বাড়ি থেকে খাবার অর্ডার করে মাসে ২২ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৮:৩২
ভারতে শহরাঞ্চলের অনেক পরিবারই ফোন করে খাবারের 'হোম ডেলিভারি' নেন আজকাল। ভারতে প্রতিমাসে বড় ফুড-ডেলিভারি চেইনগুলো প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার কোটি অর্ডার সরবরাহ করে থাকে।
সরবরাহ করা খাবার যে প্লাস্টিক কৌটোয় আসে, বা সঙ্গে যে প্লাস্টিকের চামচ বা কাঁটাচামচ দেওয়া হয়, তা থেকে মাসে আনুমানিক ২২ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে ভারতে।
স্বামী আর পুত্র নিয়ে তিনজনের সংসার দমদমের বাসিন্দা ইভা চৌধুরীর।
বয়স হয়েছে, মাঝে মাঝে শরীরটাও ভাল যায় না। তাই ফোন করে খাবার আনিয়ে নেন প্রায়শই। "সপ্তাহে চার-পাঁচবার তো ফোন করে খাবার আনানো হয়ই," বলছিলেন মিসেস চৌধুরী।
কিন্তু সেই খাবার আসে যে প্লাস্টিকের কৌটোতে, সেগুলো বাড়িতেই জমিয়ে রাখেন তিনি।
"জমতে জমতে সেগুলো প্রায় পাহাড় হতে চলেছে - কয়েকশো কন্টেইনার তো হবেই। মা কিছুতেই ওই কন্টেইনারগুলো ফেলে না। নানা কাজে নাকি লাগে। কিছুতেই বলে বোঝানো যায় না যে ওগুলো একবার ব্যবহারের জন্য। তবে ফেলে দিলেও তো সেগুলো পলিউশানই তৈরি করবে," বলছিলেন মিসেস চৌধুরীর পুত্র।
খাদ্যে ঢুকে পড়ছে প্লাস্টিক, বিপদের মুখে বাংলাদেশ
দক্ষিণ কলকাতার গল্ফগ্রীণের বাসিন্দা অয়ন চক্রবর্তীর বাড়িতে প্রায়ই বন্ধু-বান্ধবরা আসেন আড্ডা দিতে। সুবিধাজনক অপশন হল, ফোন করে খাবার আনিয়ে নেওয়া।
"খাবারের সঙ্গে যে প্লাস্টিকের কৌটোগুলো আসে, তার মধ্যে দু একটা হয়ত কাজে লাগে, কিন্তু বাকি সবগুলোই নোংরার ঝুড়িতে ফেলতে হয়। জানি ওই প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণ তৈরি করে।"
"কিন্তু অপচ্য বর্জ্য আর পচনশীল বর্জ্য আলাদা করে নেওয়ার ব্যবস্থা তো এখানে নেই। তাই অন্য বর্জ্যর সঙ্গেই প্লাস্টিকের কৌটো ফেলে দিতে হয়। তবে হোম-ডেলিভারি নিলেও প্লাস্টিকের চামচ-কাঁটা এগুলো দিতে বারণ করে দিই," বিবিসিকে বলছিলেন মি. চক্রবর্তী।
প্লাস্টিকের কৌটো বা চামচ - এসব জমা হতে থাকে শহরের বর্জ্য ফেলার জায়গায়।
সেখান থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন অনেকে, যে কাজটাও খুব অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু সেটাও মোট প্লাস্টিক বর্জ্যর একটা সামান্য অংশ।
ভারতের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক হিসাব বলছে, সারা দেশে যত বর্জ্য তৈরি হয়, তার ৮ % প্লাস্টিক বর্জ্য।
শহরগুলির মধ্যে দিল্লিতে সবথেকে বেশী প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তারপরেই স্থান রয়েছে কলকাতা আর আহমেদাবাদের।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আরও বলছে, মোট যত প্লাস্টিক ব্যবহার হয়, তার ৬০% পুনরায় ব্যবহার করা হয়।
বাকি ৪০% প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতেই পড়ে থাকে অথবা নদী কিংবা সমুদ্রে মেশে, যা বিষিয়ে দিতে থাকে পরিবেশকে।
ভারতের নামকরা গবেষণা সংস্থা 'দা এনার্জি রিসার্চ ইন্সটিটিউট' বা 'টেরি' বলছে, প্লাস্টিক কাপ, বা চামচ-কাঁটা চামচে যেমন থাকে পলিস্টাইরিন, বা প্লাস্টিকের কৌটো বা জলের বোতলে থাকে পলিপ্রপিলিনের মতো রাসায়নিক।
এইসব রাসায়নিক যখন জলে বা পরিবেশে মিশে যেতে থাকে, তা থেকে বেরয় তামা, সীসা, দস্তা বা ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকারক পদার্থ।
সমুদ্রতটের শহরগুলিতে এই সব ক্ষতিকারক পদার্থ সামুদ্রিক পরিবেশকে যেমন বিষিয়ে দেয়, তেমনই বর্জ্য ফেলার জায়গাগুলোতে তৈরি করে গ্রীনহাউস গ্যাস - যার মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড আর মিথেন অন্যতম।
প্লাস্টিক বর্জ্য আর তার পুনর্ব্যবহার নিয়ে গবেষণা অনেকদিন ধরেই চলছে ভারতে
চেন্নাই শহরে একটি গোটা রাস্তাই প্লাস্টিক বর্জ্য মিশিয়ে তৈরি হওয়ার পর থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য বিটুমেনের সঙ্গে মিশিয়ে যেসব রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সেগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে বেশ কয়েকবছর পরেও কোনও গর্ত বা খানাখন্দ তৈরি হয় না।
পাশাপাশি ঘর সাজানোর নানা উপকরণ যেমন ল্যাম্পশেড প্রভৃতিও তৈরি হচ্ছে। আবার প্লাস্টিকের জল বা ঠাণ্ডা পানীয়র বোতল অনেকে কাজে লাগাচ্ছেন বাড়িতে ফুলগাছ লাগানোর জন্যও।
প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। তাই এখন চিন্তাভাবনা চলছে কীভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হওয়াই কমানো যায়।
"ঘটনাচক্রে আমাদের ব্যবসার একটা অনভিপ্রেত দিক দেখা যাচ্ছে - যত বেশী মানুষ আমাদের মাধ্যমে খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন, ততই বেশী করে প্লাস্টিক ব্যবহার করতে হচ্ছে। গোটা ফুড-ডেলিভারি শিল্প থেকে ২২ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে প্রতি মাসে। এর একটা বড় অংশই জমা হচ্ছে সমুদ্রে। "
"আমরা তাই ক্রেতাদের জন্য একটা অপশন রেখেছি - প্রয়োজন না হলে প্লাস্টিকের চামচ বা কাঁটাচামচ তিনি নাও নিতে পারেন," নিজের ব্লগে লিখেছেন আন্তর্জাতিক ফুড-হোম ডেলিভারি চেইন জোম্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা দীপিন্দর গোয়েল।
প্রতিদ্বন্দ্বী ফুড ডেলিভারি চেইন, যাদের ব্যবসা জোম্যাটোর থেকেও অনেকটা বড়, সেই 'সুইগি' বাজারে এনেছে পরিবেশ বান্ধব প্যাকেজিং।
সেখানে প্লাস্টিকের কৌটোর বদলে কাগজ আর অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ট্রে বা কাঠের চামচ-কাঁটা এসব থাকছে।
সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্কেটিং শ্রীভৎস টি এস বিবিসিকে বলছিলেন, "আমরা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তিনটি শহরে এইধরনের নতুন জিনিষ দিয়ে খাবারের অর্ডার সরবরাহ করতে শুরু করেছি। সুইগি প্যাকেজিং অ্যাসিস্ট নামের এই প্রকল্পতে স্থানীয় প্রস্ততকারকরাই আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রেস্তোরাগুলোতে কাগজ-অ্যালুমিনিয়ামের ট্রে, কাঠের কাঁটা-চামচ, বাক্স - এসব সরবরাহ করছেন। আমরা কর্ণ স্টার্চের মতো জিনিষ দিয়ে তৈরি কাটলারিও আনতে চলেছি এরপরে।"
মুম্বাইয়ের উদুপি এক্সপ্রেস নামের একটি রেস্তোরাঁ মালিক রোহিত শেট্টি জানাচ্ছেন, "কাঠের চামচ-কাঁটাচামচ এগুলো ব্যবহার করার পরে ক্রেতাদের কাছ থেকে ভাল সাড়া পাচ্ছি।"
আরেকটি ফুড-ডেলিভারি সংস্থা - 'উবারঈট' জানাচ্ছে, তারা সব খাবার কাগজের ব্যাগে সরবরাহ করে থাকে।
হায়দ্রাবাদের এক ব্যবসায়ী নারায়ণ পেস্সাপাতি সম্প্রতি কলকাতায় এসে দেখিয়েছিলেন যে তাঁর উদ্ভাবন করা চামচ-কাঁটাচামচ খেয়ে ফেলা যায়! ওগুলি জোয়ার, চালের গুঁড়ো আর ময়দা মিশিয়ে তৈরি। দেখতে একেবারে কাঠের চামচের মতো, কিন্তু তা দিয়ে অন্য খাবার খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে শক্ত পাউরুটির মতো এই চামচ-কাঁটাচামচগুলোও চিবিয়ে খেয়ে ফেলা যায়। এইসব পরিবেশ-বান্ধব প্যাকেজিং বা কাটলারির দাম এখনও বেশ বেশী।
তবে শিল্পমহল মনে করছে, ব্যবহার যত বেশী হতে থাকবে, দাম কমবে পরিবেশ-বান্ধব দ্রব্যগুলিরও। আর মিসেস চক্রবর্তীর বাড়িতে জমবে না প্লাস্টিকের কৌটোর পাহাড়। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এবিএন/মমিন/জসিম