোক, কেনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় বা এ ধরনের অবস্থান কখনো কাম্য নয়।

অবশ্য বিএনপির এ অবস্থানকে তাদের ‘সঙ্কট মোকাবিলার কৌশল’ বলে মনে করছেন রাজনীতির বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী, যিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।

তিনি বলেন, “দলীয় গঠনতন্ত্রের এ সংশোধন দলীয় ব্যাপার। প্রয়োজন মত দল সংশোধন করে। এখন বিএনপি কতটুকু সর্বসম্মতভাবে ও নৈতিকভাবে সংশোধন করেছে তার নির্ভর করছে বিদ্যমান পরিস্থিতির ওপর।”

নির্বাচনের বছরে বিএনপি চেয়ারপারসনের ওই রায় নিয়েও ‘জনমনে সন্দেহ’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির সাবেক এই নেতা।

“নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সঙ্কট মোকাবেলার জন্যে বিএনপি যদি অভ্যন্তরীণভাবে সংশোধনী আনে, তা দলটির কৌশল হতে পারে।… দেখতে হবে এ কৌশল বা চালে কার বেশি লাভ হচ্ছে। প্রধান দুই দলই চাল খেলছে। নির্বাচনে বা আন্দোলনে সফলতা এলেই তাদের চাল স্বার্থকতা পাবে; ব্যর্থ হলে চাল ভুল ছিল প্রমাণ হবে।”

অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের আগে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধনের সমালোচনা করেন।

পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, “মেজর কোনো পরিবর্তন হয়নি… আজকে বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে তাদের এত আশঙ্কা কেন, ভয় কেন? উনি নির্বাচন করতে পারবেন কি পারবেন না… নির্বাচন না করতে পারলে আপনার সুবিধা হয়, আমরা ভালো করেই বুঝি।”

বিএনপির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, সরকারি মহল খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বিএনপির নেতৃত্ব থেকে সরাতে চাইছে—এমন আশঙ্কা এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা দ্রুত গঠনতন্ত্রের ওই ধারা বাতিল এবং তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা মনে করেন, দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জিয়া পরিবারের বাইরে কোনো নেতৃত্ব মেনে নেবেন না।

এদিকে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিএনপি’র এই নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকান্ড শুধুমাত্র বিএনপিতেই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও দুর্বৃত্তায়ন ঘটাবে।

এবিএন/মাইকেল/জসিম/এমসি

এই বিভাগের আরো সংবাদ