আজকের শিরোনাম :

ঈদের মৌসুমে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে কেন?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০১৯, ২১:১৪

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি করা এক জরিপের পর যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গত বছর ঈদে মোট দুর্ঘটনার সাড়ে ১৫% ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কিন্তু এবার তা ৩৩% হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির তোফায়েল আহমেদ এবারের ঈদ মৌসুমে তার ৩৭ বছর বয়সী ছেলেকে হারিয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আরেকটি দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের সাথে সংঘর্ষের ফলে দুর্ঘটনার শিকার হন তার ছেলে। হাসপাতালে নেয়ার সময় তার মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে কি শুনেছেন বর্ণনা দিয়ে এই ঘটনার কথা জানাচ্ছিলেন তোফায়েল আহমেদ।

ছেলের দুই সন্তানসহ তার পরিবারের দায়িত্বও এখন এই বৃদ্ধের কাঁধে।

তিনি বলছিলেন, এই দুর্ঘটনায় তার পরিবারের উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে।

"আমি নিজে দেখিনি কিন্তু অন্যদের কাছে শুনেছি একটা মোটরসাইকেলের এসে লাগিয়ে দিয়েছিলো," তিনি বলছিলেন, "এখন তার একটা ছেলের ১১ মাস বয়স আরেকটা দুই বছর, আমার কাছেই থাকে। কী গজব যে আমাদের ওপর পড়েছে তা যদি দেখতেন তাহলে বুঝতেন।"

ছেলেকে সবসময় সাবধানে মোটরসাইকেল চালাতে বলতেন। এখন আশপাশে কোন মোটরসাইকেল চালককে পেলেই সাবধান করে দেন।

কিন্তু ঈদ মৌসুমে অসাবধানতা যেন একটু বেশিই দেখা গেছে এবার। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে সারা দেশে এ বছর ঈদ মৌসুমে মোট ২৩২টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ৭৬টিই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।

গত বছর এই সংখ্যা ছিল অর্ধেকের মতো। এবার মোট নিহতের মধ্যে ৩০ শতাংশ শুধু মোটরসাইকেল আরোহী।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলছেন, ঈদের মৌসুমে গণপরিবহনে বাড়ি ফেরার জন্য টিকেট সংগ্রহ সহ যেসব ঝক্কি যাত্রীদের পোহাতে হয় তা এড়াতে অনেকেই মোটরসাইকেল বেছে নিচ্ছেন।

তিনি বলছেন, "আজকের এই ডিজিটাল যুগেও ধরেন ট্রেনের টিকেট কিনতে স্টেশনে যেতে হয়, টিকেটের জন্য লাইনে দুইদিন দাড়িয়ে থাকতে হয়। যাত্রা নিশ্চিত করার জন্য আবার ওখানে যেতে হয়। বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, ওভারলোড, এইসব বিষয় এড়ানোর জন্য অনেকে মোটরসাইকেল বলে মনে করেন।"

তিনি আরও বলেন, "সাধারণ সময়ে হয়ত একজন থাকে। তার পেছনে আরেকজন থাকে। কিন্তু ঈদের সময় যেটা হয় স্ত্রী, বাচ্চা এবং নিজে থাকার পরে পেছনে একটা কাপড়ের ব্যাগ থাকে। যেটা ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করে।"

ঈদের সময় বাড়ি যাওয়ার জন্য সংখ্যায় যথেষ্ট মানসম্মত গণপরিবহনের অভাবের কারণে ভিন্ন পন্থায় যাওয়া ছাড়াও মোটরসাইকেল দ্রুতগামী হওয়ার কারণে বাংলাদেশে বাহনটি এমনিতেই অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসেবে, মোটরসাইকেলের নিবন্ধন আগের চাইতে অনেক বেড়েছে।

২০১৭ সালে সারাদেশে তিন লাখ ২৫ হাজারের মতো নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে।

পরের বছর এর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের বেশি।

যানবাহন ব্যবস্থাপনা ও সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলছেন, এর একটি অন্যতম কারণ হল যানজট ও রাইড শেয়ারিং অ্যাপের জনপ্রিয়তা।

শহরের গণ্ডি পেরিয়ে এখন এমনকি দূরপাল্লার যাতায়াতেও এর প্রভাব পড়ছে।

তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছিলেন, "রাইড শেয়ার জনপ্রিয় হওয়ার ফলে দেখা যাচ্ছে যে যার কোন ধরনের দক্ষতা নেই সেও কিন্তু রাতারাতি মোটরসাইকেলের ড্রাইভার হয়ে যাচ্ছে। আনাড়ি, বয়সে তরুণরা ঈদের মৌসুমে অপরিচিত রাস্তায় যখন চালাতে আসে তখন ঝুঁকি তৈরি হয়।"

তিনি আরও বলছেন, অনেকেই অ্যাপে না চালিয়ে কিন্তু আবার একটি অ্যাপের চালক পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছেন।

অধ্যাপক হক বলছেন, "অ্যাপে চালালে তার উপর একটা নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু সেটা সে যখন করে না আর যাত্রী তার রাইড শেয়ারের আউটফিটটা দেখে তখন নেগোশিয়েটেড প্রাইসে যায়, তখনই প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়।"

এছাড়া মোটরসাইকেল বাড়ির দরজা থেকে তুলে নিয়ে তার গন্তব্যের দরজায় পৌঁছে দেয়। অন্য বাহনে সেটি হয়না। সে কারণেও এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।

অধ্যাপক শামসুল হক আরও বলছিলেন, উৎসবের সাথে তরুণ প্রজন্মের হৈ হুল্লোড় আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সাথে একটি সম্পর্কে পাওয়া গেছে বিশ্বব্যাপী।

একই সাথে এবার ঈদের মৌসুমে বৃষ্টির কথা উল্লেখ করছিলেন বাংলাদেশ হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম।

কিন্তু এমন ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা ঠেকাতে কি করা হচ্ছে?

মি. ইসলাম বলছেন, তারা চালকদের শুভবুদ্ধির উপর নির্ভর করার আহবান জানাচ্ছেন।

তিনি বলছেন, "হাইওয়েতে চলাচলে মোটরসাইকেলের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। মোটরসাইকেল যখন রেজিস্টেশন দেয়া হয় তখন কোন নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে দেয়া হয়না। ট্রাকের মতো তারা সমগ্র বাংলাদেশে চলাচল করে।"

তবে তিনি বলছেন, "ধরুন আমি ২০০ বা ২৫০ কিলোমিটার দুরে যাবো একটা মোটরসাইকেলের উপরে নির্ভর করে, এই যাওয়াটা সঠিক হবে কিনা তাও আবার ঈদের মতো বড় মাইগ্রেশনের সময় এটা খুব যৌক্তিক না এবং এটা খুব শুভ বুদ্ধির বিষয় না।"

তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন পরিবারের উচিৎ সন্তানদের নিরুৎসাহিত করা।

অন্যদিকে বাংলাদেশে এখন স্থানীয়ভাবে মোটরসাইকেল উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।

সেটিকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন অধ্যাপক শামসুল হক।

আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে ঈদ মৌসুমে মহাসড়কে মোটরসাইকেল যাত্রা নিষিদ্ধ করার আহবান জানানো হচ্ছে। বিবিসি

এবিএন/মমিন/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ