আজকের শিরোনাম :

রাজনৈতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী অপরূপ স্থাপনা

  মোরসালিন মিজান

২৩ জুন ২০১৯, ০০:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

আওয়ামী লীগের আঁতুড়ঘর রোজ গার্ডেন
চোখ জুড়ানো নির্মাণ শৈলী। প্রাসাদোপম বাড়ি। কয়েকদফা নাম পরিবর্তন করা হলেও রোজ গার্ডেন নামেই বেশি পরিচিত। যারা দেখেছেন তারা জানেন, দৃষ্টি একদমই সরানো যায় না। বিস্ময় নয়নে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তবে পুরান ঢাকার এই বাড়ি শুধু সৌন্দর্যের আধার নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতাদের স্মৃতিধন্য। কিংবদন্তি নেতারা এখানে বসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক মিটিং করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাড়িটিতে জন্ম হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের।

আজ ২৩ জুন রবিবার বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতিহাস ধরে রাখার তাগিদ থেকে বর্তমানে বাড়িটিকে জাদুঘরে পরিণত করার কাজ চলছে।

নান্দনিক সৌন্দর্যে অতুলনীয় রোজ গার্ডেন টিকাটুলির কে এম দাস লেনে অবস্থিত। যতদূর তথ্য- এটি নির্মিত হয়েছিল সেই ১৯৩০ সালে। উন্নত রুচি ও অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভবনটি নির্মাণ করেন জমিদার হৃষিকেশ দাস। সাত একর জমির ওপর বিশাল দৃষ্টিনন্দন ভবন। বাড়ির মতোই সুন্দর চারপাশ। উদ্যানে চমৎকার ফুলের বাগান করা হয়েছিল। বিশেষভাবে দৃশ্যমান হতো গোলাপ। হরেক রকমের গোলাপ ফুটে থাকত বাগানে। বাগানের জন্য চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মাটিসহ গোলাপের চারা এনে লাগানো হয়েছিল। জানা যায়, এ কারণেই বাড়িটির নাম রোজ গার্ডেন। অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সাত হাজার বর্গফুট আয়তনের প্রাচীর। এ প্রাচীর টপকে এখন আর দেখা যায় না ভবনটি। কারণ সাধারণের প্রবেশ অনেক বছর ধরেই বন্ধ রয়েছে। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর স্থাপনাটি সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাড়িটি হৃষিকেশের সময়ই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল। ভারত বিভাগের পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বড় বড় নেতাদের এখানে আসা যাওয়া ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে বাড়িটি আওয়ামী লীগ জন্মের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়। বরেণ্য ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন জানান, ওই বছর রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। নব গঠিত দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’ পরবর্তীতে দলটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিতি লাভ করে। ক্ষণজন্মা পুরুষ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন প্রাণ পায় দীর্ঘ দিনের পুরনো এই দল।
 
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আব্দুল হামিদ খান ভাসানির মতো নেতারা রোজ গার্ডেনে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করেছেন। একইভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য এই বাড়ি। বর্তমানে বাড়িটির মালিক আব্দুর রশিদের মেজ ছেলের স্ত্রী লায়লা রকীবের বর্ণনা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি কাজী মোহাম্মদ বশিরের সঙ্গে দেখা করতে রোজ গার্ডেনে গিয়েছিলেন। সাদা গাড়িতে করে আসা নেতাকে সেদিন বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন বলে জানান তিনি।

ভবনটির উপরিভাগ গম্বুজ আকৃতির। উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। ভিত্তির ওপর ছয়টি বিভিন্ন উচ্চতার থাম। প্রতিটি থামের উপরিভাগে দৃষ্টিনন্দন নক্সা করা। পাঁচটি অংশে বিভক্ত বাড়ির সবক’টি বারান্দা থেকে বাগানের সৌন্দর্য দেখা যায়। পশ্চিম দিকে মুখ করা বাড়ির সামনের অংশ সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুন্দর। দূর থেকে দেখেই মন ভরে যায়। ভবনের প্রবেশদ্বারগুলোতে কাঠ ছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছে লোহা ও রঙিন বেলজীয় কাঁচ। ফুল লতা পাতার নক্সা করা হয়েছে। আছে বিভিন্ন প্রাণীর চেহারা। তিন তলা বাড়িতে মোট ১৩টি ছোট বড় কক্ষ। দ্বিতীয় তলায় বিশাল বলরুম। শ্বেত পাথরে গড়া মেঝে। সিলিংয়ে সবুজ কাঁচ। সেখানে ফুলের নক্সা। ভবনের অভ্যন্তরে দারুণ সব ঝাড়বাতি। ছাদে যাওয়ার জন্য রয়েছে প্যাঁচানো সিঁড়ি। এটিও নক্সা করা। বাগানে সুনিপুণ হাতে গড়া ভাস্কর্য। আছে ঝর্ণা ও পুকুর। সব মিলিয়ে অপূর্ব।

ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে বাড়িটি কিনে নেন ব্যবসায়ী খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদ। ১৯৩৭ সাল থেকে বাড়িতে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন তিনি। তখন রোজ গার্ডেনের নতুন নাম হয় রশীদ মঞ্জিল। ১৯৬৬ সালে রশিদের দ্বিতীয় পুত্র কাজী আব্দুর রকিব বেঙ্গল স্টুডিও এ্যান্ড মোশন পিকচার্সের কাছে এই সম্পত্তি লিজ দিয়ে দেন। রাজা বাদশা জমিদারদের কাহিনী নির্ভর অনেক চলচ্চিত্রের শূটিং হয় এখানে। সে সময় বেঙ্গল স্টুডিও নামে পরিচিতি পায় ঐতিহাসিক ভবন। এভাবে বহুবিধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রাম এবং আওয়ামী লীগের জন্মের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বাড়িটি ইতিহাসের অমূল্য স্মারক হয়ে উঠেছে। ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি তুলে ধরার ক্ষেত্রেও রাখতে পারে বড় ভূমিকা। এসব বিবেচনায় এখানে জাদুঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যায়।
 
সে লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রত্নসম্পদ নগদ অর্থে ক্রয় করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুসারে সরকার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে রোজ গার্ডেন ক্রয় করা হয়েছে। অর্থমূল্য ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকা।

সর্বশেষ তথ্য মতে, বাড়িটিতে জাদুঘর নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ জনকণ্ঠকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বাড়িটি ক্রয় করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিদের্শনা অনুযায়ী বর্তমানে জাদুঘরের ডিজাইন প্রণয়নের কাজ চলছে। মাসখানেকের মধ্যে ড্রাফট হাতে আসবে। তার পর শুরু হবে মূল কাজ। জাদুঘরে নানা মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরা হবে। বিশেষ গুরুত্ব পাবে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ। একইসঙ্গে জাদুঘরটিতে ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য ও বাঙালী সংস্কৃতির রূপ ফুটিয়ে তোলার নির্দেশনা রয়েছে। এ জন্য নগরভবনে অবস্থিত জাদুঘরটি এখানে স্থানান্তর করা হবে। ভবনের মূল ফর্ম অক্ষুণ্ণ রেখে জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ করা হবে জানান প্রতিমন্ত্রী।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ