আজকের শিরোনাম :

১৪ বছরের অপেক্ষা শেষ হচ্ছে আজ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০১৮, ০১:০২ | আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৮, ০১:১০

বহুল আলোচিত একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ (বুধবার)। দীর্ঘ ১৪ বছর এক মাস ২০ দিন পর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে।

রায় ঘোষণা উপলক্ষে এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকায় ১ নম্বর অস্থায়ী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য এদিন ধার্য করেন।

কী ঘটেছিল ২১ আগস্ট

সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে ২০ মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরুর ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনা মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসতে থাকেন। ঠিক এমন সময় শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড।

সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী।

মতিঝিল থানায় মামলা

ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশ। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরবর্তীতে মামলাটি যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন

২০০৪ সালের ২২ অগাস্ট বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে যে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল।

অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল।

যদিও ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি।

জজ মিয়ার নাটক

২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে জজ মিয়াকে আটক করে সেনবাগ থানা পুলিশ। ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের এক আলোচিত অধ্যায় হলো জজ মিয়া নাটক।

গ্রেফতারের পর তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। এরপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানায়। জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেন, তিনি আগে কখনও গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্যও তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। সেই বড় ভাইরা হচ্ছেন- সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ।

২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে এই মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন জোবাদা খাতুন। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে তাকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি।

পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

২০০৮ সালে প্রথম অভিযোগপত্র

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আখন্দ।

২০১১ সালে সম্পূরক অভিযোগপত্র

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ।

এর আগের চার্জশিটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। নতুনভাবে অভিযুক্তদের মধ্যে স্থান পান বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ উল্লেখযোগ্য।

এতে জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়। ফলে এ মামলায় এখন আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ৩১ জন।

মামলার বিচার শুরু

২০১২ সালের ২৮ মার্চ গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে মামলার অনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।

মামলায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমানসহ ২২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু হয়৷ আদালত ৬১ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। আলোচিত এ মামলায় ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। আরও ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। মামলার সাক্ষ্য শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ৩০ মে। সাফাই সাক্ষী ১২ অক্টোবর শেষ হয়েছে।

বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন

গত ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। এদিন জামিনে থাকা আট আসামির জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৩১ আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন।

রায় নিয়ে যা বলছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতিক্রিয়া

বহুল আলোচিত ২১ অাগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশের নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কাদের।

তিনি বলেন, ‘১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলার রায়। এই রায়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত যেন নাশকতা চালাতে না পারে সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো যাচ্ছে। আমরা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ন্যায় বিচার চাই। আমি নিজেও তো এই হামলায় আহত হয়েছি। আমাদের নেত্রীর (শেখ হাসিনা) একটা কানের শ্রবণশক্তি চলে গেছে। আইভি রহমানসহ ২৪ জনের প্রাণের প্রদীপ চিরদিনের মতো নিভে গেছে। কাজেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলাদেশে হবে না- তা কখনও হতে পারে না।’

এদিকে, ২১ আগস্টের ঘটনায় বিএনপির কোনো নেতাই জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে, উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে বিএনপি নেতাদের জড়িয়েছে। এ মামলায় বিএনপির কোনো নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। সরকার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না করে, প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের না করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে পুরো বিষয়টাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছে। উদ্দেশ্য একটাই এদেশ থেকে বাংলাদেশী জাতীয়বাদকে ধ্বংস করা।

তিনি বলেন, বিএনপি সরকার ঘটনার পরপরই মামলা করেছে, তদন্তের ব্যবস্থা করেছে। এমনকি এফবিআইকে আনা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১/১১ সরকারের সময় যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল, যে তদন্ত করা হয়েছিল সেখানে কোথাও তারেক রহমান কিংবা বিএনপির কোনো নেতার নাম উল্লেখ করা হয়নি। ৬১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের কেউ তারেক রহমানের নাম বলেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই গোটা পরিস্থিতি বদলে গেলো। আবার নতুন করে তদন্ত শুরু করে, কাহার আকন্দকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হলো।

এবিএন/শংকর রায়/জসিম/পিংকি

এই বিভাগের আরো সংবাদ