নিরাপদ সড়ক: আইন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাস্তায় কি বদলেছে কিছু?
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২২:০৮
আজই সংসদে পাশ হবার কথা 'বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন বিল', কিন্তু নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাড়া-জাগানো ছাত্র বিক্ষোভের পর বাংলাদেশের সড়কগুলোয় যান-চলাচলের যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি - তাতে কি কোন পরিবর্তন হয়েছে?
সড়ক পরিবহন বিল ২০১৮ আজ সংসদে পাশ হতে পারে। বিলটি আজ সংসদের কার্যপ্রণালীতে রয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে আলোচিত ঘটনার একটি সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলার সময় এই বিলটি মন্ত্রীসভায় অনুমোদন পেয়েছিলো।
এই আন্দোলনের মুখেই যেন টনক নড়ে সরকারের, নড়েচড়ে বসে যানবাহন খাতের সাথে সম্পৃক্ত চালক-মালিক, সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থাই।
কিন্তু এর কতটা প্রভাব সড়কে আসলে কতটা পড়েছে? যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে সড়কে এত মৃত্যু - সেটির কতটা পরিবর্তন হয়েছে?
সেটা দেখতে হলে বোধহয় ঢাকার রাস্তায় এক ঘণ্টা হাঁটলেই চলে।
ঢাকার মহাখালী থেকে কাকলীর দিকে যেতে রয়েছে এস্কালেটর দেয়া একটি ওভারব্রিজ। অর্থাৎ নিরাপদে রাস্তা পার হতে চাইলে এখানে অন্তত আপনাকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে না। স্বভাবতই সেটি অনেকেই ব্যবহার করেন।
কিন্তু তবুও দেখা গেলো, কিছু পথচারী রাস্তা দিয়েই পার হয়ে যেতে চাইছেন। তবে এখন পার্থক্য হলো : গার্ল গাইডদের উপস্থিতি।
রাস্তায় দাঁড়ানো গার্ল গাইডের একজন সদস্য বা ট্রাফিক পুলিশ এমন পথচারীদের ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। তাদেরকে ওভারব্রিজ দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। পথচারীরাও বিব্রত হয়ে ওভারব্রিজের দিকে হাঁটছেন।
এমন একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ওভারব্রিজ থাকা স্বত্বেও তিনি কেন রাস্তা দিয়েই পার হতে চাইলেন। তিনি জানালেন, "না আমি আসলে খেয়াল করতে পারি নাই যে এইখানে একটা ওভারব্রিজে আছে। আসলে ওভারব্রিজ দিয়েই যাওয়া উচিৎ।"
রাস্তায় বহু ঢাকাবাসীর সাথে কথা হল। তাদের জিজ্ঞেস করলাম তারা কি কোন ধরনের পরিবর্তন দেখছেন? একটি আসবাবপত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাকিলা সুলতানা বলছেন, "একটু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বাস চালকেরা যেখানে সেখানে যাত্রী নামাচ্ছে না। তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় নিশ্চয়ই কাজ করছে। কারণ আগে তো যেখানে সেখানে নামানো হতো।"
আবার ইদানীং মোটরসাইকেল চালক ও পেছনে বসা আরোহীদের প্রায় সকলের মাথায় হেলমেট চোখে পড়ছে। সকল পেট্রোল পাম্পে গেলে দেখা যাচ্ছে ব্যানার টাঙানো রয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে হেলমেট না থাকলে তেল দেয়া হবে না। সরকারি আদেশে এটি করতে বাধ্য হচ্ছেন পাম্প মালিকেরা।
তবে বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক, অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলছেন, আত্মতৃপ্তির কোন অবকাশ এখনো নেই।
তিনি বলছেন, "সত্যিকার অর্থে কোন পরিবর্তন আমাদের তখনই দৃশ্যমান মনে হবে যখন ম্যাস ট্রানজিট ব্যবস্থা চালু হবে। ঢাকা শহরে শুধু সড়কই রয়েছে। কিন্তু শহরে মাল্টি মোডাল ব্যবস্থা অর্থাৎ বাস, রেল ও পানিপথ সবগুলোর যদি সংযোগের ব্যবস্থা করতে পারি - শুধুমাত্র তাহলেই আপনি দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে পাবেন। ঢাকার এখনকার পরিবহন ব্যবস্থা দিয়ে বিশৃঙ্খলা মোকাবেলা কোনমতেই সম্ভব নয়"
তিনি বলছেন, "সব কিছুর ধারণক্ষমতার একটা সীমা থাকে। ঢাকা শহরে সড়কের ক্ষেত্রে সেই সীমা বহু আগেই পার হয়ে গেছে। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন বর্তমান গন-পরিবহন ব্যবস্থা দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাবে না।"
তিনি বলছেন, "সড়কে যে নৈরাজ্য আমরা দেখি, তা যুগের পর যুগ ধরে সৃষ্টি হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে তা বদলে যাবে সেটি ভাবার কোন কারণ নেই। তবে আমরা যারা সড়ক ব্যবহার করছি, যারা এই ব্যবস্থার সাথে জড়িত, অর্থাৎ চালক, মালিক, পথচারী ও যাত্রী, এদের মধ্যে যদি মানসিক কিছু পরিবর্তন আনতে পারি তাহলে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে হয়ত দশ পনেরো শতাংশ পরিবর্তনও যদি আনা যায় সেটাও কিন্তু কম না।"
কিন্তু যাদের নিয়ে সবচাইতে বেশি ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলো - সেই বাস চালকদের জোরে গাড়ি চালানো, সিগনাল অমান্য করা বা অন্য বাসের সাথে পাল্লা দেয়া - সেটি কতটা পরিবর্তন হয়েছে?
মোজাম্মেল হক দাড়িয়ে ছিলেন কাকলী থেকে বাসে চড়বেন বলে। তিনি বলছেন, "কিছুটা পরিবর্তন চোখে পড়লেও ঐ বাসওয়ালারাই একটু ডিস্টার্ব করে"
তার নমুনা জানতে চাইলে তিনি জানালেন, "এই যেমন দুইটা বাস একসাথে হইলেই পারাপারি লাগিয়ে দেয়। একটা আরেকটার গায়ে ঘষাঘষি লাগাইলেই উঠতে ভয় লাগে।"
যে কোন একটি ওভারব্রিজে উঠে দাড়িয়ে মিনিট খানেক কাটালেই সেই চিত্র পরিষ্কার বোঝা যায়।
জোরে গাড়ি চালানো, সিগনাল অমান্য করা, অন্য বাসের সাথে পাল্লা দেয়া, বারবার লেন পরিবর্তন করা, রাস্তার মাঝখানে যাত্রী তোলা ও নামানো, ইচ্ছেমত হর্ন বাজানো - ইত্যাদি নানা কার্যকলাপ সুযোগ মতো সবই চলছে ঢাকার রাস্তায়।
বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা নিজেই স্বীকার করছেন, "যে আন্দোলন হয়েছে তার প্রভাব ওপরের দিকে পড়তে পারে কিন্তু রাস্তায় যারা শ্রমিক আছে তাদের কাছে মেসেজটা যায় নাই"
তবে তিনি বলছেন, "আমাদের ভুল ত্রুটি আছে সে ক্ষেত্রে আমাদের যেমন দায়বদ্ধতা আছে তেমনি এইখানে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অন্য যারা আছে, বিআরটিএ, পুলিশ, যাত্রী সবার সমন্বয়ে কিন্তু পরিবহন খাত চলবে। এককভাবে পরিবহন শ্রমিকরা চেষ্টা করলেও কোন কিছু গ্যারান্টি দিতে পারবো না।"
অন্যদিকে অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলছেন, "যে উদ্যোগগুলো এখন নেয়া হচ্ছে তা চলমান থাকতে হবে। কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে দেখে থেমে গেলেই হবে না। কিন্তু সেই পরিবর্তনে আরো বহু দুর যেতে হবে।"
এক লেনে গাড়ি চালানো, ওভারটেক না করা, নিয়ন্ত্রিত গতি, হেলমেট ব্যবহার, পথচারীর দায়িত্বশীলতার সাথে রাস্তা পারাপার এরকম নানা আচরণকে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত করার কথা বলছেন তিনি।
তা না হলে কিশোরদের আন্দোলন বা নতুন আইন কোন কিছুই কাজে আসবে না।সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এবিএন/মমিন/জসিম